ঝর্ণা আক্তার

প্রকৃতি, মানুষের সরলতা আর ভালবাসেন মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলতে। মানুষের, যেখানে নারী পুরুষের ভেদাভেদ থাকবে না, থাকবে না কোন বৈষম্য, এমন দিনের স্বপ্ন দেখেন প্রতিনিয়ত।

যৌতুক ও দেনমোহর

দুইটাই নারীর গলার ফাঁস। অনেক খুঁজাখুঁজি করে, অবশেষে পাত্রপক্ষ হয়তো পাত্রী খুঁজে পেলেন। তারপর তারা পাত্রীর বাবার আর্থিক অবস্থার চুলচেরা বিশ্লেষণে নামেন। তাদের চাহিদা মতো সব পাবেন তো! সরাসরি না চাইলেও কৌশলে নিজেদের চাওয়াগুলা কনে পক্ষকে জানাতে থাকেন। বেচারা কন্যা দায়গ্রস্থ পিতা, জমি বিক্রি করে, কখনো কখনো হালের বলদ বিক্রি করে মেয়েকে বিদায় করার জন্য তৈরি হতে থাকেন। কখনো কখনো ধারদেনার ও আশ্রয় নেন। কখনো সরাসরি, কখনো ইঙ্গিতের মাধ্যমে লেনদেনের আলোচনা চলতে থাকে। 

তো বিয়েতে দেনমোহর নামক একটা ব্যাপার আছে, যা ইসলাম কনেকে দিয়েছে। সেই ব্যাপারটা কনে পক্ষ কখনো কখনো মৃদু স্বরে আওয়াজ তুলে থাকেন। তাও মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত সেই সাহস ও পান না। আমার নিজের বিয়েতেও দেনমোহর বা বিয়ে রেজেস্ট্রি হয় নাই। কবুল কবুল ধরণের বিয়ে হয়েছে। আমরা দীর্ঘ বত্রিশ বছর একসাথে আছি। একসময় এটা নিয়ে আমার মধ্যেও ক্ষোভ ছিলো। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এটাও বুঝেছি, ওটা কোনো দরকারি জিনিসই না। যে দেনমোহর মেয়ের নিরাপত্তার জন্য ধার্য করা হয়, তা কখনো কখনো জীবন হরণকারী ও হয়ে উঠে। কিন্তু তবুও এই প্রথাটা যৌতুকের মতোই বহাল তবিয়তে আছে। দুইটা কারণে-

এক ইসলামি আইন, আর দুই, মেয়ের নিরাপত্তা। 

যে দেশের মেয়েদের তালাক দিতে কোনো কারণই লাগে না, গরুর বাছুর মারা যাওয়া, বাড়িতে ফিরে যথা সময়ে খাবার না পাওয়া, কিংবা নিজে কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে, কিংবা যৌতুকের দাবিতে মেয়েদেরকে যখন তখন তালাক দেয়া হয়। সেখানে দেনমোহর বিয়েটাকে ধরে রাখার বা আটকে রাখার একটা চেষ্টা মাত্র। কিন্তু আমি তো দেখেছি, এতে করে পারিবারিক হিংস্রতা আরও বেড়ে যায়! শেষ পর্যন্ত মেয়েটাকে জীবন দিয়ে দেনমোহর থেকে মুক্তি পেতে হয়। ইসলামী রীতি যদি রাখতেই হয়, দেনমোহর এক টাকা বা কোটি টাকা, কি এসে যায় হোক না তা এক টাকার! এটা একান্তই আমার মত, এটা বুঝতেও আমাকে জীবনের বড় একটা অংশ পার করে আসতে হয়েছে।

অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন না, জানি। খুব কাছ থেকে কিছু পরিবারকে দেখেছি। স্বামী স্ত্রীর বনাবনি হচ্ছে না, তারা একসাথে থাকতে চাচ্ছে না। কিন্তু মেয়েটা ডিভোর্স দিচ্ছে না দেনমোহরের টাকা আদায় করতে পারবে না বলে, আর ছেলেটা ডিভোর্স করছে না দেনমোহরের টাকা দিতে হবে বলে। দুই জনার মধ্যে তিক্ততা ও ঘৃণা বাড়তে থাকে। ঝগড়াঝাঁটি, হাতাহাতি চলতে থাকে আর এইভাবে কোনো একসময় মেয়েটি খুন হয়ে পড়ে থাকে।

দেখলেন তো দেনমোহরের সুফল! আর যৌতুকের জন্য যে কত প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে তাতো আমরা সবাই জানি। তবে আজকাল কিছুটা পরিবর্তন এসেছে, স্বনির্ভর মেয়েগুলা দেনমোহরের তোয়াক্কা না করে বেরিয়ে আসে সংসার নামক নরক থেকে। কিন্তু তা আর কয়জন? বাবা মায়ের সাপোর্ট ও পায় না অনেক মেয়ে। তারা এতো টাকা পয়সা খরচ করে, সমাজকে সাক্ষী রেখে, মোটা অংকের যৌতুক দিয়ে যে বিয়ে দিয়েছেন, তা কিছুতেই ভাঙতে দিতে চান না। 

আহারে যৌতুক, আহারে দেনমোহর! দুইটাই নারীর গলার ফাঁস! 

আসুন না, একটু অন্যভাবে চিন্তা করি। যে টাকা দিয়ে মেয়েকে বিয়ে দেবেন বলে সঞ্চয় করছেন, তা দিয়ে ওকে লেখাপড়া শেখান। মেয়ে লেখাপড়ায় ভাল না পাশ  টাশ করতে পারে না! কারিগরি শিক্ষা দিন, কোথাও না কোথাও ওর প্রতিভা লুকিয়ে আছে, খুঁজে বের করুন। একসময় এই মেয়েই হয়তো বড় একজন ব্যবসায়ী বা শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। না হয় মাঝারি বা ছোট কোনো ব্যবসায়ী। তবুও তো সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকবে! আত্মবিশ্বাসী হয়ে বেড়ে উঠবে। আমি কিন্তু বিয়েকে অস্বীকার করছি না। বিয়ের পরও যেন মেয়েটার আত্মা মরে না যায়, আত্মবিশ্বাসী হয়ে এগিয়ে যেতে পারে, তা নিয়ে ভাববার সময় এখনি। বিয়েতে খরচ কমানো কোনো ব্যাপারই না। এত খরচ, এত ঢাকঢোল, এতো সামাজিকতা আপনার কন্যাকে তার সংসারের ঝড় থেকে বাঁচাতে পারবে না। আর তাই এসব ঝেড়ে ফেলে মেয়ের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দিন, আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যেতে দিন।

 

2111 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।