জেনিস আক্তার

জেনিস আক্তার একই সাথে কবি, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী এবং প্রকৌশলী ।

না একটা বাক্য, আত্মসম্মানবোধের বাক্য

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে জীবন চলে জীবনের নিয়মে। এই সময়ের মাঝে ঘটে যায় অনেক কিছু যা কখনো মনে রাখি কখনো মনে রাখি না। কখনো অনুভব করি, কখনো করি না। কখনো উপলব্ধি করে নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে ফেলি কিংবা শিক্ষা নিই, কখনো নিই না। এভাবেই চলে সময় আর জীবন। নদীর স্রোতের মতো সময় আর জীবন যেন নদীর পাড়। সময় স্রোত এসে জীবনের পাড়ে লাগে, পরতে পরতে। এখানেই রচিত হয় সময়ের কথকতা ।

কত কিছুই তো ঘটে যায়, কয়টা মনে দাগ কাটে? দাগ কাটার মতো আজকের ঘটনা। অফিসে যাব, বাসার সামনে ঝটলা আর উচ্চবাক্যে চেঁচামেচি। যে বাক্যটা ভেসে আসছে - আপনি নামেন আমি যামু না।

যাবা না মানে? যাইতেই হবে ।

আমি ঘটনা স্থলে। ১ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে। আশাপাশে লোক জমায়েত হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। ১ মিনিটে যা আঁচ করলাম তাতে বুঝা গেলো, একটা রিক্সাওয়ালাকে তিনজন যাত্রী রিক্সা ঠিক করেছে নির্দিষ্ট ভাড়ায় নির্দিষ্ট কোনো দূরত্বে। যে জায়গার কথা বলে ঠিক করা হয়েছে যে ভাড়ায়, ঠিক সেই জায়গায় রিক্সাওয়ালা যাবে ঠিকই কিন্তু রিক্সাওয়ালার নির্দিষ্ট কোনো পথে, কিন্তু রিক্সাওয়ালার নির্দিষ্টপথে গেলে তো যাত্রীর পোষাবে না। ইতিপূর্বে একবার এ নিয়ে রাস্তায় ঝামেলা হয়েছে কথাবার্তায় বুঝা গেলো। যাই হোক যাত্রীর সুবিধা অনুযায়ী পথেই রিক্সাওয়ালা রাজী হয়েছে কিন্তু রিক্সাওয়ালা রাস্তায় ঢুকার পর আমার বাসার সামনে এসে বুঝে গেছে অনেক বেশী পথ যাত্রীর কথা বলা জায়গার তুলনায়। সম্ভবত যাত্রীরা আমার বাসা ছাড়িয়ে আরো ভেতরে যাবে । কিন্তু রিক্সাওয়ালা যাবে না। এ নিয়েই বিতর্ক। কিন্তু যাত্রী এই রিক্সাতেই যাবে ।

তুমি যাবা না মানে? তোমারে আমি যেখানে ঠিক করেছি ঠিক সেখানেই যাবা। আমি তোমারে ৬০ টাকার জায়গায় ৮০ টাকা দেবো যাও।

আমি যামু না, আপনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করছেন এর আগে। আমি যামু না। আপনি এখান পর্যন্ত ভাড়া না দেন সমস্যা নাই, নাইমা যান তাও আমি যামু না ।

দুইজনেই কথা বলে যাচ্ছে, এ কথা ও কথা। দুজনেই উত্তেজিত। আশেপাশের লোকজনও রিক্সাওয়ালাকে জোর করছে যাবার জন্য। রিক্সাওয়ালা রাগে কেঁপে বলছে - না, আমি যাবো না।

আমি দেখলাম একটা না এর মাঝে কি শক্তি, কতটা আত্মসম্মানবোধ, কতটা অহংকার। এ অহংকার যেন ঘামে ভেজা দামে কেনা ।

রিক্সাওয়ালার বয়স ৫০ এর কাছাকাছি, দারিদ্রতার ছাপে শরীরে মেদ নেই তাই ৫০ বয়স হলেও ৫০ বুঝা যায় না খুব খেয়াল না করলে। চোখের ডান-বাম সাইডে চামড়ার কুচকানো ভাব কিন্তু চোখ উজ্জ্বল। কালো রঙ জ্বলে যাওয়া শরীরের ভাঁজে চোখ বেয়ে তার জল গড়িয়ে পড়া। তবুও নির্বিকার বলে যাচ্ছে -আপনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন আমি যামু না, আমি যদি অন্যায় করে থাকি আমাকে জুতা মারেন আপনি, তাও আমি যামু না আপনারে নিয়া।

অনেক লোক জমা হয়ে গেলো। কেউ কথা বলছে না। আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম, অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে। আমি রিক্সার সামনে গেলাম।

যাত্রী হিসেবে একজন শক্ত সামর্থ্য শরীরের অধিকারী ৫০ পার হওয়া মা কিংবা ফুফু-খালা জাতীয় কিছু, একজন ছেলে ৩৮ বছর বয়সী এবং একজন অসুস্থ বাবা ৬৫ এর কাছাকাছি বয়স হবে।
৩৮ বছর কিংবা ৪০ বছরের ছেলেটার সাথেই আমি কথা বললাম। বললাম -শুনুন আপনি অন্য রিক্সায় চলে যান।

বললো আমি অন্য রিক্সায় কেনো যাবো? আমি এই রিক্সাতেই যাব, ও কে আমি ঠিক করেছি ও কেনো যাবে না?

আমার কথার সাথে জোর ধরে তখন ওখানকার অনেকেই বলে উঠল হ্যাঁ হ্যাঁ আপনি অন্য রিক্সায় চলে যান। আমি সাহস পেয়ে গেলাম এই ভেবে যাক আমি অন্যায় কথা বলি নি, সাহসের জোর ধরেই তখন বললাম - ধরলাম আপনার সাথে রিক্সাওয়ালে অন্যায় করেছে, আপনার ক্লাস আর রিক্সাওয়ালার ক্লাস তো এক না। তাই বলে আপনিও রিক্সাওয়ালার মতোই ব্যবহার করবেন? আপনি জেদ করছেন আপনি অন্য রিক্সায় চলে যান।

তখন সে আমাকে বললো- শুনুন আমি একজন ডাক্তার। আমার বাবা অসুস্থ। অসুস্থ ব্যক্তি নিয়ে এখন মাঝ পথে রিক্সা কই পাবো? আমি পাশেই তাকিয়ে দেখলাম খালি রিক্সা আছে। বললাম - খালি রিক্সা অইতো আপনি চলে যান ভাড়া মিটিয়ে ।

সে আমাকে বলে যাচ্ছে - শুনুন আমার কথা, ঘটনা বলি । আমি বললাম আপনার লম্বা কথা শুনার তো আমার সময় নেই, আর শোনার প্রয়োজনও নেই। আমি অনেকক্ষণ ধরেই দেখছি কথা শুনেছি, আমি পাবলিক, কথা শুনেই বুঝতে পারি। আপনি ডাক্তার প্রেসিডেন্ট যাই হোন না কেনো আপনি জেদ করছেন এবং রিক্সাওয়ালার লেভেলে নেমে গেছেন সেটাই এখানে মুখ্য এখন আপনি অন্য রিক্সায় চলে যান।

সে বলে উঠলো - ঘটনা শুনবেন না তো নাক গলাতে এসেছেন কেনো? বললাম আপনি শাউট করছেন পরিবেশ নষ্ট হয়েছে এজন্য ব্যাপারটা মেটাতে আসছি এটা একজন মানুষ কিংবা নাগরিক হিসেবে আমার দায়িত্ব ।

আর কি যেন বলতে চাইলো লোকটা, পেছন থেকে আমার মতো আরো একটা মেয়ে বলে উঠলো -আরে ভাই অনেকক্ষন থেকে দেখতাছি আপনি এখন অন্য রিক্সা ঠিক করে বাসায় যান। আরো কয়েকজন লোক আমাদের কথার সাথে জোর দিয়েই বললো অইতো খালি রিক্সা চলে যান। বুঝলাম ছেলেটার বাবা অনেকটাই অসুস্থ, নড়তে পারে না পর্যন্ত । এই অসুস্থতার সাথে ছেলেটার আবেগ জড়িত সেই সাথে খারাপ ব্যবহার এবং রাগ নিয়ন্ত্রণ না করার প্রবণতা। হয়তো সে খারাপ ব্যবহার করেছিলো সত্য কিন্তু আমার বাসার সামনে এসে জেদ করার আরো একটা কারণ তার বাবার অসুস্থতা।

প্রিয় মানুষের অসুস্থতার জন্য নিজেদের মনের উপর এক ধরনের এক প্রভাব পরে যেখানে আমরা মাঝে মাঝে নিজেরদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, প্রিয় মানুষগুলো আমাদের মনের অনেকটা নিয়ন্ত্রক। ৩৮ বছর বয়সী ব্যক্তিটাও তাই এবং তার মধ্যে ভেতর একটা প্রভাব খাটানোর ব্যাপার কাজ করছে নিচু জাতির প্রতি। ভেবেছে ধমকেই মনে হয় কাজ হয়, কিংবা হুমকি ধামকি। ধমক দিলেই বুঝি নিচু জাতের কিংবা নিচু শ্রেণির কেউ কথা শুনতে বাধ্য। আসলে অনেক কিছুই শুধু ধমক কিংবা হুমকি ধামকিতে হয় না, সুন্দর ব্যবহারই পারে সুন্দর সুখী ব্যবহার নিশ্চিত করে সুখী সম্পর্ক গড়ে তুলতে। লোকটার মাঝেও এক ধরনের উচ্চবিত্তবানের অহংকার কাজ করেছে না থাকলে সে ডাক্তার এই কথাটা আসতো না, সে যে মানুষ এবং মানুষ হিসেবে ব্যবহারের নৈতিকতা কিংবা মূল্যবোধটাই আগে ধরা দিতো।

যাত্রী দুজন রিক্সাওয়ালাকে ৪০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে খালি রিক্সার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ভাড়া ঠিক করার জন্য। আর বলে যাচ্ছে নিজে নিজেই- এখানে পাবলিকের সিম্প্যাথির জন্য রিক্সাওয়ালা জয়ী হলো। আমি মনে মনে বলি - আহা মানুষ তোমার জয় পরাজয় ভাব? তুমি জেতার জন্য কতটা নিচে নেমে যাচ্ছো ভাবছো না?

এদিকে ছেলেটার বাবা একা নামার চেষ্টা। বৃদ্ধ যাত্রীটা পরেই যেতো আমি আর অই রিক্সাওয়ালা ধরে নামালাম। আমি বাবাটাকে নামিয়ে উল্টো হয়ে পথে গিয়ে মা-খালা জাতীয় মহিলার হাত ধরে বললাম আপনাদের রোগীর প্রতি এত যত্ন তাকে ধরছেন না কেনো সে তো হাটতে পারে না, তাকে সাহায্য করুন। আমার কথা শুনে মহিলা হন্তদন্ত হয়ে বৃদ্ধ লোকটার কাছে চলে আসলো। ঘটনার আকস্মিকতায় সম্বিৎ হারিয়ে ফেলেছে হয়তো, মনেও নেই তাদের সাথে একজন রোগী।

লোক সকল বলছে এই রিক্সা আর কথা না, চলে যাও। রিক্সাওয়ালা সামনের দিকে চলে গেলো। জনগন নিশ্চুপ। আর বৃদ্ধ বাবাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে মহিলাটা। ৩৮ বছর বয়সী একজন ছেলে খালি রিক্সাটার দরদাম ঠিক করছে কিংবা লোকেশন চেনাচ্ছে। এবার হয়তো সে ভুল করার পথে না। আর আমি অফিসের পথে। ভাবলাম ১০ মিনিট অফিস দেরী হয়ে যাবে। তবুও চিন্তা করলাম না। পাঞ্চ কার্ডে হয়তো একটু লেইট কাউন্ট হবে কিংবা অফিসের পিসিতে ১০ মিনিট লেইট লগ ইন কাউন্ট হলো তাতে কি? ১০ মিনিট যে ১০ হাজার মেগাওয়াটের মতো শান্তি কিনে দিলো। এ শান্তি যেন মনের মাঝে একটা অনুভূত প্রশান্তির শান্তি। আহা শীতের বিকেলের রোদ এতো নরম কেনো? জীবন এতো সুন্দর কেনো? বেঁচে থাকলেই শুধু বুঝা যায় সময়ের সাথে জীবনের নানা রঙ। দুঃখ কষ্টের সাথে মাঝে মাঝে শীতের বিকেলের হেলে পড়া রোদের অনুভূতি দোলা দেয়। এ শুধু জীবনের জন্যই সম্ভব ।

আমি মনে করি আত্মসম্মান বোধ একটা শক্তি, একটা সাহস। যেখানে না শব্দটা বলাতে পারে। এই আত্মসম্মানবোধকে অনেকে আত্মরতি কিংবা নার্সিসিজম মনে করে। নিজের স্বাধীনতা, নিজের বোধ, নিজের ভাল লাগা প্রাধান্য দেওয়া যদি নার্সিসিজম হয় তাহলে তো প্রত্যেককেই নার্সিসিস্ট হওয়া উচিত। যেমনটা ছিলো তুলসী মালা গলায় কালো রঙের মানুষটার ভেতর। জ্বলে উঠার মতো এক শক্তি দিয়ে বলা বাক্য - আমি যামু না, আপনি নামেন আমার রিক্সা থেকে।

3720 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।