ঝর্ণা আক্তার

প্রকৃতি, মানুষের সরলতা আর ভালবাসেন মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলতে। মানুষের, যেখানে নারী পুরুষের ভেদাভেদ থাকবে না, থাকবে না কোন বৈষম্য, এমন দিনের স্বপ্ন দেখেন প্রতিনিয়ত।

কনে দেখার কুপ্রথা

আমরা সবাই কমবেশি কেনাবেচার সাথে জড়িত। কেউ ক্রেতা, আবার কেউ বিক্রেতা। ক্রেতা পণ্যটা হাতে নেয়, নেড়েচেড়ে দেখে, পছন্দ ও দামে বনাবনি হলে নিয়ে নেয়, না হলে নেয় না। এতে পণ্যটির কিছু এসে যায় না, তবে বিক্রেতা হয়তো আশাহত হয়।

কিন্তু রমিজ চাচার ক্ষেত্রে ঘটনা এরকম না, অষ্টমবারের মতো আজ তার মেয়েকে বরপক্ষ দেখতে এসেছিল, বরাবরের মতোই প্রচুর খানাপিনার আয়োজন ছিল। বরাবরের মতোই রোজি খুব ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে বরপক্ষের সামনে বসেছিল। যথারীতি তার দাঁত, চুল, পা সব দেখানো হলো। সূরা ফাতিহা পাঠ করতে বলা হলো। রান্নাবান্না করতে পারে কিনা জানতে চাওয়া হলো। অত:পর নাম মাত্র সেলামী দিয়ে চলে গেলো। আর যাওয়ার সময় জানানো হলো --- পরে যোগাযোগ করবো। এখানেই শেষ না, অনেকে পরে যোগাযোগ করে, সাথে থাকে যৌতুকের লিস্ট আর বিয়েতে কি কি খাওয়াতে হবে তার লিস্ট। যার ভার বইতে পারে না রমিজ চাচা , বিয়ে ও হয় না, রোজিকে বার বার বরপক্ষের সামনে বসতে হয়, তারপর কয়েকদিন আর সে ঘর থেকে বের হয় না, মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধে বারবার তাকে মরতে হয়। এই রকম রোজিদের সংখ্যা হাতে গুনা না, গ্রামে গঞ্জে অজস্র।

এবার আসি শহরের মেয়ে, ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে নিতুর কথায়। ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় বাবাকে হারিয়েছে, বড় ভাইটা তখন ক্লাস ফাইভে। অনেক যুদ্ধ করে তার মা তাদেরকে মানুষ করেছে, বড় ছেলেটা পড়াশুনা শেষ না করেই প্রবাসে পাড়ি দিয়েছিল, ভাগ্যের উন্নয়নের জন্য। হ্যা এখন তাদের দিন বদলে গেছে। নিতুরা নিজেদের বিশাল ফ্ল্যাটে থাকে, প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ে। ছোট বেলা থেকেই নিতু হিজাবি, নামাজি। সেই নিতুকেও বরপক্ষের সামনে বসতে হয়, বারবার তার ও মৃত্যু হয়। ওর শেষ ঘটনটা বলি----- ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় আছে, এমন একটি পরিবার নিতুকে দেখতে আসলো। হিজাবি, নামাজি, রাঁধুনি, রূপবতী, গুণবতী নিতুকে দেখে ছেলের মা মুগ্ধ। তার প্রবাসী ছেলেকে ইসলামী লাইনে ধরে রাখার জন্য এমন একটা মেয়েই দরকার। বেশ মোটা অংকের সেলামি দিয়ে, তাকে ছেলের বউ করার আশ্বাস দিয়ে চলে যায় তারা। কিছুদিন পর নিতুর ফেসবুক থাকার অপরাধে তারা তাকে বউ করতে অস্বীকৃতি জানায়।

একবার ভেবেছেন, মেয়েটার কি পরিমান অপমান হলো? আমি তো নিশ্চিত, তারা তাদের ছেলের সম্মতি আদায় করতে পারেনি, তাই নিতুর দোষ খুঁজে বের করেছে। যথেষ্ট হয়েছে না, এবার কি আপনারা থামার চিন্তা করতে পারেন না? মেয়েরাও তো মানুষ, আর কত পণ্যের মতো ব্যবহার করবেন। আপনারা যারা ছেলের বাবা - মা, তারা চাইলেই এই অবস্থা থেকে মুক্তি মেলে।আমরা কনে দেখা নামক কুপ্রথা থেকে বের হয়ে আসতে পারি।

এইভাবে ভাবতে পারি, কনে দেখা না, বরকনে দেখা। প্রথমে গার্জিয়ান পর্যায়ে আলাপ আলোচনা হতে পারে, তারপর বরকনেকে নিরপেক্ষ কোন জায়গায় দেখা করার সুযোগ দেবে, থাকবে না খানাপিনার বিশাল আয়োজন বা সেলামী নামক অপমানের ব্যবস্থা। হতে পারে না??? সারাজীবনই কি মেয়েরা পণ্য সেজে বসে থাকবে। আমাদের সমাজে মেয়েদের নিজ থেকে বর পছন্দ করাও গ্রহণযোগ্য না। খুব অল্প সংখ্যক মেয়ে নিজের বর নিজে পছন্দ করার সুযোগ পায়।

আর হ্যা, এই চাওয়াটা আমাদের মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের জন্য। আসুন না, কনে দেখা নামক কুপ্রথা থেকে আমরা বের হয়ে আসি। মেয়েদেরকে মানুষের সম্মান দেই। কন্যাসন্তান জন্মের সাথে সাথে বাবামায়ের দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে, তার নানাবিধ নিরাপত্তা অভাব, তাকে পাত্রস্থ করার চিন্তা চলতেই থাকে । আমরা সবাই মিলে সমাজের পরিবর্তন আনতেই পারি। সকলের সহযোগিতা কাম্য।

2182 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।