যৌনতা আছে এমন লেখা নিয়ে নাক সিঁটকানোর মানুষের অভাব নেই। রে রে করে উঠে অনেকে। বলে উঠে গেল গেল উচ্ছন্নে গেল। সমাজটারে নোংরা বানানোর ফন্দি এসব। এমন আরও কত কথা শোনা যায়। এমন বলে কয়ে তারা এটাই প্রমাণ করতে চায় যে, এরা সব থেকে বড় সাধু, তারা চরিত্রবান (?) ভীষণ ভালোমানুষ!
তবে সত্যি কথা হচ্ছে, যৌনতা নির্ভর লেখার পাঠক সংখ্যা অন্য যে কোনো লেখার থেকে অনেক বেশি। শুধু লেখা কেনো! সিনেমা বা অন্য যা কিছু আছে সেখানে যদি যৌনতার ছোঁয়া থাকে, তাহলে সেটি সব কিছুকে পিছনে ফেলে সর্বাগ্রে এগিয়ে যায়। তাই প্রশ্ন হলো, এই যে আপনারা যারা যৌনতার প্রশ্নে নাক সিঁটকান, তারাই তো এসব বেশি পড়ছেন! তাহলে কেনো এমন মিছে ভান?
সানি লিওন ভালো না। পর্নো স্টার। তাকে বাংলাদেশে আসতে দেয়া হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি কথা বলেছিলেন হেফাজতে ইসলাম নেতারা। তবে আমি অবাক হয়েছি, সানি লিওন সম্পর্কে তারা কী করে জানেন! কীভাবে তারা নিশ্চিত হলেন সানি লিওন পর্নো স্টার? তবে মজার ব্যাপার কী জানেন, মডেল অমুক বা তমুকের ফলোয়ার সংখ্যা কম থাকলেও রেশমি এ্যালোনের ফলোয়ার, লাইকার এবং মন্তব্যদাতাদের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। প্রশ্ন হচ্ছে এরা কারা? যতদ্দূর তাদের প্রোফাইল ঘেটে পাওয়া যায়, এরা প্রায় সকলেই ভীষণ রকম ধার্মিক মানুষ। কেউ হিন্দুত্ববাদের কট্টোর সমর্থক, কেউ আবার ইসলামের ঝান্ডা হাতে জিহাদী হতেও মুখিয়ে আছেন। তাদের ওয়ালের প্রায় পোস্টই ‘আমিন’ এবং ‘জয়শ্রীরাম’ না বলে কেউ যাবেন না টাইপ। আবার তারা যেসব পেইজ বা গ্রুপ লাইক করে বসে আছে এবং নিয়মিত সেগুলোতে আসা-যাওয়া করে, সেগুলো প্রায় ‘সবিতাভাবি’ ‘১৮+ চটি’ এ রকম পেজ। তবে অবাক করার বিষয় কী জানেন? বিশ্বের মধ্যে যে দুটি দেশ থেকে অ্যাডাল্ট ওয়েবসাইট বা পর্নো সাইট বেশি দেখা হচ্ছে সে দুটি হচ্ছে ইরাক ও মিশর। আমাদের জানা মতে এই দুটি দেশ কিন্তু রক্ষণশীল দেশ হিসেবেই পরিচিত। সে যাহোক, আপনারা যারা যৌনতা নিয়ে নাক সিঁটকান, তারা নিজেরাও জানে না শ্লীল আর অশ্লীল কী জিনিস। যৌনতাও যে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করা যায়, তা আপনারা নিজেরাও জানেন না, বুঝেনও না। আবার এই যৌনতাও যে সভ্য মানুষ তৈরি করার একটা অনন্য শিক্ষা, সেটিও তারা বুঝে না, জানেও না। এই যে আজ এই সমাজে নারীর প্রতি পুরুষের যে দৃষ্টিভঙ্গি, তার নেপথ্যেই রয়েছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। কেননা, এই সমাজ ব্যবস্থা যে শিক্ষার ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সে শিক্ষা নারীকে যৌনদাসী, সেবাদাসী, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র বৈ মানুষ ভাবতে শেখায় না। যার ফলে গাড়িতে, মার্কেটে, ফুটপাতে, ট্রেনে, লঞ্চে সর্বপোরি ভিড়ের মধ্যে নারীর স্তন, নিতম্বসহ বিশেষ বিশেষ স্থানে অযাচিত নষ্ট কিছু পুরুষের হাত এসে ছুঁয়ে দেয়।
এই সমাজ ছোট বেলা থেকেই একজন ছেলে শিশুর মগজে নারী শরীর সম্পর্কে নানাবিধ চিন্তা বোপন করে দেয়। তখন থেকেই সে ভাবতে থাকে নারী মানেই বিশেষ একটা বস্তু। নারী মানেই শিহরণ। নারী মানেই কাম-বাসনার কেন্দ্রবিন্দু। যার কারণে বড় হয়েও সে এসব ভাবনা থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। ফলশ্রুতিতে এখান থেকে বের হয়ে নারীকে মানুষ ভাবতে পারে না পুরুষ সমাজ। ধর্ষণ সংঘটিত হওয়ার এটি একটি মূল কারণ।
আমাদের পাঠ্যক্রমে যদি যৌনশিক্ষা কার্যক্রম অন্তর্ভূক্তি করা যায় এবং এই শিক্ষা প্রতিটি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয়, তাহলে আমি নিশ্চিত নারীদের প্রতি বর্তমানে পুরুষদের যে দৃষ্টিভঙ্গি তা হ্রাস পাবে। নারীকেও তারা মানুষ ভাবতে পারবে। এই শিক্ষাটা অবশ্যই শিশুকাল থেকে ছেলে এবং মেয়েদের দিতে হবে। লিঙ্গ বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে শিশুদের দূরে রাখতে হবে। যৌনশিক্ষা বলছি বলে অনেকে হয়তো চোখ মুখ লাল করে তেড়ে আসার পরিকল্পনা করছেন। সমাজ উচ্ছন্নে নেয়ার পরিকল্পনা করছি, এমন হয়তো ভাবছেন অনেকে। আদতে না। যৌনশিক্ষা বলতে এখানে ‘কামসূত্র’ শেখানোর কথা বলছি না। যৌনশিক্ষা বলতে যারা শুধু কামসূত্রই বুঝেন তারা কামারপাড়া আর কুমারপাড়া এক করে ফেলতে পারেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
যারা যৌনশিক্ষা বলতে কেবল কামসূত্র বুঝেন, তাদের জেনে রাখা ভালো যে, যৌনশিক্ষা মূলত মানবিক যৌনতা, যৌন কার্যকলাপ, যৌন প্রজনন, সম্মতির বয়স, প্রজনন স্বাস্থ্য, প্রজনন অধিকার, নিরাপদ যৌনতা, জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং যৌন নিবিড়তাসহ মানব যৌনতার সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলি নির্দেশন করা হয়। এ দিকগুলিই যৌনশিক্ষা হিসাবে পরিচিত। এ শিক্ষার মাধ্যমগুলো হচ্ছে, বাবা-মা বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, প্রথাগত স্কুল প্রোগ্রাম, এবং জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রচারাভিযান। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে প্রগতিশীল শিক্ষা আন্দোলনের ফলে উত্তর আমেরিকার স্কুল পাঠ্যক্রম এবং স্কুল-ভিত্তিক যৌনশিক্ষার আগমন হয়। এর মাধ্যমে ‘সামাজিক স্বাস্থ্যবিধি’ প্রবর্তনের প্রসার ব্যাপকভাবে ঘটেছিল। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের স্কুলেও যৌনশিক্ষার প্রচলন রয়েছে।
এখন কেউ বলতে পারেন ইউরোপ আমেরিকা কিংবা ভারতে আছে বলে আমাদের এখানে এর প্রচলন ঘটাতে হবে? আমি বলব হ্যাঁ ঘটাতে হবে। কেননা, সাম্প্রতিক সময়ে সৎবাবা, জন্মদাতা, চাচাতো ভাই, মামাতো ভাই, বন্ধু, শিক্ষক, ইমাম দ্বারা যেভাবে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নারী, তা যথেষ্ট পরিমাণের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল পত্রিকার পাতা খুললেই দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ঘটনার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এসব ঘটনা দেখে, শুনে এটুকুটুই মনে হচ্ছে যে, বর্তমানে ধর্ষণ একটি মহামারি রোগ। এর থেকে শিশু বৃদ্ধা কারোরই নিস্তার নেই। বর্তমানে দেশে যেভাবে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে, নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হলে যৌনশিক্ষার বিকল্প অন্য কিছু হতে পারে না বলেই মনে করি। পাশাপাশি নারী নির্যাতন রোধে দেশে প্রচলিত যে আইন রয়েছে, এর যথাযথ প্রয়োগও বাঞ্ছনীয়। আর যদি তা করা সম্ভব না হয়, তবে বর্তমান পরিস্থিতিই বলে দিচ্ছে আগামীতে এই সমস্যাটা কতটা প্রকট হতে পারে। তাই এখনই এর রাশটানা দরকার। নয়তো এই ব্যাধি থেকে একদিন আমরা কেউই নিস্তার পাবো না।