ফরিদ আহমেদ

লেখক, অনুবাদক, দেশে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। দীর্ঘ সময় মুক্তমনা ব্লগের মডারেশনের সাথে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের অনুবাদ করেছেন। বর্তমানে ক্যানাডা রেভেন্যু এজেন্সিতে কর্মরত অবস্থায় আছেন। টরন্টোতে বসবাস করেন।

জীবনানন্দ দাশের প্রথম কবিতা

ছাপার হরফে জীবনানন্দের প্রথম কবিতা কোনটি? এর উত্তর আসলে কেউ জানে না। কারণ হচ্ছে, খুব সম্ভবত জীবনানন্দের প্রথম দিকের সব কবিতাই ছাপা হয়েছে মূলত 'ব্রহ্মবাদী' পত্রিকায়। তারপরেও কেনো কেউ জানে না, সেটা বলছি।

'ব্রহ্মবাদী' পত্রিকার জন্ম বাংলা ১৩০৭ সালে অর্থাৎ ইংরেজি ১৯০১ সালে। এটা জীবনানন্দ দাশের জন্মের দুই বছর পরের ঘটনা। বরিশাল শহরের ব্রাহ্মরা এই পত্রিকা বের করে। ধর্ম, নীতি, শিক্ষা, সমাজতত্ত্ব এগুলো ছিলো এই পত্রিকার আলোচ্য বিষয়। এই পত্রিকার প্রথম দিকের সম্পাদক ছিলেন জীবনানন্দ দাশের বাবা সত্যানন্দ দাসগুপ্ত। পরে যদিও তিনি আর সম্পাদনার সাথে জড়িত ছিলেন না, তবুও এই পত্রিকা অনেকটা জীবনানন্দ দাশদের পারিবারিক পত্রিকার মতোই ছিলো। তাঁর মা কুসুমকুমারী দেবীও এখানে কবিতা লিখতেন। বাবা সত্যানন্দও লিখতেন। জীবনানন্দ দাশের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, এর সম্পাদক ছিলেন তাঁর পিসেমশায় আচার্য মনোমোহন চক্রবর্তী। এই সম্পাদক মহাশয় পত্রিকা প্রেসে থাকার সময়েও তাঁদের বাড়িতে এসে তাঁর মায়ের কাছ থেকে কবিতা লিখিয়ে নিয়ে যেতেন।

কাজেই, এই পত্রিকাতেই যে জীবনানন্দ কবিতার প্রথম প্রকাশ ঘটেছে, এটা নিয়ে সন্দেহ করার অবকাশ খুবই কম। জীবনানন্দের ছোট ভাই অশোকানন্দ জীবনানন্দের একেবারে কৈশোরের একটা কবিতার দুই লাইন মাত্র স্মরণ করতে পেরেছিলেন। সে দুই লাইন এমনঃ

এল বুঝি বৃষ্টি এল
পায়রাগুলো উড়ে যায় কার্নিশের দিকে এলোমেলো।

এই কবিতা কোথাও ছাপা হয়েছিলো কিনা, সে বিষয়ে তিনি অবশ্য কিছু বলেন নি।

বরিশালের মতো দুর্গম্য একটা প্রান্তিক মফস্বল শহর থেকে প্রকাশিত এই পত্রিকা যে, খুব একটা প্রচার পায় নি, এটাই স্বাভাবিক। এর সংখ্যাগুলোও আর পাওয়া যায় না। ফলে, জানা যায় না ঠিক কোন কবিতাটা তাঁর ছাপা হয়েছিলো সবার আগে।

সব অদৃশ্য হয় নি অবশ্য। কয়েকটা মাত্র সংখ্যা দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধায় খুঁজে পেয়েছিলেন কোলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে। এখানেই ব্রহ্মবাদী পত্রিকার ২০শ বর্ষের বৈশাখ সংখ্যায় (বাংলা ১৩২৬, ইংরেজি ১৯২০) 'বর্ষা আবাহন' নামে একটা কবিতা দেখতে পান। কিন্তু, এই কবিতার শেষে লেখকের কোনো নাম ছিলো না। ছিলো শুধু 'শ্রী.." লেখা। স্পষ্টতই এটা ছাপার ভুল নয়। কবি হয়তো নিজের নাম দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন।

এই কবিতাটা যে জীবনানন্দের লেখা, সেটা কখনোই জানা যেতো না, যদি না সৌভাগ্যক্রমে দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধায়ের হাতে একই বর্ষের শেষ সংখ্যা অর্থাৎ চৈত্র সংখ্যা হাতে না পড়তো। চৈত্র সংখ্যায় ব্রহ্মবাদী পত্রিকার সারা বছরের লেখা ও লেখক-লেখিকাদের বাৎসরিক সূচী ছাপা হয়েছিলো। সেখানে বর্ষা আবাহন কবিতার কবির নাম উহ্য রাখা হয় নি আগের মতো। পরিষ্কারভাবে সেখানে লেখা ছিলো জীবনানন্দ দাস, বি.এ.।

এটাই যে ছাপার হরফে জীবনানন্দের প্রথম কবিতা সেটা নিয়ে অসংশয়ী ছিলেন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধায়। শুধু তাই নয়, এই কবিতায় কেনো জীবনানন্দের নাম ছিলো না, সে বিষয়েও একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন তিনি। তিনি তাঁর 'জীবনানন্দঃ জীবন ও কবিতার আলোচনা' বইতে লিখেছেন,

"বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় জীবনানন্দের যে সব প্রকাশিত কবিতা দেখা যায়, তাঁর মধ্যে এই কবিতাটিকেই এখন তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা বলেই মনে হয়। খুব সম্ভব জীবনানন্দ স্বেচ্ছায় ব্রহ্মবাদী-তে এই কবিতাটি লেখেন নি, কারও অনুরোধ বা নির্দেশেই এই কবিতাটি লিখে দিয়েছিলেন। তাই নিজের নাম কবিতার সঙ্গে প্রকাশ করতে দেন নি। এই নাম প্রকাশে তাঁর সংকোচ সম্বন্ধে আমার মনে হয়, যেহেতু ব্রহ্মবাদী ব্রাহ্মদের পত্রিকা এবং জীবনানন্দ নিজে ব্রাহ্ম হলেও ব্রাহ্মদের আচার অনুষ্ঠান, এমন কি সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানই এড়িয়ে চলতে ভালোবাসতেন, সেই জন্যই হয়তো ঐ পত্রিকায় নাম প্রকাশ করতে চান নি।"

কারণ যাই হোক না কেনো, ব্রহ্মবাদী পত্রিকার প্রকাশিত সেই 'বর্ষা-আবাহন' কবিতাটাই জীবনানন্দ দাশের প্রথম মুদ্রিত কবিতা হিসাবে স্বীকৃত হয়ে রয়েছে। আসুন দেখি, সেই কবিতাটা কেমন ছিলো। বাংলা ভাষার একজন সেরা কবির প্রথম ছাপা হওয়া কবিতা দেখতে পাওয়াটাও এক রোমাঞ্চকর ঘটনা।

বর্ষা-আবাহন
জীবনানন্দ দাশ

ওই যে পূর্ব তোরণ-আগে
দীপ্ত-নীলে, শুভ্র রাগে
প্রভাত রবি উঠল জেগে
দিব্য পরশ পেয়ে।

নাই গগনে মেঘের ছায়া
যেন স্বচ্ছ স্বর্গ ছায়া
ভূবনভরা মুক্ত মায়া
মুগ্ধ - হৃদয় চেয়ে।

অতীত নিশি গেছে চলে,
চির-বিদায়-বার্তা ব'লে,
কোন আঁধারের গভীর তলে
রেখে স্মৃতি-লেখা।

এস এস ওগো নবীন,
চলে গেছে জীর্ণ মলিন
আজকে তুমি মৃত্যু-বিহীন
মুক্ত-সীমা-রেখা।

3417 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।