সালমা লুনা

ফিজিক্স আর পলিটিক্যাল সাইন্সে মাস্টার্স করেছেন। লেখালিখি করেন শখে। দায়বদ্ধতা অনুভব করেন নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলায়। হোপ সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন নামে একটি এনজিওর প্রেসিডেন্ট তিনি।

নিরবে নিভৃতে নারী নিজেই লড়ে যাচ্ছে সমতার জন্য

নারী দিবস নিয়ে অনেক ভারী ভারী নানান তত্ত্ব দিয়ে তথ্যমূলক লেখা যা এই দিবসকে  আরো সমৃদ্ধ করবে সেসব অনেকেই লিখবেন। আমি ভারী কিছু নয়। বরং সাদাসিধা কিছু লিখি।সাদা চোখে দেখে লেখা।

গ্রামে গিয়েছিলাম। আলুর মৌসুম চলছে৷ আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। ফসলের মাঠে এখন আলু তোলার ধুম। নারীপুরুষ একসাথে আলু তুলছেন। মাঠে মাঠে তুলনামূলক নারী সংখ্যারই আধিক্য। জিজ্ঞেস করে জানলাম নারী পুরুষের মজুরি সমান। সমান মজুরি না হলে নারীরা কাজ করেন না। সব ধরনের চাষাবাদেই শ্রমিক হিসেবে এখানে নারীরা অগ্রগামী। বড়ই পরিশ্রমের কাজ, মজুরিও তেমন বেশি না।  তবু সারাবছর ধরে অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজে তাদের খুব অনাগ্রহ।

আলু তোলা ধানের চেয়েও খুবই পরিশ্রমের কাজ। সারাদিন এই খররোদে বসে দু‘হাত দিয়ে ঝুরো মাটির নিচ থেকে খুঁড়ে খুঁড়ে আলু তুলে আনেন। তোলা হয়ে গেলে সেগুলো বস্তাবন্দি করে ক্ষেত থেকে রাস্তায় এনে ভ্যানে তোলা এবং বাড়ি গিয়ে বেছেবুছে ভালো মন্দ, ছোটবড়  আলাদা করে টাল দিয়ে রাখা। ক্ষেতে ঘুরে দেখলাম তাদের মুখে পরিতৃপ্তির হাসি।জানিনা অন্য গ্রামে কী হয়। আমি দেখেছি অনেকবার, এই গ্রামের নারীরা ভীষণ ব্যস্ত।প্রত্যেকে কিছু না কিছু করেন।

এই করোনাকালের কথাই যদি বলি, কারো স্বামী হয়তো চাকরি কিংবা ব্যবসা হারিয়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। কিংবা ব্যবসা মন্দা চলছে কারো। চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে অনিশ্চয়তা। স্ত্রী ধরেছেন হাল। স্বামী মৃত কিংবা স্বামীকে ছেড়ে চলে এসেছেন, এইসব নারীরা অদ্ভুত সাহস নিয়ে পথ চলছেন।

আমি করোনাকালে দু‘বার গ্রামে গিয়ে দেখেছি বাড়ির সামনের মাচায় লাউ, শিম, কুমড়া পেপে চাষ করে নিজেরা বিক্রি করছেন। টাকা নিয়ে আঁচলের খুঁটে বেঁধে রাখছেন। পাইকার যাওয়ার ফুরসতই নেই। মুরগি, ছাগল পালছেন, পাইকার গিয়ে নির্দিষ্ট দিনে বাড়ির সামনে দাঁড়াচ্ছে,  মুরগি তুলে দিচ্ছেন ভ্যানে। টাকা তার। আমাদের মতো শহুরে স্বজনরা কেউ গ্রামে বেড়াতে গেলে তাদের কাছে বিক্রিতে উনাদের উৎসাহ বেশি। কারণ দামটা ভালো পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে পাইকারের তোয়াক্কা করেন না তারা। যেখানে দাম ভালো সেখানেই তারা বিক্রি করবেন তাদের পণ্য।

এসব ছাড়াও গ্রামের পথে পথে যে মুদিখানা, চায়ের দোকান-সবেতেই নারী আছেন।

তাই বলে পুরুষরা বসে থাকেন না। তারাও কাজ করেন। হয়তো স্ত্রী শুরু করেছেন ফলের  বাগান। স্বামী সাহায্য করছেন, গাছের যত্নআত্তী করছেন। ক্ষেতে পানি দিচ্ছেন। ফলেও ভালো ফলন। হবেই তো। যত্ন আর আন্তরিকতার অভাব যে নেই! এসব গাছের ফল গ্রামেই আশেপাশের ঘরের লোকজন কিনে নিচ্ছেন। দামও বেশ ভালো।

যেদিকেই তাকাই, শশব্যস্ত নারীদের দেখি। গরুছাগল দেখাশোনা করছেন, খাবার দিচ্ছেন। একটা গরু বা ছাগলকে দড়ি বেঁধে টেনে নিতে কোনো পুরুষকে দেখতে পাইনি। সালমার স্বামী মারা গেছেন ষোল বছর আগে। তিন সন্তানকে নিয়ে অকূল পাথারে পড়ার কথা ছিলো সালমার। কিন্তু তিনি ভেঙে পড়েননি।  ছাগল পালন, জমি লিজ দেয়া, চাষবাস করে বড় মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে আর ছেলে কলেজে পড়ছে।

যেমন সহজে বললাম, কাজটা মোটেই অতটা সহজ ছিলো না। তাকেও অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ঘরের স্বজনেরা তো বটেই সমাজের চাপও ছিলো, একলা নারী কেনো পুরুষদের মতো সব করবে! গালাগাল, মানসিক নির্যাতন, নোংরা অপবাদ সবকিছুর প্রতিবাদ করেছেন সেই নির্যাতনকারীর ভাষাতেই। প্রতিবাদী নারী কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার তো করেনইনি, বরং কেউ ঢিলটি ছুড়লে পাটকেল ছুড়তে এতটুকু দ্বিধা করেননি। ধীরে ধীরে সমাজ সংসারেরও চোখ সয়ে এসেছে। এখনও আয় রোজগারের জন্য, পরিবারের কর্তা হিসেবে নিজের সক্ষমতা প্রমাণের জন্য লড়াইটা তাকেই করতে হচ্ছে। কারণ তার অদম্য সাহস আর কর্মস্পৃহা তাকে এই সমতার লড়াইয়ের যোগ্য করে তুলেছে।

আমি যখন বলি, আপনি অনেক কষ্ট করেন- শুনে তার ক্লান্ত বাদামি চোখে হাসি ঝিলিক দেয়, কী করি! বাঁচতে তো হবে! ছেলেমেয়েদের মানুষ তো করতে হবে। পরিবারটা তো চালাতে হবে!

আমার আগ্রহ দেখে নিজে থেকেই বলেন, আমি এইবার ধান কাটার কোনো লোক পাইনি। নিজের ধান নিজেই কেটেছি। আঁটি বেঁধে বাড়ি নিয়ে এসেছি। শুনে আমি অবাক তাকিয়ে রই, আমরা রোজ মিছেমিছি কত ভারই না বই! কত বড়াই করি সেই ভার নিয়ে চলার।লড়াইটা শুধু সালমার নয়। আরো অনেকের।

গ্রামে গেলে এক নারী আমাদের ঘরের কাজে সাহায্য করেন। তাকে সবাই কালা মা বলে ডাকে। ভেবেছিলাম, হয়তো তার সন্তানের নাম কালা।  নাহ, কালা নামে তো দূর, তার কোনো সন্তানই নেই। নারীর ভালো একটা নামও আছে, শিল্পী। শিল্পী নাম রাখলেও কালো বলে ছোটবেলায় তার বাবা আদর করে ডাকতেন, আমার কালা মা। সেই থেকেই এমন নাম৷ একথা জানার পর সঙ্গত কারণেই আমি আর তাকে কালা মা বলে ডাকতে পারিনি। তবে উনার বিয়ে হয়েছিলো। স্বামীর ঘরে সতীন আছে বলে ওই কালো নারী তেজ দেখিয়ে স্বামীর ঘর করেননি। স্বামীকে তালাকও দেননি। এখন নিজের মতো করে থাকেন। রোজগার করেন।কাঁথা সেলাই করেন, অন্যের জমির ফসল তুলে দেন। স্বামীর কাছ থেকে কিছু নেন না। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় তাকে কালা মা ছাড়া অন্য নাম ধরে ডাকারও কেউ নেই।

নিজেই বলেন,  যার যা ইচ্ছা ডাকুক, 'আমার কী আসলো গেলো! যে লোক বিয়ে করে নিয়ে গিয়ে অন্য নারীর সাথে সংসার ভাগাভাগি করতে বলে, করলাম না তার ঘর।কী আসে যায়! পেটের ভাতের জন্যই তো? আমার পেটের ভাত আমিই জোগাই।কারো ধার ধারি না। কামাই করেই খাই।'

কালো নারী জানেনও না প্রথম সারির একটা জাতীয় দৈনিকে কালো মেয়েদের অবমাননা করে একটা শব্দ লিখলে কেমন প্রতিবাদ হয়। কালো নিয়ে উনার মাথাব্যথা নাই। উনার যেখানে ব্যথা সেখানে উনি নিজের মলম নিজেই যোগান। উনার ভাষায়, এইসব পুছিনা গো!

নারী দিবসে এই হলো আমার দেখা নারীদের জীবন।

৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। "করোনাকালে নারী নেতৃত্ব, গড়বে নতুন সমতার বিশ্ব"- এবারের ৮ ই মার্চে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শ্লোগান এটি। 

সমতার বিশ্ব গড়তে নারী নেতৃত্ব যাই করুন এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা সেসবের কোনো খোঁজ রাখেন না। কোনরকম নেতৃত্ব ছাড়াই আমাদের শহুরে চক্ষুর আড়ালে নারীরা কোথাও কোথাও সমতার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের মতো করে। বহন করে চলেছেন নিজেদের জীবনের ভার, সেইসাথে সংসার এবং সন্তানেরও। এসব খবর অনেক শহুরে নারী তো দূর নেত্রীরাও হয়তো জানেন না। 

বাংলাদেশের শহুরে নারীরা সমতা নিয়ে সোচ্চার। গ্রামীণ নারীরা সমতা টমতা নিয়ে ভাবেন না। তারা নিজেরা নিজেদের মানুষ মনে করেন। সেভাবেই চলেন এবং বলেন। এই নারী দিবসে আমার অভিবাদন তাদেরকে। 

1461 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।