জেসমিন চৌধুরী

প্রবাসী, সমাজকর্মী

সম্পর্কের রকমফের হতে পারে, এ নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই

সুমন কর্মকার শাওন এর কল্যাণে তসলিমা নাসরিনের একটা পোস্ট চোখে পড়ল যেখানে তিনি বলেছেন তার একজন প্রেমিক আছে যার সাথে সপ্তাহে মাত্র দুই/তিন ঘন্টা সময় কাটান। এর বেশি হলেই লোকটাকে তার কাছে ফ্যাশফ্যাশে লাগতে থাকে। তিনি ভেবে পান না স্বামী নামক একটা জিনিষের সাথে একটা মেয়ে বছরের পর বছর কী করে কাটায়। একা থাকার মত আনন্দ আর কিছুতেই নেই।

 

 

তার এই পোস্ট পড়ে তার অন্ধ ভক্তরা সমর্থন দিয়েছেন, বাকিরা ক্ষেপে গিয়েছেন। আমি অবশ্য এতে ক্ষেপে যাওয়ার মত কিছু দেখি না। তার দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা হয়ত বুঝতেও পারি। কিন্তু অন্ধ ভক্তি বস্তুটা আমার মধ্যে অনুপস্থিত বলে তার বক্তব্যে কিছুটা ফাঁকও দেখি। যেসব নারী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি ভালবাসা থেকে সমস্ত জীবন একসাথে কাটান তাদের সম্পর্কের প্রতি এধরনের একটা মন্তব্য অপমানকর হতে পারে, যদিও এতে তাদের কিছু যাবে আসবে না।

যে পুরুষটি 'স্বামীর' ভূমিকা নেয়, তার সাথে একটা দীর্ঘ জীবন কাটানো আসলেও সহজ নয়। আমি নিজে সামাজিক সীমাবদ্ধতার কারণে এমন একজন মানুষের সাথে আত্মার অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় আঠারো বছর কাটিয়েছি বলে বুঝতে পারি একজন নারী কতটা অসহায়ত্ব থেকে এরকম একটা জীবন বাঁচতে বাধ্য হতে পারে। নানান সামাজিক কারণে এধরনের অসহায়ত্ব নিয়ে অনেক পুরুষও অপছন্দের নারীর সাথে জীবন কাটাতে বাধ্য হন।

কিন্তু একটা বিষয় তসলিমা নাসরিন বুঝতে পারেননি বা তার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। আজীবন একজন পুরুষ সংগী মানেই 'স্বামী' নয়। আজীবন একটা মানুষের সাথে থাকা মানেই একটা হাঁসফাঁস করা সম্পর্ক নয়। সম্পর্কের নানান রকম রূপ আছে। একটা সুন্দর সম্পর্কের মধ্যে যেমন মাখামাখি থাকে, তেমনি নিজের মত করে একা হবার সুযোগও থাকে। একটা মানুষের সাথে একসাথে দীর্ঘদিন বাস করার পাশাপাশি নিজের ইচ্ছা এবং প্রয়োজন মত একাও থাকা যেতে পারে।

ভালবাসা ছাড়া একসাথে দুঘণ্টা কাটানোও কষ্টের কিন্তু কারো কারো ভাগ্যে এমন সংগীও জুটে যার সাথে একজন্ম খুব ছোট সময় বলে মনে হয়। এর সন্ধান যে পায়নি তার সাথে রাগ করার কিছু নেই। তাই তসলিমা নাসরিনের এই পোস্ট পড়ে আমার রাগ হয়নি একেবারেই। আমার প্রথম 'স্বামীর' সাথে আঠারো বছর কাটানোর পর একজন ভালবাসবার মত সংগী যদি আমি খুঁজে না পেতাম হয়তো তার মত করে ভাবতাম আমিও।

আমি যার সাথে থাকি সামাজিক শান্তির জন্য তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেও তিনি আমার 'স্বামী' নন বরং এমন একজন সংগী যার সাথে দীর্ঘদিন থাকার পরও এখনো তাকে দেখা মাত্রই আমার দেহ এবং মন একসাথে নেচে ওঠে। প্রতিদিন কাজের কারণে কয়েক ঘন্টার বিরহ আসে, আবার কাজ শেষে ঘরের ফেরার সময় মনে একটা অনাবিল আনন্দ কাজ করে। মানুষটার জন্য রান্না করার আনন্দ, একসাথে বসে খাওয়ার আনন্দ, নাট্যচর্চার আনন্দ, সাহিত্য নিয়ে কথা বলার আনন্দ, হাঁটতে যাওয়ার আনন্দ, আবার নিজের ইচ্ছামত একা একা সময় কাটাতে পারার আনন্দ। ম্যানি ইন ওয়ান- এটা একটা বিরল আনন্দ। এই আনন্দের সন্ধান সবাই না ও পেয়ে থাকতে পারে।

একটা ছোট ঘটনা বলি। গতকাল আমি লিখছিলাম, তিনি ঘর পরিষ্কার করছিলেন। তার যখন একটু সাহায্য দরকার হলো, তিনি আমাকে 'একটু এদিকে আস' বলে ডাকলেন না। বরং কোমল গলায় ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, 'তুমি কি বেশি ব্যস্ত?' শুনেই আমি বুঝলাম তার সাহায্য লাগবে। আবার আজ সকালে কাজে যাওয়ার সময় বললেন, 'কাল দুপুরে যে টোস্টেড স্যান্ডউইচ বানিয়েছিলে, খেতে চমৎকার হয়েছিল। দু'টো বানিয়ে দেয়া যাবে, না কি বেশি কষ্ট হবে?' এভাবে শ্রদ্ধা আর ভালবাসা মিশ্রিত পারস্পরিক সহযোগিতার একটা সম্পর্কে সহজে ক্লান্তি আসতে পারে বলে আমার মনে হয় না।

সবশেষে বলব বিষয়টা দৃষ্টিভঙ্গির, ব্যক্তিত্বের এবং ব্যক্তিগত চাহিদার। যে সম্পর্কে আমি অনাবিল সুখ পাচ্ছি, সেই একই ধরনের সম্পর্কে আরেকজনের হাঁসফাঁস লাগতেই পারে। এসব নিয়ে এতো বিতর্কের কিছু নেই।

8104 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।