এর আগের দিন সারারাত ঘুমায় নি। পরেরদিন জেঠাতুতো বোনের জামাইভাত ছিলো। ওরা আসবে, ওদের ৩০০ জন, আমাদের ২০০ জন, মোট পাঁচশ জনের খাবারের আয়োজন। এর আগের রাত থেকেই আমরা ক্লাবে ছিলাম। পাঁচক রান্না করছে, আমি আমার পিসিতুত ভাই আর জেটাতো ভাই তিনজন ক্লাবেই ছিলাম। ৩০ই মার্চ তিনজন সারারাত ঘুমাই নি। পরদিন চোখে চোখে ঘুম ঘুম ভাব। সেদিন ছিলো ৩১ মার্চ ২০১৫ সাল।
আজ থেকে তিন বছর আগের কথা
বেলা তখন ১১টা বাজে। হঠাৎ ফেইসবুকে ঢুকে দেখি, বন্ধু, নাস্তিক ব্লগার, ওয়াশিকুর রহমান বাবুর রক্তাক্ত লাশ! পাতলা গড়নের দেহ ক্ষত বিক্ষত অবস্থায় শুয়ে আছে ওয়াশিকুর বাবুর লাশ! ইসলামিস্টদের চাপাতির আঘাতে মুখের মাংস খসে পড়েছে। রক্তমাখা কি বিভৎস চেহারা! আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না! এ ও কি বিশ্বাস করতে হবে? এই কি হচ্ছে দেশে?
আধুনিক যুগে আল্লার নামে, ইসলামের নামে এই হত্যাকাণ্ড আমাদের নিরবে দেখে যেতে হবে? তখনো মুক্তমনা ব্লগের মহীরুহ অভিজিৎ রায়কে হারানোর ক্ষত আমাদের শুকায় নি। এর মধ্যে আবার ইসলামিস্টদের নাস্তিক হত্যা! তাও আবার প্রকাশ্যে দিবালোকে। অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর ভেবে নিয়েছিলাম যে ইসলামের জন্য আর হত্যাকান্ড হবে না এদেশে। মোটামুটি নিশ্চিন্তে কাটাচ্ছিলাম। এক মাসের মধ্যে আরো একটা দুর্ঘটনা আমাদের অবাক করে দিলো বাবু হত্যাকান্ডকে ঘিরে। এই ওয়াশিকুর রহমান বাবু মুমিনদের হাস্যকর ধর্মীয় যুক্তিগুলো দিয়ে ব্যাঙ্গাত্নক ভাষায় চমৎকার চমৎকার সিরিজ (নাস্তিকদের দাঁত ভাঙ্গা জবাব। সেইসময় সেই সিরিজগুলো বাবু ধর্মকারী ব্লগে দিতো।) লিখতো। এরপর ভেবেছিলাম, এই বাবু হত্যাকাণ্ডই শেষ। আর কোনো হত্যা বোধকরি আমাদের আর দেখতে হবে না। সরকারের বুঝি এইবার টনক নড়বে। বাবু হত্যার পর আতংকের মধ্যে দিয়ে আমরা কোনোরকমে একমাস পারও করেছিলাম। ভেবেছিলাম ইসলামিস্ট কিলার জঙ্গিরা এবার ক্ষান্ত দেবে। কিন্তু আমাদের জন্য বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো এর পরের মাস ১২ই মে! সেদিন সকাল ৯ টার দিকে অনন্ত বিজয় দাশকে সিলেটে ইসলামিস্টিরা দীর্ঘ সময় নিয়ে দৌঁড়ে ধরে কুপিয়ে কুপিয়েই নৃশংসভাবে হত্যা করে!
ইসলাম ধর্মের জন্য হত্যাকান্ড এই নতুন নয়। আমরা ইসলামের দীর্ঘ ১৪০০ বছরের পথ পরিক্রমায় দেখে আসছি মুসলমানদের ধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য অজস্র হত্যাকান্ড! যেই ধর্মটির পথ চলার ইতিহাসে লেগে আছে, অগণিত ধর্ষিতার (যুদ্ধবন্দিনীদের) দীর্ঘশ্বাস। আছে মা হারা শিশুর আর্ত চিৎকার! আছে অসংখ্য গনহত্যার রক্ত-নদী। তৎকালীন নবী মুহম্মদ এই ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা করার জন্য অনৈসলামিক মতবাদীদের নির্দ্বিধায় হত্যা করতেন। মুসলমানরা আজো মুহাম্মদের সেই সহিংস ইসলামকে অনুসরণ করছে মাত্র। এই শতাব্দীর শুরু থেকে আমেরিকার সুউচ্চ টুইন টাউয়ার, মুম্বাইয়ের তাজ হোটেল, ফ্রান্সের শার্লি হেব্দো, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শহরে বোমা হামলা, সেখানে ভীড় মানুষের মধ্যে ট্রাক চালিয়ে দিয়ে হত্যা করা। আরেক দিকে ইসলামি সন্ত্রাস আইএসরা ইরাক-সিরিয়ার বহু পুরোনো প্রত্নতাত্ত্বিক 'পালমি' শহরকে ধ্বংস করে, খ্রীষ্টপুর্ব ব্যবলনীয় সভ্যতার স্থাপত্য ধ্বংস করে। আর সর্বশেষ ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারীতে এই দেশের ইতিহাসে ভয়াবহ ও বর্বরতম হামলাটি চালায় এদেশীয় আইএসরা! একটা জিনিস লক্ষ্য করলে দেখা যায়, মুসলমান সন্ত্রাসীদের সবসময় লক্ষ্য থাকে প্রতিটি হামলায় অমুসলিম ও বিধর্মীদের হত্যা করার। সংশয়বাদী, অবিশ্বাসী হলে তো কথাই নেই, এদের হত্যা করতে পারলেই যেন আরো বেশি আল্লাহ ও ইসলামের ঈমানী দায়িত্ব পালন করা হয়! হুমায়ূন আজাদ, রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, বাবু, অনন্ত বিজয় দাশ, নিলয়, প্রকাশক দীপন, সামাদসহ আরো কয়েকজন ব্লগারকে হত্যা করা এটা কোরান ও ইসলামেরই অংশ।
বর্তমানে মুসলমানরা সহিংস জাতি হিসেবে পুরো বিশ্বে এতোটা পরিচিত লাভ করেছে যে, একজন পাকিস্তানি মুসলমান প্রধানমন্ত্রীর উপরও আস্থা রাখতে পারেন নি আমেরিকার বিমান বন্দরের কর্তৃপক্ষরা। হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, "-একজন পাকিস্তানী যদি হাতে ফুল নিয়েও আসে, আমি তখনো তাকে অবিশ্বাস করবো।" এই তো কয়েক দিন আগে পাকিস্তানের একজন প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত উলঙ্গ করে তল্লাশী চালালো আমেরিকার বিমান কর্তৃপক্ষ! একটা রাষ্ট্রের জন্য এর চেয়ে লজ্জা আর কি হতে পারে? আগামীতে আমেরিকায় যদি সৌদি বাদশাকেও নগ্ন করে তল্লাশী চালানো হয়, তখনো অবাক হবো না।
ইউরোপিয়ানরা এখন যেকোনো একটা হিংস্র পশুর চেয়ে টুপি-দাঁড়িওয়ালা ধর্মপ্রাণ একজন মুমিন মুসলমানকেই ভয় পায় বেশি। এই বুঝি দাঁড়িওয়ালা মুসলমান ছেলেটি আত্নঘাতী বোমা হামলা করে বাসটা, ট্রেনটা, বিমানটা উড়িয়ে দেবে না তো? এই বুঝি বোরখা পড়া মুসলিম তরুনীটি শপিং মলটা, সভাস্থলটা আত্নঘাতী বোমা হামলা করে ধ্বংস করবে না তো?
বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের প্রতি অমুসলিমদের এই অবিশ্বাস একদিনে তৈরি হয় নি, ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে। আমার চোখের দেখা এই শতাব্দীর শুরু থেকে এই গোটা বিশ্বে যতবার সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, ততবারই ইসলামি জঙ্গীগৌষ্ঠির নাম এসেছে। ততবারই প্রমাণ হয়েছে এরা আল্লাহ ও ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী মুসলমান! কথায় আছে না? -প্রতিটি মুসলমান জঙ্গী নয়, আবার প্রতিজন জঙ্গী-সন্ত্রাসীই কিন্তু মুসলমান! ইউরোপিয়ানরা মানবতা দেখিয়ে ক্ষুধাগ্রস্থ, দারিদ্র্গ্রস্থ, যুদ্ধকবলিত দেশগুলো থেকে অসহায় ও শরণার্থী মুসলমানদের এনে আশ্রয় দিয়েছেন। আর আশ্রিত মুসলমানরা এখন ইউরোপিয়ানদের ভালোই প্রতিদান দিচ্ছে! কখনো বোমা হামলা করে, কখনো বন্দুক দিয়ে এক ঝাঁক অমুসলিম হত্যা করে, কখনো অমুসলিমদের ভীড়ের মধ্যে চলন্ত ট্রাক তুলে দিয়ে এক রাশ মানুষ হত্যা করে। মুসলমানদের চোখে পশ্চিমা ইউরোপিয়ান হলো অমুসলিম, বিধর্মী, কাফের! তাই অমুসলিম কাফেররা তাদের প্রতি যতই দয়ায় দেখাক না কেনো, এমন উপকারী দয়ালুকেও হত্যা করা যেকোনো ঈমানদারী মুমিন মুসলমানদের জন্য ঈমানী দায়িত্ব! কারণ যে দয়া করেছে, সেই তো একজন অমুসলিম! মুসলমান তো না! মুসলমানরা বিশ্বাস করে এই পৃথিবীটা শুধুমাত্র তাদের জন্য তাদের আল্লাহ বানিয়েছেন। এই পৃথিবীর উপর মুসলমান ছাড়া কারোর অধিকার নেই! তাই আল্লাহর পথে জিহাদ করে এই পৃথিবীটা অমুসলিম শূন্য করতেই হবে! অমুসলিম হত্যা করে ৭২টা হুরীর যৌন-লালায়িত জান্নাত তাদের পেতেই হবে! অমুলিমরা মুসলমানের প্রতি দয়া দেখালেই কি, নবী মুহম্মদের ইসলাম তো মুসলমানদের মননে গেঁথে দিয়েছে সাম্প্রদায়িকতার বিষ! অমুসলিম কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করো না, তাহলে তোমরাও কাফের হয়ে যাবে! তাদের যেখানে পাও হত্যা করো, তাদের পেছনে হাত বেঁধে জোড়ায় জোড়ায় কাটো। -এমন জঘন্য সাম্প্রদায়িক হিংসা পরায়ণতা বোধকরি পশুদের সমাজেও নেই!
বর্তমান সভ্য পৃথিবীতে চলতে গেলে ধর্মজ্ঞানের কোনো প্রয়োজন নেই। যেটা বেশি প্রয়োজন সেটা হলো বিভিন্ন ভাষা জানার দক্ষতা, থাকবে হবে বিজ্ঞানবিদ্যা, যুক্তিবিদ্যা ও আধুনিক প্রগতিশীল শিক্ষা। ধর্মজ্ঞান আপনাকে প্রগতির দিকে এক ইঞ্চিও এগিয়ে নেবে না, বরঞ্চ শত শত বছর পেছনেই রেখে দেবে। ধর্মজ্ঞান দিয়ে ধর্মীয় জাতিভেদ, সাম্প্রদায়িকতা ও শ্রেণিভেদের বৈষম্য ছাড়া আর কিছু অর্জন করা যায় না। আমি বুঝি না, মুসলমানরা নিজেদের মানসিক চেতনার বিকাশ না করে, তারা পড়ে আছে জুম্মার নামাজ বাদ দিলে (একটা কল্পিত) বেহেস্ত হাত ফসকে যাবে না তো? পায়ু পথ দিয়ে বায়ু বের হলে আবার অজু নষ্ট হয়ে যাবে না তো? শুয়োয়ের মাংস খেলে মুসলমানিত্ব নষ্ট হবে না তো?
ফ্রান্সের কোনো তরুন শিক্ষার্থী যখন গবেষণাগারে বসে বসে এই পৃথিবীর উপ্তপ্ত জলবায়ু মানুষের জন্য আরো কিভাবে পরিবেশ বান্ধব করা যায় তা নিয়ে ভাবছে, তখন এদেশের মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ভাবছে, সেই মুসলিম হয়ে অমুসলিম কবির রচনা জাতীয় সঙ্গীত গাইতে পারবে কিনা। এতে হারাম হবে কিনা? আমেরিকার কোন তরুণ শিক্ষার্থী যখন নাসায় বসে গবেষনা করছেন, -এই পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো গ্রহকে আদৌ মানুষের বাসযোগ্য করে তোলা যায় কিনা সে চিন্তা নিয়ে, তখন এদেশের কল্পিত আল্লাহর একজন খাঁটি জিহাদী মুমিন বান্দা ভাবছে নাস্তিককে কতল করলে কতো নেকী পাওয়া যায়? আর জান্নাতে যাওয়ার পথ কতোটা অতিক্রম করা যায়? আজ থেকে তিন বছর আগে এদেশের ইসলামিস্ট সন্ত্রাসীরা নাস্তিক ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করে কতোটা নেকি অর্জন করেছেন জানি না, তবে ইসলাম যে মানব সভ্যতা বিরোধী কতোটা সহিংস মতবাদ তা আরো একবার প্রমাণ করে দিলো এরা! মুসলমানরা যতদিন তাদের আল্লাহ, নবী, ইসলাম ও কোরানকে পশ্চাতে রেখে পথ চলতে না পারবে, ততদিন তারা বিশ্বের অমুসলিমদের কাছে একেকজন সন্দেহজনক আতংকবাদী হিসেবে বিবেচিত হবে। এটা মুসলমানদের প্রতি গোটা বিশ্বের অমুসলিমদের সাম্প্রদায়িক ঘৃণা নয়, ইচ্ছে করে বৈষম্যও নয়, এটা মুসলমানদের প্রতি ভয়! নিজের জীবনটা হারোনোর ভয়! এই ভয়ের কারণেই মুসলমানদের জন্য এখন অমুসলিম দেশগুলোতে বাস স্টেশন, ট্রেনের প্লাটফ্রম, শপিং মল, কোনো সমাবেশে বাড়তি সতর্কতা নিতে হয়। যা বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের জন্য সত্যিই লজ্জার....