মহুয়া ভট্টাচার্য

চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী পত্রিকার 'খোলা হাওয়া' পাতায় লেখালেখির শুরু। এবারের বইমেলায় একটি ছোটগল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে। বইয়ের নাম - " মহুয়ার গল্প।"

হাত বাড়িয়ে দাও

আলো থেকে ক্রমাগত আঁধার ঘনিয়ে আসছে যেন নারীর চারপাশে। মানসিক দীনতা, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং মারাত্মক রূপে ধর্মীয় বিশ্বাসের করাল গ্রাসে নারী এখন নিমজ্জিত। জ্ঞান বিজ্ঞান ও অfধুনিকতার এই স্বর্নযুগে নারী একটি দ্বিমুখী বিভক্তির শিকার। এই বিভাজন পুরুষতান্ত্রিকতারই ফসল। আর এই পুরুষতান্ত্রিকতা ধর্মীয় রাজনীতির সৃষ্টি। বিগত কয়েক দশকে আমাদের চেনা সামাজিক জীবনের যে পরবর্তন আমরা লক্ষ্য করছি, তার অধিকাংশই ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সংস্কারের আধিপত্য যার প্রধান শিকার একমাত্র নারী। নারীর ভাগ্য এবং চলাচলের গতি নিয়ন্ত্রণ করছে এখন ধর্মীয় রাজনীতি। মাঝে মাঝে চিরচেনা সমাজের এই আমূল পরিবর্তন দেখে শংকায় বুক কেঁপে ওঠে, এই পরিবর্তন আদৌও কতখানি সুফল বয়ে আনতে পারে! উগ্র ধর্মীয় মতাদর্শ পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রীয় কাঠামোরও নিয়ন্ত্রকের আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে বসে আছে এখন, আর সেই উগ্রতার মহড়া চলছে নারীর ওপর। নারীর ব্যক্তিগত সংবেদনশীলতা এখানে উহ্য। তবে এতকিছুর পরও আশার কথা, আমরা যারা নারীর শহুরে জীবন যাপন ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে তৃণমূল পর্যায়ে প্রান্তিক নারীদের সাথে যোগাযোগ রাখতে সমর্থ হয়েছি তাদের কাছে আজকের এই নারী দিবসটি একটু ভিন্ন মাত্রা যোগ করে।  যখন দেখি মফস্বল ও গ্রামের আত্মপ্রত্যয়ী নারীরা নিজেদের অধিকার আদায়ে সংকল্পবদ্ধ তাদের সেই দৃঢ়তা নারীর অগ্রযাত্রাকে আরো অনেকদূর এগিয়ে দেয়। এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা শত সীমাবদ্ধতাতেও হার মানছেন না এটা যেমন খুব আশার কথা তেমনি তারা অন্য নারীদেরও অগ্রগতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছেন। খুব স্বস্তির বিষয় হলো, গ্রামের অবহেলিত নারী ও শহরের সংগ্রামমুখর নারী সমাজের মধ্যে একটি অদৃশ্য সুন্দর সেতুবন্ধন রচিত হয়েছে। এখন দরকার কেবল এই এগিয়ে চলার পথে হাতটি বাড়িয়ে রাখা।

বিংশ শতকের এই প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং নারীর একাগ্র মনোবল নারীকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছে। নারী আগেও সমাজ ও পরিবারে গুরুত্বপূর্ণ দ্বায়িত্ব পালন করেছে, এখনো করছে কিন্তু মানুষ হিসেবে তার যে মূল্যায়ন - তা সে এখন দাবী করতে শিখেছে। যদিও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা অপসারণ হয়নি একেবারেই, বরঞ্চ নতুন নতুন প্রতিবন্ধকতা প্রতি নিয়ত তৈরি হচ্ছে নারীর এগিয়ে চলার পথে। কিন্তু এই সব আত্মপ্রত্যয়ী সাহসী নারীরা এখন রীতিমতো লড়াই করছেন এই প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে। নারীর অগ্রযাত্রায় এই  প্রত্যন্ত নারীদেরই খুব বেশি গুরুত্ব  দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।

তাদের এগিয়ে আনা, তাদের এগিয়ে আসার পথ সুপ্রশস্থ করার মধ্যেই আজকের নারী দিবসের সার্থকতা। নারীকে সমাজের বেড়িমুক্ত করার একমাত্র উপায় তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। আর এই অর্থনৈতিক স্বাধীনতার রূপটি কেবল অর্থ উপার্জনের স্বাধীনতা নয়, নারীর  উপার্জিত অর্থ নারীর স্ব ইচ্ছায় ব্যয়কেও বোঝায়। শহুরে আধুনিক নারী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দুয়ারে দাঁড়িয়ে যে আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান হতে পারছে, ঠিক একই বলো আরো ব্যাপক হারে প্রান্তিক নারীর দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। প্রান্তিক নারীর অংশগ্রহণ ও সাফল্য ছাড়া এই নারী দিবস অর্থহীন হয়ে যাবে।

নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর এগিয়ে চলা, নারীর পথচলার স্বাধীনতা যা কিছুই আমরা বলি না কেনো সবার আগে দরকার নারীর মানসিক উৎকর্ষতা। নারীরা অনেক এগিয়েছে, নারীর সাফল্যের পাল্লা ভারী হয়েছে কিন্তু মানসিকভাবে নারী কতখানি স্বাবলম্বী হয়েছে তা নিক্তিতে পরিমাপ করার এখনই সময়। নারী দিবস মানে কেবল বেগুনী শাড়ি আর পরিপাটি পরিবেশে বসে বক্তৃতা দেওয়া নয়। আমাদের বুঝতে হবে শহুরে জীবনে নারী যে প্রতিবন্ধকতাগুলোর সম্মুখীন হচ্ছে, তার চেয়ে শতগুণ বেশি প্রতিবন্ধকতা গ্রামাঞ্চলের নারীদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে।  নারীর উন্নয়নে সহায়ক সকল সংগঠনগুলোকে এবং নারী নিজেও এই প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করতে অন্য নারীর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। নারী সংগঠনগুলোকে এই গ্রামীণ জনপদের নারীর প্রহরীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। কারণ, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এখনও নারীবান্ধব হয়ে ওঠেনি, তাই নারীকেই নারীর এগিয়ে চলার হাতটি বাড়িয়ে রাখতে হবে সর্বদা। সবাইকে জানাই নারী দিবসের ভালোবাসা। আমাদের দেশটা নারীবান্ধব হোক। শুভেচ্ছা সকলকে।

1685 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।