আঞ্জুমান রোজী

লেখক

জীবনের চরাচরে

দিনের শুরুতে সূর্যতাপের অতিমাত্রাটা বেশ বুঝা যাচ্ছে। ক'দিন ধরেই গরমের দাহে জনজীবন অতিষ্ট হয়ে আছে। মানুষের জীবিকার তাড়নায় চারদিকে রৌদ্রস্নাত দিন জেগে উঠছে। রাস্তায় বের হলেই দেখা যায় জীবনের গতি। কতটা গতি নিয়ে  মানুষ  ছুটে চলে তা রাস্তার মানুষের গতিবিধিতে বেশ বুঝা যায়। একখন্ড পোড়োজমির মতো স্বপ্নজীবন নিয়ে প্রতিনিয়ত শুধু ছুটে চলা। এই ছুটে চলার দৃশ্য দেখতেও এক ধরনের নেশা কাজ করে । ছুটির দিনে যখনই সময় পায় তখনই জানালায় না হয় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে প্রতিমা প্রায়ই বুদ হয়ে চেয়ে থাকে মানুষের ছুটে চলা্র দিকে। প্র্তিমাও ছুটছে এই মানুষের সাথে। কিসের নেশায়, কি পাওয়ার আশায় ছুটছে তা প্রতিমা জানে না। জানে না ঐ মানুষগুলিও। কেমন এক অন্ধ-ছুটে চলা!

নিয়ম করে প্রতিদিন সকালে কাজে যেতে হয়। আজও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। কাজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গ্রীষ্মের এক কোমল সকালে এলোমেলো অনুভূতি নিয়ে প্রতিমা হাঁটতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এসেছে। মাঝে মাঝে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কখনো বরফে পা গলিয়ে দিয়ে কাজে যায় প্রতিমা। যেদিন হাঁটতে খুব ইচ্ছে করে সেদিন আর গাড়ি গ্যারেজ থেকে বের করে না। পায়ে হেঁটে বেশ কিছুদুর এগিয়ে  গিয়ে বাসে চড়ে কাজে যায়। আবার কাজ থেকে ফিরে আসার সময়েও ঠিক একই কাজ করে। আজ ইচ্ছে করে গাড়িটা গ্যারেজ থেকে বের করে নি। কিছু সময় নিজের মতো করে পেতে চায় বলেই এমন করে প্রতিমা। কাজে যাওয়া আসার দু’ঘন্টা সময় তার একান্ত নিজের। ঠিক তখনই ভাবনাগুলো নিশ্চিন্তে চড়ে বসে। একলা চলার এ এক মহা যন্ত্রণা। পুরোটা অতীত যেন প্রতিমাকে গিলে খেতে চায়, এগিয়ে যাওয়ার সমস্ত শক্তি রহিত হয়ে আসে। তবুও প্রতিমা এগিয়ে যায় নিজ ইচ্ছায়, নিজ উদ্যমে, শুধু মানবিক জীবনযাপনের তাগিদে, জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার সন্ধানে।

প্রশান্তের সাথে সম্পর্কটা  দিনে দিনে খারাপের দিকেই যাচ্ছে। সম্পর্কের টানাপোড়নে  সময়গুলো কেমন বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠছে। প্রশান্তের সাথে সম্পর্ক রক্ষার্থে মন, বিবেক, শরীর; বলতে গেলে প্রতিমার পুরো অস্তিত্ব এখন চরম প্রতিবাদী হয়ে উঠছে। এমন অপমানের, এমন ধিক্কার জীবন প্রতিমা আর চায় না। মাঝে মাঝে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে চলে যেতে ইচ্ছে করে এই নশ্বর পৃথিবী থেকে। কিন্তু মৃত্যুতেই যে সব সমস্যার সমাধান নয় তা প্রতিমা বেশ বুঝতে পারে; তাই তো জীবনের প্রতিটা বাঁকেবাঁকে খুঁজে ফিরছে জীবন নামের রহস্যময়তাকে। এ রহস্য যেন বেঁচে থাকার এক আলোকবর্তিকা, শুধু টেনে নিয়ে যায়, টেনে নিয়ে যায় কোনো এক সুদূরে!

কেনো জানি আজকাল কোনো কিছুই স্বাভাবিকভাবে নিতে চায় না প্রশান্ত। সব কিছুতে তেড়ে বেগে উঠে জবাব দেওয়াটাই তার স্বভাবে পরিণত হচ্ছে। সেটা ইচ্ছাকৃত নাকি অনিচ্ছাকৃত বুঝাটাও এ্কটা বিপদে দাঁড়িয়েছে। কোনোকিছু জিজ্ঞাসা করলে মাথার উপর খড়গ ঝুলতে থাকে আবার না জিজ্ঞাসা করে চুপচাপ থাকলে সেখানেও মহা বিপদ। তখন প্রতিমাকে নিয়ে প্রশান্তের ভাবনা চলতে থাকে অন্যখাতে। নিশ্চয় প্রতিমা অন্যকিছু বা অন্য কাউকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। প্রশান্তের প্রতি প্রতিমার এমন নির্জীবতায় সন্দেহের বিষক্রিয়ায় ঘনীভূত হতে হতে  সংসার জীবনে জ্বলতে থাকে অশান্তির আগুন। প্রতিমার হয়েছে শাখের করাত, আসতেও কাটে যেতেও কাটে। কো্নো উপায়ন্তর না পেয়ে প্রতিমা আজকাল পূর্ণ নীরবতা পালন পালন করে যায়। এই নীরবতাই এখন প্রতিমার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবনের উপর এত ঝড় বয়ে যাচ্ছে যে আর যেনো টাল সামলাতে পারছে না। সারাক্ষণ মাথায় চেপে থাকে রাজ্যের যত দুঃশ্চিন্তা। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেজে উঠলো। অপর প্রান্তে গুরু গম্ভীর এক পুরুষ কন্ঠ শুনতে পেলো প্রতিমা।

-হ্যালো!

-হ্যালো, আমি অমল বলছি।

- অমল! কি খবর? এই সাত সকালে ফোন কল! সব ঠিকঠাক আছে তো?

-হা, সব ঠিক আছে। আপনার কথা খুব মনে পড়ছিলো তাই ফোন করলাম।

-শুনে ধন্য হলাম; কেউ আমার কথা মনে করে! কন্ঠে কৃত্রিমতার সুর এনে বললো প্রতিমা।

-আমি  লাঞ্চ টাইমে আবার ফোন করবো। কোনো সমস্যা নেই তো? অপর প্রান্তে উৎসুক কন্ঠ অমলের।

-অবশ্যই করবেন। তবে আমি যদি ফ্রী থাকি, তাহলে কথা হবে।

-ওকে, তাই হবে, ভাল থাকুন। বলেই ফোনটা রেখে দিলো অমল।

অমলকে প্রতিমা চিনে বছর দুই হবে। দেখা হয়েছিল টরেন্টোর বই মেলায়। একই স্টল থেকে বই কিনতে গিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলো দু’জন; কথা হয়েছিলো হুমায়ুন আজাদের লেখা নিয়ে। সেই সময় পরিচয় পর্বে একে অপরের সাথে ফোন নাম্বার আদান প্রদান  করেছিলো। কালেভদ্রে ফোন করে অমল। তাই যখনই অমল ফোন করে প্রতিমা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কন্ঠস্বরটি। প্রাণবন্ত উচ্ছ্বল, চঞ্চল প্রকৃতির অমলের সাথে কথা বলতে প্রতিমার বেশ ভালোই লাগে। এমন গুরু গম্ভীর কণ্ঠে কিছু্টা স্বস্তি, কিছুটা নি;শ্বাস ফেলার আশ্রয় যেনো খুঁজে পায় প্রতিমা। যতটুকু জানে অমল সম্পর্কে, তা হলো, অমল এক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীতে  চাকরী করে। নীরবে নিভৃতে থেকে জীবন পার করছে। এদিকে প্রতিমা ডেন্টাল এসিস্ট্যান্ট হিসাবে ডিপ্লোমা কোর্স করে চাকরি করছে এক ডেন্টাল অফিসে। স্বামী প্রশান্ত একজন ব্যাংকার, আর একমাত্র কন্যা সন্তান অনুষাকে নিয়ে প্রমিতার সংসার জীবন।

কখন যে হাঁটতে হাঁটতে বাসে চড়ে কাজের জায়গায় চলে এসেছে প্রতিমা বুঝতে পারেনি। কাজের মধ্যে ঢুকে যাওয়া মানে পৃথিবী থেকে পুরোদমে আট নয় ঘন্টা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা। দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটানা ব্যস্ততার মধ্যে কখন যে সময় গড়িয়ে যায় বুঝা যায় না। যখন কাজ থেকে বের হয়ে আসে তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। কাজ শেষে প্রতিমা মুঠোফোনটা চেক করে দেখে পাঁচটি মিস কল। যার সব কটাই অমলের নাম্বার থেকে আসা। হঠাৎ করে অমলের কি হলো, এভাবে ফোন করছে কেনো? প্রশ্নটা প্রতিমা নিজেকে নিজে করে। বিষয়টাকে একেবারে পাত্তা না দিয়ে প্রতিমা ঘরে ফিরার জন্যে পা বাড়ালো। ঘরে ফিরে লেগে গেলো সংসারধর্মে। রাতের খাবারের ব্যবস্থা সেই সাথে কন্যা অনুষার তদারকি, টুকটাক কাজ করতে করতে প্রতিমার শরীরের উপর রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করে। রুটিন মাফিক প্রতিদিন সংসারধর্ম পালন করতে গিয়ে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা ধরে যাচ্ছে। তার উপর প্রশান্তের অমানসিক উত্যক্ত আর যেন নিতে পারছে না। সব কাজ শেষ করে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দেয় আরাম কেদারায় আর সেই সাথে লেপটপটা তুলে নেয় কোলের উপর। প্রশান্ত তখনো ঘরে ফিরেনি। এই ফাঁকে ই-মেইলটা চেক করে নেওয়া যাক। ই-মেইলের মাধ্যমেই দূর-দূরান্তের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে প্রতিমা। ই-মেইলের আদান প্রদানেই জেনে নেয় কে কোথায় কিভাবে আছে আর সুখ দঃখের অনুভূতি। অরুন্ধুতির ই-মেইলটা ওপেন করতেই দেখলো একটি কবিতা। অরুন্ধুতি বেশ কবিতা লিখে। সেই ইউনিভার্সিটি লাইফ থেকে দেখে আসছে তার কাব্যচর্চা প্রীতি। যখনই যা লেখে তা সাথে সাথে প্রতিমাকে পাঠিয়ে দেয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রতিমাকে তার মনের অনুভূতি জানাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত অরুন্ধুতি কেমন যেন এক অস্বস্তিতে ভুগতে থাকে। প্রতিমারও বিষয়টা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। একই সিটিতে বসবাস করে প্রতিমা আর অরুন্ধুতি, অথচ দেখা হয় কালেভদ্রে। যোগাযোগটা এই ই-মেইলের মাধ্যমেই বেশী হয়। কবিতা তো নয় যেন এক পরাবাস্তবতা। জীবন ঘনিষ্ট কিছু কথা।

কবিতাটি পড়তে পড়তে দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কবিতার মধ্যে ডুবে গিয়ে দেখতে পেলো কঠিন বাস্তব চিত্রের রূপ। মাতৃত্বেই নারীত্বের পূর্ণতা লাভ করে।  সন্তানদের সুখ দুঃখের আমেজ নিয়ে এক মায়ের অস্তিত্বের প্রকাশ। অরুন্ধুতি হচ্ছে  সেরকম একজন, মাতৃত্বের মোহমায়ায় জড়িয়ে আছে সারাক্ষণ। নিজ মেধাকে বলি দিলো স্বামী সন্তানদের দেখ-ভাল করতে করতে। ভুলে গেলো নিজ সত্তাকে। তারপরেও বুকের ভেতরের আলোড়নকে যখন আর দমন করতে পারে না, তখনই দু’কলম লিখতে বসে যায়। বিদেশ বিভুঁয়ে জীবন সত্যই ভেসে থাকা এক সাবমেরিন জীবন। কোনো কিছুর নিশ্চয়তা নেই এখানে। চড়াই উৎরাই করে জীবন পাড়ি দিতে হচ্ছে। অরুন্ধুতির অবস্থাও করুণ দশা। চারদেয়ালের মাঝে এক বন্দি জীবন। স্বামী, সন্তান, সংসারের ঘানি টানতে টানতে জীবন আজ ফানা-ফানা। অরুন্ধুতির জন্য ভীষন কষ্ট হয়। বুকের ভেতরে টনটনে ব্যাথা অনুভব করতে থাকে। দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ছেড়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকলো। এরই মধ্যে প্রশান্ত ঘরে ফিরে। প্রতিমা উঠে প্রশান্তকে টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো তার খাওয়া শেষ হওয়ার জন্য। প্রতিদিনের মতোই ভারিক্কিভাব নিয়ে প্রশান্ত খেতে বসলো। মুখে কোনো কথা নেই। এভাবেই চলছে তাদের দাম্পত্য জীবন গত কয়েক বছর ধরে। প্রতিমা শারিরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক সব দিক থেকে পুরোটাই দিয়ে দিচ্ছে এই সংসারের পিছনে। বলতে গেলে প্রশান্তই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। ভেবেছিলো কানাডাতে আসলে হয়তো প্রশান্তের একটু পরিবর্তন হবে। পরিবর্তন একটুও হয়নি, বরঞ্চ পুরনো ধ্যান ধারণার রক্ষণশীল মানসিকতা যেন আরো গেড়ে বসেছে। খাওয়া শেষ করে প্রশান্ত বিছানায় চলে গেলো একটা বাংলা পেপার হাতে নিয়ে। বাকী কাজ শেষ করে প্রতিমা পরের দিন কাজের যাওয়ার সবরকম প্রস্তুতি সম্পন্ন করে বিছানায় চলে গেলো ঘুমোতে। 

রাতে হঠাৎ এক আর্তচিৎকার প্রতিমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। প্রায়ই গভীর রাতে  এক করুন কান্নার সুর শুনতে পায়। বুঝতে পারে না কোথা থেকে এই কান্নার সুর ভেসে আসে! আজ আর্তচিৎকারের শব্দে প্রতিমা বুঝতে পারছে নীচতলা থেকে ভেসে আসছে এই শব্দ। চারদিকের শুনশান নীরবতায় কান্নার শব্দ যেন আরো সজোরে ভেসে আসছে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে যাচ্ছে আর্ত চিৎকারে। প্রতিমা আর বিছানায় থাকতে পারলো না। হুড়মুড়িয়ে উঠে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। বুঝা যাচ্ছে কেউ একজন প্রহার করছে কোনো এক নারীকে। তাড়াতাড়ি করে ফোনটা হাতে নিয়ে নাইন ওয়ান ওয়ান টিপে জানিয়ে দিলো নীচতলায় বিপর্যয়ের কথা। হাফ এন আওয়ারের মধ্যে পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়ে গেলো, বুঝা গেলো পুলিশ এসেছে। ততক্ষন পর্যন্ত প্রতিমা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিলো ব্যালকনিতে। কখন যে প্রশান্ত এসে প্রতিমার পিছনে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারেনি। আচমকা প্রশান্তের কন্ঠে পিছন ফিরে তাকালো প্রতিমা।

-কি করছো এখানে? প্রশান্ত জিজ্ঞেস করলো ।

-নাইন ওয়ান ওয়ান কল করেছি।

-কেনো? প্রশান্তের চোখেমুখে উদ্বেগ।

-নীচতলায় মারামারি হচ্ছিলো, তাই কোনো দূর্ঘটনা না ঘটে যায় এই ভয়ে কল করে জানিয়ে দিয়েছি।

-তাতে তোমার সমস্যা কি? বেশ রেগে একটু উচ্চস্বরে কথাটা বললো প্রশান্ত। কে কাকে মারবে, কে কার বৌকে মারবে না কি করবে, তাতে তোমার সমস্যা কী? 

-মারামারি করছে নাকি মানুষ মেরে ফেলছে, আমি তা শুনে চুপ করে বসে থাকবো! তুমি থাকতে পারো আমি পারি না। কথা ক’টা বলেই হুড়মুড়িয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে গেলো প্রতিমা।  প্রশান্তও প্রতিমার পেছন পেছন ঘরের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বললো—ঐ বেটা তার বৌকে মারছে, আমি তাদের চিনি, বৌ ভাল মানুষ হলে কি আর মারতো!

-কী! কি বললে! রগরগা চোখে কড়মড়িয়ে বললো প্রতিমা, আমিও তোমার কাছে খারাপ মানুষ; তো এখন কি করবে! রাগে কাঁপতে কাঁপতে দাঁত মুখ খিঁচে কথা কটা বলে একটু নিঃশ্বাস নিয়ে আবার বললো,- খবরদার, এ জাতীয় কথা আমার সাথে কখখনো বলবে না, বলে দিচ্ছি। মেজাজ ঝাঁকিয়ে পেছন ফিরে  আবার বিছানায় চলে গেলো প্রতিমা। কিন্তু প্রশান্ত আর এলো না বিছানায়। লিভিং রুমে সোফায় শুঁয়ে রাতটা পার করে দিলো ঠিকই কিন্তু মেজাজটা তেতে আছে নাই্নটি ডিগ্রি। প্রতিমাও আর চোখের পাতা এক করতে পারলো না। রাজ্যের অস্থিরতা ঘিরে আছে প্রতিমার চারদিকে।  প্রশান্তের নারী বিষয়ক চিন্তাভাবনাগুলোকে প্রতিমা আর সহ্য করতে পারছে না। প্রাশান্ত যে কি চায় তা প্রতিমা জানে। বাধ্যগত, নিবেদিত প্রাণের বৌ হবে প্রতিমা, এটাই ছিলো প্রশান্তের চাওয়া । কিন্তু হলো হীতে বিপিরীত। শিক্ষিত মার্জিত রুচির প্রশান্ত চলনে বলনে প্রগতিবাদের খই ফোটায় যদিও, কিন্তু চিন্তা চেতনায় পুরোটাই রক্ষণশীল। বিশেষ করে নারীদের নিয়ে তার ধারণা সেই প্রাগৈতিহাসিক। প্রতিমা প্রশান্তের চিন্তা চেতনার বিষয়গুলো বুঝতে শুরু করে বিয়ের পর। বিয়ের আগে প্রশান্তের কথার ফুলঝুরিতে পুরোটাই মুগ্ধ হয়ে থাকতো। কখনই ভাবেনি, বিয়ের পর সে অন্য এক রূপের মানুষ হবে। আর এদিকে প্রতিমা নিজস্ব চিন্তাভবানার মূল্য দিয়ে  নিজের মতো করে পথ চলে আসছে। স্বাধীন ইচ্ছায় চলার জন্যে প্রতিমা নিজেকে প্রতিটি মুহূর্তে রচনা করে। নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছার মূল্য দিতে গিয়ে জীবনে অনেক কিছুই হারিয়েছে বটে কিন্তু কখনো ভেঙ্গে পরেনি।

বিছানা থেকে আড়-মড়িয়ে উঠে কাজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলো প্রতিমা। এরই মধ্যে আরো একটি বিপত্তি ঘটলো। প্রতিমার ফোনে রিং টোন বেজে উঠতেই রাকিবের কান খাড়া হয়ে যায়। এত সকালে কে আবার কল করে! কৌতুহলী মনকে দমন করতে পারলো না প্রশান্ত, সোফা থেকে উঠে দৌঁড়ে ফোনটা হাতে তুলে নেয়। শুধু নাম্বার দেখা যাচ্ছে, কোন আইডি নেই, তাই বুঝতে পারলো না কে কল করলো। অনেকটা ক্ষেপেই প্রতিমার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো—কে, তোমাকে এত সকালে ফোন করছে?

প্রতিমাও নির্বিকারভাবে জবাব দিলো, নাম্বার তো আছেই। কল ব্যাক করে দেখো, কে কল করেছে। আবারও পালটা প্রশ্ন করলো প্রশান্ত—তুমি জানো না, কে ফোন করেছে? প্রতিমাও ঠিক আগের মতো খুব স্বাভাবিকভাবে কন্ঠ খাদে এনে বললো—না, চিনি না। কথা যাতে আর না বাড়াতে পারে প্রশান্ত, তাই  তাড়াহুড়ো করে নাকে মুখে কিছু গুজে দিয়ে কাজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাইরে বেরিয়ে আসলো। প্রতিমা জানে আজ রাতে এটা নিয়ে অনেক বড় ঝড় বয়ে যাবে। বাইরে বেরিয়ে এসে অমলকে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করলো বেশ কয়েকবার, কিন্তু অমল ফোন রিসিভ করছে না। প্রতিমা ভাবছে অমলকে বলে দিবে আর যেন কখনো প্রতিমাকে কল না দেয়। অমলের বুঝা উচিৎ প্রতিমা বিবাহিত, তার সংসার আছে। বিষয়টা অমলকে ভাল করে বুঝিয়ে দিতে হবে। এই ভেবে সারা দিন চলে গেলো। অমল আর ফোন করলো না। কি জানি, আবার যদি  ঘরে প্রশান্তের সামনে কল করে বসে! তাহলে বিরাট কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাবে। এই আতঙ্কে প্রতিমার বুক কাঁপছে। তাই কাজ শেষে ঘরে ফিরার পথে আবার প্রতিমা ট্রাই করলো অমলকে ফোন করতে। তিন বারের মাথায় অমল ফোনটা ধরলো। কন্ঠে বিস্ময়ের সুর এনে জিজ্ঞেস করলো, আপনি?

-আপনাকে আমার দরকার ছিলো বলেই ফোন করছি বারবার।

-কি ব্যাপার বলুন। অমলের কন্ঠে এক ধরণের শীতলতা ভর করে। প্রতিমা অবাক হয়ে ভাবে এই কি সেই অমল। যার সাথে কথা বললে শত সহস্র পাখা মেলে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে, যার কথায় খুঁজতে থাকে মনের নির্ভরতা!

প্রতিমা খুব নরম স্বরে বললো, সকালে আপনার ফোনে আমার সংসারে আগুন জ্বলছে।

-ওহ! সরি।

-প্লিজ আমাকে আর এভাবে কল করবেন না। মিনতির সুরে কথাটা বলে প্রতিমা অপেক্ষা করতে লাগলো অমল কি বলে।

-ঠিক আছে আমি আর কখনো কল করবো না। বলেই ফোনটা হ্যাঙ্ক করে দিলো।

বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ে প্রতিমা। অমলের নির্লিপ্ততায় হতভম্ব হয়ে যায়। বুকের ভেতর ভেঙ্গেচুরে  চুরমার হয়ে যাচ্ছে। এ কেমন বিচিত্র পৃথিবী! আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে প্রতিমা ঘরে ফিরে আসে। মাথাটাও ঘুরছে বেশ। ঘরে এসে দেখে প্রশান্ত তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে। প্রতিমা কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হওয়ার জন্যে। রাতে খাবার সময়ে প্রশান্ত উচ্চবাচ্য করে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে বসলো। সকালের সেই ফোন কলটা নিয়ে প্রশান্তের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিমাকে যতই জিজ্ঞেস করছে ততই সে পিছ পা হচ্ছে। এভাবে চলতে চলতে প্রশান্ত মধ্যরাতে আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না। হঠাৎ করে প্রতিমার উপর ঝাপিয়ে পড়ে ইচ্ছে মতো প্রহার করতে লাগলো। এলো পাথারি কিল ঘুষিতে প্রতিমার কপাল ফেটে রক্ত ঝরতে লাগলো। তাৎক্ষণিক  ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিমা চিন্তা করলো। পরেই আবার চিন্তা করলো, চলে গেলে অনুষার কি হবে! অনুষা তো মা’কে ছাড়া থাকতে পারবে না। এমন অবস্থায় প্রতিমাও নিজেকে সামাল দিতে না পেরে নাইন ওয়ান ওয়ান কল করে দিতেই সাথেসাথে পুলিশ এসে প্রশান্তকে ধরে নিয়ে গেলো। প্রতিমা কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থেকে অনুষার কাছে ছুটে গেলো। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো। অনুষা জানে মা’য়ের এই কান্নার কারণ। তাই কোনো কথা না বলে চুপচাপ মা’য়ের বুকে লেপ্টে থাকলো। প্রতিমা তখনই মন স্থির করলো, যা আছে ভাগ্যে; এখন থেকে শুধু একলা জীবনযাপন। আর কোনো ঝড়-ঝঞ্চা নয়, এক নিরবচ্ছিন্ন জীবন চায় প্রতিমা।

তিনদিন পর  সকালে খবর এলো। জেল কাষ্টিডিতে প্রশান্ত আত্মহত্যা করেছে। এই সংবাদে প্রতিমা স্তব্ধ হয়ে যায়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এ কেমন পরিণতি! এমন তো চায়নি প্রতিমা! চারদিকে শূন্যতার গহ্বর। সেখানে তলিয়ে যেতে যেতে  লক্ষ্য করে, তার  নিঃশ্বাস থেকে অক্সিজেন খসেখসে পড়ছে। বিষাক্ত শ্বাসে ভারী হয়ে আছে দিনরাত্রি। দিনের সূর্য ক্লান্তিতে নুঁয়ে তীব্র দাহে পুড়ায় স্বপ্নের বালুচর।  বিভ্রান্তিতে টানটান প্রতিটা সময়। তারপরেও প্রতিমা জানে তাকে এগিয়ে যেতে হবে; যেতে হবে নাগরিক জীবনের নিয়ম আর সময়সূত্র ধরে !

প্রতিমা পা ফেলে কঠিন জীবনের চরে, যদি নতুন সূর্যোদয়ে জেগে উঠে নতুন কোন বর্ণীল আখ্যান।

4379 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।