জাকিয়া সুলতানা মুক্তা

সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

একগামিতা, বহুগামিতা ও স্বাধীনভাবে সঙ্গ- নির্বাচনঃ ভাষা ও সমাজে নারীর প্রেক্ষিত বিবেচনা

পুরুষের জন্য সামাজিক নানান জীবন দর্শনে একাধিক নারীসঙ্গের সামাজিক বৈধতা দেয়া থাকলেও, নারীর ক্ষেত্রে তা সমাজ অনুমোদন করেনি। করেনি সঙ্গ নির্বাচনে নারীর সিদ্ধান্তের গুরুত্ব অনুমোদনও, অথচ পুরুষ এককভাবে কর্তৃত্ব পেয়ে এসেছে স্বাধীনভাবে নারীসঙ্গ নির্বাচনের। এসব ক্ষেত্রে জোর-জবরদস্তি ও প্রতারণা করাতেও পুরুষের পক্ষে সামাজিক প্রচ্ছন্ন অনুমোদন রয়েছে, নারীর জন্য সেই নির্মাণ নেই। সেটা হওয়া উচিৎ কী অনুচিৎ এই আলোচনা ভিন্ন, কিন্তু একের জন্য তা আছে এবং অপরের জন্য তা নেই এটাই বাস্তবতা। এ ব্যাপারে পঁলা দ্যা লা বারের বক্তব্যটি এখানে প্রণিধানযোগ্য, "পুরুষেরাই প্রণয়ন করেছে সমস্ত আইন, তাই তারা পক্ষপাত দেখিয়েছে নিজেদের লিঙ্গের প্রতি, আর বিচারকেরা ঐ সমস্ত বিধিবিধানকে উন্নীত করেছে নীতির স্তরে" (বোভোয়ার, ১৯৪৯: ২২)। ফলে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবন দর্শনের কোনো স্তরেই নারীর বহুগামিতাকে কিংবা এক পুরুষসঙ্গ ত্যাগ করে অন্য পুরুষসঙ্গ বা স্বাধীনভাবে পুরুষসঙ্গ নির্বাচন অনুমোদিত নয়। এর প্রেক্ষিতে নারীর জন্য ঢালাওভাবে সব সমাজের সব ভাষাতেই নানান অসৌজন্যমূলক পুরুষতান্ত্রিক শব্দ প্রচলিত রয়েছে (কোনো কোনো সমাজের ব্যতিক্রমী কিছু উদাহরণ ব্যতীত)। যেমন- বারোভাতারি, বেশ্যা, পতিতা, নষ্টা, ভ্রষ্টা, নটী, ছেনাল, খানকি, রাণ্ডী ইত্যাদি অসভ্য ও অকথ্য শব্দের ব্যবহার ভাষায় রয়েছে। অথচ পুরুষের বেলায় সেই অর্থে তেমন কোনো শব্দের ব্যবহার নেই, যা আছে তা আবার সমাজ মেনে নিয়েছে সমাজের 'চরিত্রহীন' দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। তাই পুরুষের জন্য বরাদ্দ উক্ত অকথ্য শব্দগুলো ভারে ও ধারে, কখনোই নারীর জন্য বহুল ব্যবহৃত অশোভন শব্দগুলোর ধারে-কাছের সমাজমনস্তাত্বিক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে অক্ষম-অপারগ। যদিও তা হওয়া উচিৎ কী অনুচিৎ তা ভিন্ন বিতর্কের বিষয়। কিন্তু এসবের ব্যবহারে নারীর জন্য যে নিপীড়নের দুয়ার প্রশ্বস্ত করে রাখা, তা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। আর এর পেছনে আছে পুরুষতন্ত্রের যাবতীয় ক্ষমতার নির্মাণ, যাকে এক কথায় 'Sexual/Textual Politics' গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে- "The question of sexism is a question of the power relationship between the sexes and this power struggle will of course be part of the context of all utterances under partriarchy"(Toril Moi, 2002: page-156).

এই আলোকে যেকোনো ভাষাকে বিশ্লেষণ করলে লৈঙ্গিক রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্য ব্যাখ্যায়, ভীষণভাবেই পরিলক্ষিত হয় যে ভাষা পুরুষতন্ত্রের অনুগামী, অর্থাৎ পেশীশক্তির কাছে নত। সমাজের নানান বাতাবরণে সৃষ্ট এহেন ভাষার ব্যবহার তাই সমাজে নারীর অসহায়ত্বের সুস্পষ্ট নিদর্শন। এ ব্যাপারে সমাজে নারীর অবস্থান ও তার পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় 'আমি নারী: তিনশ বছরের (১৮-২০ শতক) বাঙালি নারীর ইতিহাস' গ্রন্থে বলা হয়েছে, "নারীকে নিয়ে যারা ব্যবসা করেছে বা বিলাসিতা করেছে তারা সমাজের চোখে কখনোই ঘৃণ্য নয়। সমাজ-পরিবারের ঘৃণা পেয়েছে অসহায় নারীরাই" (মালেকা বেগম ও সৈয়দ আজিজুল হক, ২০০৪: পৃষ্ঠা-৫৭)। নারীকে নিয়ে সমাজের বিলাস ও ব্যবসার নানান মাধ্যম তাই খুব সহজেই পরিলক্ষিত হয়। যেমন এক সময়কার কৌলিণ্য প্রথা, অবরোধপ্রথা, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, বৈধব্যের রীতিপদ্ধতি, দাসপ্রথা ইত্যাদি নানান প্রথায় নারীর জন্য কেবল নিপীড়নমূলক যাপনকেই সমাজ নির্ধারণ করেছে নানান সামাজিক চর্চাগত দর্শনের আলোকে। এটিকে 'নারী'-গ্রন্থে সুসংহত করে ঐতিহাসিকতার আলোকে উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে-

"পৃথিবীর নারীসমাজ এখন প্রধানত পাঁচ ধরনের আইনের অধীনে জীবনদণ্ড ভোগ করছে, যার মাঝে চারটিকে বলা যায় সনাতন, যেগুলোর উৎস ধর্ম: হিন্দু আইন, ইংরেজি সাধারণ আইন [ইংলিশ কমন আইন], রোমান আইন [রোমান ল], ইসলামি আইন [শরিয়া]; আর পঞ্চম ধরনের আইনগুলো প্রণীত হয়েছে এ শতকে, যেগুলো চলছে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে"(হুমায়ুন আজাদ, ২০১২: পৃষ্ঠা ৭০)।

সুতরাং যখনই নারী সামাজিক ও মনস্তাত্বিকভাবে পুরুষের এই নির্মাণকে উপেক্ষা করেছে, তা হোক যৌক্তিক ও ধনাত্মক মনস্তাত্বিক দৃঢ়তায় কিংবা প্রতারণার ঋণাত্মক আশ্রয়ে; উভয়ক্ষেত্রেই নারীকে উপরিউক্ত শাব্দিক সামাজিক শাসনে করায়ত্ত করার পুরুষতান্ত্রিক আগ্রাসন চালানো হয়েছে। যেই ঋণাত্নক প্রচেষ্টায় পুরুষতান্ত্রিক নারী ও পুরুষেরা দলে দলে অংশগ্রহণ করেছে। এই সামাজিক নির্মাণগুলো ভালো কী মন্দ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা মানসিকভাবে সুস্থ ও সচেতন যে কারোর পক্ষেই অনুধাবন করে নেয়া সহজ। বরং এটা বলা যায়, নারী বা পুরুষ তাদের সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে কেউ প্রতারক হয়ে উঠুক এই সমর্থন যেমন দেয়া যায় না; আবার সঙ্গী নির্বাচনে পুরুষের এই একক আধিপত্যের অবসান হওয়াটাও এখন সময়ের দাবি। নারীর স্বাধীনভাবে তার সঙ্গী নির্বাচন ও বর্জনের বিষয়ে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি তাই ধনাত্মক হওয়ার প্রয়োজন। নইলে একই সমাজে পুরুষের জন্য বহুগামিতাকে অনুমোদন দিয়ে, আবার নারীর বহুগামিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হলে তা কখনো না কখনো সময়ের বিদ্রোহের মুখে পড়তে বাধ্য। কারণ বহুগামিতা যেমন পুরুষের জন্য সত্য হতে পারে, তা নারীর জন্যও সত্য হওয়া সম্ভব; একে অস্বীকার করার যৌক্তিক কোনো ভিত্তি নেই, তা পুরুষের জন্য এক পাক্ষিক করার তাই সুযোগও কোনো অর্থে নেই।

সঙ্গী নির্বাচন ও বর্জনের ক্ষেত্রেও নারী ও পুরুষের বেলায় একই কথা প্রযোজ্য। এখানেও থাকা চাই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বৈষম্যহীনতা। উল্লেখ্য সব পুরুষ যেমন বহুগামী কিংবা প্রতারক হয় না, সব নারীও তা হয় না। বহুগামিতা যেমন এক ধরণের প্রবৃত্তি, একগামিতা আরেক ধরনের প্রবৃত্তি। এখানে ভালো-মন্দের বিবেচনা এক ধরনের সামাজিক নির্মাণ বৈ আর কিছুই নয়। তাইতো নারী-পুরুষের মাঝে বহুজনই আছেন, যারা ভীষণভাবেই একগামী অর্থাৎ তারা বহুগামী নয়। এই বিষয়টিকেও গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে। এজন্যই নারী হোক কী পুরুষ, তারা তাদের সঙ্গী নির্বাচনে স্বাধীন হোক। সেটা একগামী হোক কী বহুগামী, যদি তাতে প্রাপ্তবয়স্কের পারস্পরিক অনুমোদন থাকে; তবে সমাজের এখানে মোরাল পুলিশিং করার কোনো কারণ থাকে না। এমনকি নারী বা পুরুষ যদি একে অপরের প্রতি প্রতারণামূলক কোনো ভূমিকা নেয়, এক্ষেত্রেও প্রচলিত আইনে দোষীকে শাস্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে প্রতারণার অভিযোগে। কোনো প্রবৃত্তিগত ভিন্নতার বিচারে নয়, সমাজ যেন এখানে তাই কোনো পক্ষ না নিয়ে নেয়। কারণ তা বাস্তবিক অর্থেই অমানবিক হয়ে দাঁড়ায়। সর্বোপরি সঙ্গী নির্বাচনে নারী ও পুরুষ স্বাধীন হোক, তাতে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কোনো দর্শনতাড়িত পেশীশক্তির প্রভাব না থাকুক। এসব বিষয়ে সমাজে, ভাষায় একপাক্ষিকতা কমে আসুক।

এই আলোচনায় পুরুষ ও নারীর বাইরেও অন্যান্য যেসব লৈঙ্গিক পরিচয়ের মানবপ্রাণ রয়েছে তাদের উল্লেখ না থাকলেও, তাদের জন্যও সমতা আসুক। তারাও সঙ্গী নির্বাচনে স্বাধীন হোক, সমাজের দৃষ্টিতে তারাও পুরুষতান্ত্রিক পেশীশক্তির বলয় থেকে রক্ষা পাক এটাই কাম্য। কারণ পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীর প্রচলিত ব্যাখ্যাগুলোকে বিজ্ঞান এখন বাতিল করে দিয়েছে এবং নির্মিত হয়েছে নতুন বয়ান, যার উল্লেখ আছে ‘Sex and the Emergence of Sexuality’ গ্রন্থে- "Sexual identity is no longer exclusively linked to the anatomical structure of the internal and external genital organs. It is now a matter of impulses, tastes, aptitudes, satisfactions and psychic traits"(Davidson, 1987: 21-2)। তাইতো 'অর্ধেক পৃথিবী' নামক কবিতার ভাষায় বলতে হয়, "ঘাস মাটি বায়ু জল এতদিন পুরুষের ছিলো সমাজ পুরুষ ছিলো, এইবার উভলিঙ্গ হোক" (মল্লিকা সেনগুপ্ত, ২০১৭: পৃষ্ঠা ৩০)।

2011 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।