দিলশানা পারুল

জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে পড়াশোনার পাশাপাশি লম্বা সময় ধরে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সাথে যুক্ত ছিলেন দিলশানা পারুল। দশ বছর বামপন্থি রাজনীতির সাথে ‍যুক্ত ছিলেন, তারপর দশ বছর এনজিওতে শিক্ষা গবেষনা এবং বাস্তবায়ন নিয়ে কাজ করেছেন। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় এডুকেশন সেক্টরে কাজ করছেন। এর পাশাপাশি অনলাইনে লিখালিখি করেন।

চুপ থাকবেন না, যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলুন

আমরা ছিলাম ছয় বোন, পাহারা দেয়ার জন্য কোনো ভাই ছিলো না। আমার বাবা নিপাট ভালো মানুষ, সাদামাটা, কারো সাথেও নেই পাছেও নেই টাইপস। এই টাইপস এর একটা বিপদও আছে। আব্বাকে অন্তত কেউ ভয়ের খাতায় গুনতো না। আমার মা ছিলো অতিব সুন্দরী কাজেই ঘরে সাত সাতটা মেয়ে মানুষ কে পাহাড়া দেয়ার মতো ওই রকম সমর্থবান পুরুষ বাড়িতে কেউ ছিলো না।

কপালগুণে আমরা ক্যাম্পাস এলাকায় বড় হয়েছি। ওই জন্য পড়াশোনাটা শেষ করতে পেরেছি। না হলে প্রত্যেকটা বোনকে আব্বা এসএসসির পর বিয়ে দিতে বাধ্য হতেন, এত কোনো সন্দেহ নাই। আমাদের জীবনটা অনেকটা বাংলা সিনেমার পরিবারগুলোর মতো। নিন্ম মধ্যবিত্ত ঘরের অনেকগুলো মেধাবী মুখ। এই রকম আরকি। সে যাই হোক। এতগুলো কথা বললাম কারণ সামাজিক ভাবে মেয়ে হিসেবে আমরা যে খুব ভালরানেবল ছিলাম সেইটা বলার জন্য। প্রথম ভালরানেবিলিটি আমি মেয়ে, দুই নাম্বার এক পরিবারে ছয়টা মেয়ে, তিন নাম্বার পরিবারে পাহারা দেয়ার মতো কোনো পুরুষ মানুষ নাই, চার নাম্বার বাপের টাকা বা ক্ষমতা কোনটাই নাই। কাজেই আমি বড় হয়েছি এরকম কঠিন চারটা ভালনারেবিলিটি সাথে নিয়ে। আমার পশ্চাদ দেশে প্রথম হাত পরে দশ বছর বয়সে আমি তখন ক্লাস ফাইভে পরি। সেই লোক তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরে। এই শয়তানের জালায় খেলতে যেতে পারতাম না। যখনই তাদের ইউনিট ক্রস করতাম ধাপ করে দরজা খুলে পশ্চাদ দেশে জোরে চড় লাগাতো।

আমি আমার বড় বোনদেরকে বললাম। কিছুই হলো না। বললো ওই বাজে ছেলেটা থেকে দুরে থাকো। দূরে থাকা মানে নীচে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। অথচ এরে ডাকি মামা। নীচে যাওয়া বন্ধ। ছাদে যাই পাশের বিল্ডিং এ আরেক বদমাইশ আক্ষরিক অর্থেই একটু নিরিবিলি দেখলে লুংগী খুলে দাঁড়িয়ে থাকতো।

আমার চারপাশেই কম করে পাচঁটা রেডিমেট বদমাইশ ছিলো যারা গায়ে হাত দেয়ার জন্য সবসময় রেডি থাকতো। অথচ সামাজিক ভাবে এদের বলতাম মামা, চাচা, ভাই বা বন্ধু। আমি নাম ধরে বলতে পারতাম। বললাম না। বললাম না এদের পরিবারের কথা চিন্তা করে। আমরা মেয়েরা যখন একে অপরকে বলা শুরু করলাম তখন দেখলাম, এই ঘটনাগুলো বেশির ভাগের সাথেই হচ্ছে। যাহা বলিলাম সত্য বলিলাম, সত্য বই মিথ্যা বলি নাই।

যে মেয়েদের সাথে কথা বলেছি তারা প্রত্যেকেই আমার ফেবুতে আছে। তাদের নামও বলতে পারতাম। আথচ আমি বড় হয়েছি বাংলাদেশের অন্যতম কালচারড, শিক্ষিত এলাকায়। যাদের কথা বললাম এরা প্রত্যেকেই শিক্ষিত। যিনি লুংগী তুলে ছাদে দাড়িয়ে থাকতেন তিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এখন ধারনা করেন বাংলাদেশের গ্রামে বা মফস্বলে আসলে কি হয়! এই যে আমি প্রকাশ্যে কথাগুলো বললাম সাথে সাথে আমি খারাপ হয়ে গেলাম। আমার কথা বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাপ কাঠিতে মাপা শুরু হয়ে গেলো। কিন্তু যিনি আমার পশ্চাদদেশে নিয়মিত হাত দেয়ার চেষ্টা করতেন এবং হাত দিতেন অনেকেই জানতো এই ছেলেটা এই কাজ অনেকের সাথে করে কিন্তু কেউ তাকে খারাপের বলেনি। আশে পাশে দেখে সব সময় এইটাই মনে হয়েছে ছেলেদের একটু আধটু এই সব অভ্যাস থাকে এইটাকে সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নাই। আমাদের মেয়েরা বড় হবে যৌন নিপীড়ন কে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিয়ে। এইটাই স্বাভাবিক যে আমাদের মেয়েদের নারী হয়ে ওঠার পথে প্রথম অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতা হবে পিরিচিত কোনো পুরুষের যৌন নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে। এবং নারী হয়ে ওঠার প্রধান দক্ষতা হবে স্পিকটি নট করে বসে থাকা। যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদের প্রথম ধাপ শাউট! একটা চিৎকার করেন। তারপর দেখা যাবে। দ্বিতীয় ধাপ আপনি যদি মেয়ে হন আপনার সামনে এরকম ঘটনা ঘটলে বিনা বাক্যব্যায়ে মেয়েটির পাশে দাড়ান। যৌন নিপীড়ন এর বিরুদ্ধে কথা বলেন, কথা বলেন, কথা বলেন।

1913 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।