কতকাল ধরে হেটে চলেছি জানিনা, কোথা থেকে হাটা শুরু করেছি তাও মনে পড়ছে না। কতকাল বাংলাদেশকে দেখি না, আমার প্রাণের শহর ঢাকাকে দেখি না! তাইতো হেটেই চলেছি।
আচমকাই একটা শহরের দেখা পেলাম! ওই তো শাহবাগ চত্বর, ওখানেই একসময় উত্তাল গণজাগরণ মঞ্চ ছিল। হ্যাঁ এটাই ঢাকা শহর!! এতো পরিবর্তন! কোথাও জ্যাম নাই, হাউকাউ নাই, মানুষ গুলা ছুটে চলেছে কোন এক নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। মোহাম্মদপুর যেতে ইচ্ছে করছে, কতদিন দেখিনা। কত কত প্রিয়জন, আপনজন ফেলে এসেছি ওখানে। একটা বাসে চড়ে বসলাম, এখানেও চমক! বাসের প্রায় অর্ধেক যাত্রীই নারী। এখন সম্ভবত অফিস টাইম, সবাই কাজে যাচ্ছে। বাসগুলাতে ঠাসাঠাসি নেই আগের মতো! সবাই নিয়ম করে নামছে, উঠছে। রাস্তাগুলা পরিচ্ছন্ন, যত্রতত্র মানুষ রাস্তা পার হচ্ছে না, তাইতো গাড়িগুলাও চলছে নির্বিঘ্নে। মোহাম্মদপুর এসে গেছে,নেমে গেলাম।
খুব অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, আমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। আর আমি সবাইকে দেখতে পাচ্ছি! কতদিনের চেনাপথ তবুও অচেনা লাগছে, আর মানুষ গুলোকে ভীষণ আত্মবিশ্বাসী আর সুখী দেখাচ্ছে! আমি চলে যাওয়ার পর কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে। চলুন দেখে আসি পরিবর্তনটা কি?
বহুতল ভবন গুলাতে নামাজের ঘর থাকে, একটা হলরুমও থাকে, যেখানে ছোটখাটো অনুষ্ঠান করা হতো। সেই হলরুমগুলাকে ডাইনিং রুমে পরিবর্তন করা হয়েছে। এমনকি মধ্যবিত্ত পরিবারগুলাও এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে। এখন আর কোন নারী সকাল হতে রাত অব্ধি কি রান্না করবো, কে কি খায়, সেটা আছে তো সেই চিন্তায় সময় নষ্ট করে না! সেই চিন্তা থেকে তারা মুক্ত। সবাই তিনবেলা ডাইনিং এ খায়, এতে করে কিছু লোকের কাজের সুযোগ হয়েছে। নিজেদের মধ্যে সৌহার্দ বেড়েছে, সবচে বেশি সুবিধা পাচ্ছে বাচ্চাগুলা, খেলাধুলার সাথী পাচ্ছে। আর প্রত্যেকের মন দিয়ে নিজ কাজ করার সুযোগ হয়েছে। আগে তো মহিলাদের জীবন অন্যরকম ছিল।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাচ্চার নাস্তা, টিফিন ও বাচ্চাকে রেডি করে স্কুলে দৌড়াতে হতো। আর বাসার বাকিদের পছন্দমত নাস্তাও টেবিলে রেখে যেতে হতো। আর ফিরেই আবার রান্নার চিন্তা, এ এটা খাবে তো ও ঐটা খাবে না। এই চিন্তায় যখন চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করতো, তখনই মনে পড়তো ঘরগুলা গুছানো হয়নি এখনো! ঘর গোছাতে গোছাতে চোখ যেতো আসবাবপত্রের দিকে, ধূলা জমেছে, শুরু হতো মোছামুছির কাজ। তারপর আবার কাটা বাটা সেরে রান্না, ঘরির কাঁটা জানান দিতো স্কুল থেকে বাচ্চা আনার সময় হয়েছে। তো দাও দৌড়। ফিরে এসে একটু বসবে! ঘরের মেঝের দিকে তাকিয়েছো! এক্ষুণি ঝাড়ু দেয়া, মোছার কাজ শুরু করো। হলো শুরু, তারপর গোসল সেরে, খেয়ে বিশ্রামের কথা ভাবছো! ভুলে যাও, বাচ্চাকে নিয়ে কোচিং এ দৌড়াও। ফিরতে ফিরতে বিকেলের নাস্তা নিয়ে চিন্তা, আর ফিরে যখন নাস্তার ঝামেলা শেষ হতো, বসতে হতো বাচ্চাকে নিয়ে, হোমওয়ার্কগুলা ঠিকঠাক করছে তো! তখনো রান্নাঘর তোমাকে মুক্তি দেয়নি, রাতের খাবার তৈরির চিন্তা মাথায় ঘুরছেই। অবশেষে রাত বারোটা নাগাদ সংসার তোমাকে মুক্তি দিলেও, আরও কিছু কাজ করতে বাধ্য তুমি, ক্লান্তি তোমাকে যতই কাবু করুক না কেন! এসব করেও কিছু নারী বাইরে কাজ করতো, তাদেরকে আমার মনে হতো মা দূর্গা। যেন তাদের দশটা হাত, তাদেরকে দেখলেই জড়িয়ে ধরে আশীর্বাদ করতে ইচ্ছে করতো।
কিন্তু এখন নারী পুরুষ সবাই কাজ করছে বাইরে। কি করে সম্ভব! আমি আর ও খোঁজখবর করতে থাকলাম, যে বাচ্চার কারণে মায়েরা নিজের ক্যারিয়ার ছেড়েছুড়ে সংসার নিয়ে পড়ে থাকতো, সেই বাচ্চাদের জন্য সরকারি তত্ত্বাবধানে প্রতিটি ওয়ার্ডে ডে কেয়ার সেন্টার খুলেছে। স্কুলের শিক্ষকদের বেতন বেড়েছে, তারা আর ক্লাসে ফাঁকি দেয় না। বাচ্চাদের ও কোচিং করতে হয় না। যেহেতু বাবামা উভয়েই কাজ করছে, সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে, বাচ্চারা স্কুলের গাড়িতে করেই আসাযাওয়া করে। আর বাচ্চারা এখন নিজ থেকেই উঠে স্কুলের জন্য রেডি হয়, সপ্তাহান্তে নিজের ঘর নিজে গোছায়, নিজের ময়লা কাপড় নিজে পরিষ্কার করে। ছুটির দিনগুলা হয়ে উঠে উৎসবমুখর। সবাই মিলে ছুটাছুটি করে ঘরের কাজ করতে থাকে। ডাইনিং এ ও থাকে স্পেশাল খাবারের আয়োজন!
যারা নানান কারনে বাইরে যেয়ে কাজ করতে পারছেন না, তারা ঘরে বসে নানান রকম কুটির শিল্পের সাথে জড়িয়ে গেছেন। আর ঘরে বসেই উপার্জন করছেন টাকা।
যাদের বয়স বেড়েছে, ছেলেমেয়ে কেউ কাছে নেই, তারা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক রাখছেন। আর যে দুর্ভাগ্যবশত একা হয়ে গেছেন, উঠে যাচ্ছেন কোন ওল্ড হোমে। এখনকার হোমগুলা বেশ উন্নতমানের।
এবার দেখতে চাই গ্রামের মানুষ গুলা কেমন আছেন, আর যারা দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করতেন তারা কেমন আছেন। কিন্তু একটা শব্দ একটানা বেজেই যাচ্ছে, যেন আমাকে কোথাও ফিরে যাবার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
অবশেষে ঘুম ভাঙে, এলার্ম আমাকে স্বপনের দেশ থেকে বাস্তবে নিয়ে এলো। লাবুকে তুলতে হবে, নাস্তা, টিফিন, আরও কতকি ভাবনা!
আমার স্বপ্নগুলা ছড়িয়ে দিলাম আপনাদের মাঝে। একা তো বাস্তবায়ন সম্ভব না। হাতে হাত রেখে চলুন এগিয়ে যাই।