১.
ড্রইং রুমের মধ্যে ঢুকেই থমকে দাঁড়ায় জেসিকা জারিনা সিম্পসন।
'ইট'স হার।' দোভাষী মেয়েটি বলে।
মেয়েটি বলে না দিলেও জেসিকার বুঝতে অসুবিধা হতো না ইনি কে। সোফায় বসে ছিলেন ভদ্রমহিলা। তাদের দু’জনকে দেখে উঠে দাঁড়িয়েছেন। জড়সড় ভঙ্গি তাঁর। ঠিক কী বলবেন বা করবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না যেন। মধ্যবয়েসী নারী তিনি। পরনে মলিন একটা শাড়ি। চেহারাতেও দারিদ্যের ছাপ পড়েছে সুস্পষ্টভাবে। অপুষ্ট শরীর। গাল দুটো বসে গিয়ে চোয়ালের হাড় উঁচু হয়ে উঠেছে। চোখ দুটো আশ্চর্য রকমের শান্ত।
মালতীনগরের এই বাড়িতে সময় যেন থেমে গিয়েছে। ভদ্রমহিলার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জেসিকা। এঁকে খোঁজার জন্য পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে উড়ে এসেছে সে। এই দেশ তার অপরিচিত, এখানকার মানুষজন তার অপরিচিত, ভাষাটাও অচেনা। কিন্তু, এই মানুষটি তার চেনা, অত্যন্ত আপন একজন তার।
এই মানুষটাকে খুঁজে বের করাটা সহজসাধ্য কিছু ছিলো না। রেডক্রসকে কাজে লাগিয়েছিলো সে। তাদেরই সুযোগ ছিলো তাঁকে খুঁজে বের করার। কিন্তু, তারা পারেনি। ব্যর্থ হবার পরে তারা দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয় ঢাকার আমেরিকান এম্বাসিকে। এম্বাসি এই ধরনের কাজ করতে সাধারণত আগ্রহী থাকে না। কিন্তু, কোনো এক অদ্ভুত কারণে তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে তারা। আমেরিকান ফান্ড গ্রহীতা একটা বেসরকারী সংস্থাকে কাজে লাগায় তারা। এরাই শেষ পর্যন্ত বগুড়া থেকে খুঁজে বের করে ভদ্রমহিলাকে। দোভাষী মেয়েটা ওই সংস্থাতেই কাজ করে।
ভদ্রমহিলাকে খুঁজে বের করার পরেও জেসিকার সমস্যা মেটেনি অবশ্য। বেসরকারী সংস্থার বগুড়া শাখার কর্মকর্তারা খুব গোপনে ভদ্রমহিলাকে জেসিকার বিষয়টা জানালেও তিনি জেসিকার সাথে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে অস্বীকৃতি জানান। বহু দিন ধরে করা অনুনয়, বিনয়, কোনো কিছুতেই কাজ হয় না। তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন।
সব কিছু জেনে নিজেই বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত নেয় জেসিকা। এই ভদ্রমহিলার সাথে দেখা না করে থাকাটা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এঁকে কোনোদিন খুঁজে পাওয়া যাবে, সেটাই সে ভাবে নি। আজ যখন খুঁজে পাওয়া গেছে তখন দুনিয়ার এমন কোনো শক্তি নেই যে জেসিকাকে আর থামিয়ে রাখতে পারে।
নিউ জার্সি থেকে একদিন ঢাকায় পা রাখে জেসিকা। বেসরকারী সংস্থাটিই তাকে নিয়ে যায় বগুড়ায়। এরাই আবার যোগাযোগ করে ভদ্রমহিলার সাথে। জেসিকা বগুড়ায়, এই খবরটা শুনে চমকে ওঠেন তিনি। এটা তাঁর জন্য অপ্রত্যাশিত এক সংবাদ, কল্পনারও বাইরের বিষয়। দীর্ঘক্ষণ নীরব থেকে সম্মত হন তার সাথে দেখা করতে। মালতীনগরের এক বাসায় খুব সংগোপনে জেসিকার সাথে তাঁর দেখা হবে পরদিন, এই সিদ্ধান্ত জানানো হয় তাঁকে।
২.
জেসিকার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মনোয়ারা বেগম। এই তাহলে সে। কী সুন্দর সাজপোশাক পরা মেয়েটা। একেবারে পরির মতো দেখতে। এতো সুন্দর দেখতে মানুষ হয়!
মেয়েটা ধীর পায়ে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। মাথাটা ঘুরছে তাঁর। এমন কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। জেসিকা এসে হাত বাড়িয়ে তাঁকে স্পর্শ করতেই টলে ওঠেন তিনি। মাথা ঘুরে পড়েই যেতেন হয়তো। দ্রুত গতি এসে জেসিকা জাপটে ধরে তাঁকে। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো নাড়া খায় মনোয়ারা বেগমের ভঙ্গুর শরীর। হাঁটু ভাঁজ করে মেঝেতে বসে পড়েন তিনি।
৩.
মনোয়ারা বেগমের বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে আছে জেসিকা। দুই হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে সে তাঁকে অদম্য কান্নাটা বের হয়ে যেতেই অভিযোগ জানায় সে।
'তুমি আমার সাথে দেখা করতে চাওনি কেনো মা?'
জেসিকার মাথায় হাত স্নেহের হাত বোলান মনোয়ারা বেগম। দোভাষী জেসিকার অভিযোগ অনুবাদ করে দিলেও কিছু বলেন না তিনি। মেয়ের এই অভিযোগের জবাব তাঁর কাছে নেই। যুদ্ধের পরে তাঁকে যে ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তাতে করে আত্মহত্যা করাটাই উচিত ছিলো তাঁর। পেটের বাচ্চাটার জন্য পারেন নি। অবুঝ বাচ্চাটারতো কোনো দোষ নেই। মা হয়ে তিনি তাঁকে কীভাবে হত্যা করেন? বাচ্চা জন্মের পরেও মানুষের অত্যাচার থেকে রক্ষা পান নি তিনি। বরং অত্যাচার আরো বেড়েছে। তাঁর স্বামী ভালো মানুষ দেখে ঠাঁই দিয়েছিলো তাঁকে। তাঁর মতো বহু মেয়েকেই আত্মহত্যা করতে হয়েছে, নয়তো ভারত কিংবা অন্য কোনো অজানায় হারিয়ে যেতে হয়েছে।
তাঁর স্বামীর তাঁকে নিয়ে তেমন একটা আপত্তি ছিলো না। কিন্তু বাচ্চাটাকে সহ্য করতে পারতো না একেবারেই। পাকিস্তানি জারজ বলে গাল দিতো। চিৎকার, চেঁচামেচি করতো তাকে দেখলেই। পাপের এই ফসলকে দূর করে দেবার জন্য ক্রমাগত চাপ দিয়ে গিয়েছে সে। এই বাচ্চার জন্য তার এবং তাদের পরিবারের কোনো মানসম্মান আর থাকছে না, এটা প্রতিদিনই শুনতে হয়েছে মনোয়ারা বেগমকে। অবশেষে একদিন তাঁর স্বামীই রেডক্রসের খবর এনে দেয়। দুনিয়ার সবাইকে সন্তুষ্ট রাখতে দুধের বাচ্চাকে বিসর্জন দেন তিনি বুকে পাথর বেধে।
জেসিকার চুলে হাত বুলোতে বুলোতে মুখটাকে নিচে নামিয়ে আনেন তিনি। পরম মমতায় তার মাথায় চুমু দিতে থাকেন তিনি।
মায়ের আদরে গলে যেতে থাকে জেসিকা। দুই চোখ বেয়ে নেমে আসতে থাকে অঝোর ধারায়। হাত দিয়ে চোখ মুছতে থাকে সে বার বার।
'ওঙ্কা কর্যা চোখ মুছপার থাকলে চোখ বিষ করবি রে মা।'
মৃদুকণ্ঠে দোভাষী তরুণীটি অনুবাদ করে দেয় মনোয়ারা বেগমের কথা।
মায়ের দিকে তাকিয়ে কান্না ভেজা চোখে হেসে ফেলে জেসিকা।
'আমার চোখ সত্যি ব্যথা করছে মা।'
মায়ের মাথায়, কপালে, চুলে, গালে হাত বুলায় সে।
'এতোদিন পরে তোমার দেখা পেলাম মা। এই দিনটার জন্য কতোকাল যে প্রতীক্ষা করেছি আমি।'
নিঃশব্দে মেয়েকে সজোরে আঁকড়ে ধরেন মনোয়ারা বেগম। 'ভালো থাকিস জরি মা আমার, খুব ভালো থাকিস।' অস্ফুট কণ্ঠে তিনি বলে।
মনোয়ারা বেগমের চোখের কোণ বেয়ে নেমে আসতে থাকে অবিরল অশ্রুধারা। তাঁর এই কলিজার টুকরোকে জন্মের সময়েও যেমন ধরে রাখতে পারেন নি তিনি, আজো তেমন পারবেন না। এটা খুব ভালো করেই জানেন তিনি। জানেন বলেই, যে সামান্য সময়টুকু তাঁর হাতে আছে, সেটাকেই নিংড়ে নিতে চান তিনি পরিপূর্ণভাবে।
নিষ্ঠুর এই পৃথিবীটা তাঁর জন্য নয়।