ইমতিয়াজ মাহমুদ

এডভোকেট, মানবাধিকারকর্মী

বিপ্লবে দুইটা জিনিস থাকে

বিপ্লবের কথা বলতে হয়। বিপ্লব কোনো বান্দরের নাচ না, বিপ্লব কেবলমাত্র ক্ষমতা বদল না, বিপ্লব মানে কেবল পরিবর্তনও না, সংস্কার তো নয়ই। কিছু বেওকুফ আবার মনে করে বিপ্লব মানে হচ্ছে ভালো কিছু করা। বিপ্লব এইসব কিছুই না- বিপ্লব মানে বিপ্লব- একটি সমাজকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে ধ্বংস করে দিয়ে সেখানে নতুন একটি সমাজ তৈরি করা মানে হচ্ছে বিপ্লব। এর কম কিছু হলে- ওয়েল, আপনারা অনেক কিছুকেই বিপ্লব নাম দিতে পারেন, শব্দ ব্যবহারের স্বাধীনতা তো আপনার আছেই- প্রিয়তমার ঐটাকেও চম্পা ফুল বলতে পারেন, আপনার শব্দ আপনার শখ আপনার ব্যবহার- সেটা বিপ্লব না। বিপ্লবের আগের দেশ আর পরের দেশ আর বিপ্লবের আগের সমাজ আর পরের সমাজ কখনো এক না। আবার বলি, এটা ভালো বা মন্দের বিষয় না, ভালো মন্দ তো যার যার পছন্দ অনুযায়ী হয়- বিপ্লব হচ্ছে একটি ব্যবস্থা ভেঙে, একদম ভেঙে, নতুন আরেকটা সমাজ তৈরি করা

চার বন্ধু মিলে বান্দরবনে গিয়ে পাহাড়ে সুড়ঙ্গ খোঁড়া- এই সুড়ঙ্গ থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন এই ভেবে- এটা কোনো বিপ্লবী কর্মকাণ্ড না। একটা ক্যান্টনমেন্টে মিলিটারির মধ্যে সিপাইদেরকে খেপিয়ে তোলা এটা কোনো বিপ্লব না। একটা বিশৃঙ্খল সময়ে ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা দখল করা বা ইচ্ছেমত লোকজন মারা- এটাও কোনো বিপ্লব না। জেনারেলরা ক্যু করছে, পাল্টা ক্যু করছে আর ওদের মাঝখানে গিয়ে ফোকটে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করা- এটা বিপ্লব না। গর্ভধারিণী উপন্যাসে যেরকম- পাঁচ বন্ধু মিলে একটা বোমা ফাটানো বা ঐসব- ঐটা বিপ্লব না। ক্যু পাল্টা ক্যুর মাঝখানে গোটা পঞ্চাশেক লোক গিয়ে মিলিটারির সাথে ট্যাঙ্কে উঠে লাফালাফি করে ফটো তোলা আর দুই আড়াই কিলোমিটার রাস্তায় কয়েক ঘণ্টার জন্যে একটা 'জিতে গেছি জিতে গেছি' ভাব করা এটা একটা বালখিল্যতা মাত্র- খবরের কাগজে ফটো হবে- বিপ্লব না

না, এতোগুলি কর্মকাণ্ডে যারা জড়িত থাকেন, রোম্যান্টিক তো ওরা বটেই- ওদের আকাঙ্ক্ষা হয়তো বিপ্লব করা। ওদেরকে সেইরকম নিন্দা না করেও আপনাকে বলতেই হবে যে দেশের মানুষের মধ্যে কোনো খবর নাই আর আপনারা কয়েক বন্ধু মিলে সমাজ পাল্টে দিবেন এটা কোনো মহান কর্মসূচী হতে পারে না। এইসব ঘটনার নেতাদের প্রতি অশ্রদ্ধা না করেও আপনাকে বলতে হবে যে এইসব কাজে চূড়ান্ত বিচারে বিপ্লবের ক্ষতি হয়।

এই কথাগুলি মনে রাখা জরুরী। বিশেষ করে তরুণ বন্ধুদের জন্যে। কেননা তরুণদের মধ্যে থেকেই আগামী দিনের বিপ্লবীরা আসবে। কিছুসংখ্যক লোক ১৯৭৫ সনের ৭ই নভেম্বরে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীকে বিপ্লব আর প্রতিবিপ্লব আর এইরকম নানাকিছু বলে এই দিনে উৎসব ইত্যাদি করে। মনে রাখবেন, ৭৫এর ৭ই নভেম্বরে বাংলাদেশে মিলিটারিদের মধ্যে ষড়যন্ত্র পাল্টা ষড়যন্ত্রে এইসবের ফয়সালা হয়েছে। এইসব ঘটনার সাথে দেশের মানুষ জড়িত ছিলো না। এইটা ছিলো ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে দেশকে নিয়ে যাওয়ার যে ষড়যন্ত্র তারই বর্ধিত অংশ মাত্র।

কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতা আর ইউনিভার্সিটি টিচার এইধরনের লোক দেখবেন খুব করে বলবে যে 'উফ ৭ই নভেম্বরে বিপ্লব প্রায় করেই ফেলেছিলাম, এই জিয়াউর রহমান লোকটার বেইমানির জন্যে ইত্যাদি।' ও ভাই, এখন তো অন্তত আপনাদের বুদ্ধি খোলার বয়স হয়েছে, নাকি? সে সময়ে যা কিছু করার ওরাই করেছে, জেনারেলরা সব। আপনারা সেখানে গোটা পঞ্চাশেক (একটু বাড়িয়েই বললাম) জোকার ছিলেন মাত্র। আপনারা এখানে সেখানে লাফালাফি করেছিলেন যে কয়জন, ওদের সংখ্যা গুণে দেখেন, একটা থানায় তার চেয়ে বেশী কনস্টেবল থাকে। কর্নেল সাহেব এর মধ্যে কিছু সিপাইকে নানাপ্রকার সুবিধার লোভ দেখিয়ে তেলেসমাতি করার চেষ্টা করেছিলেন। সিপাহীদের ঐসবে বিপ্লবের কিছু ছিলো না।

জনাব সাহেবরা, এতদিনে এসে তো আপনাদের বোধগম্য হওয়া দরকার যে এইসব ঘটনাকে বিপ্লব বলা একটা নিতান্তই রঙ তামাশা আরকি। বরং এইসব থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতেন, জ্বে-না, ষড়যন্ত্র আর বিপ্লব এক জিনিস না। জ্বে না, সাড়ে বারোজন লোক নিয়ে বিপ্লব হয় না, সাথে মানুষ থাকতে হয়, সবার উপরে রাজনীতি থাকতে হয়। সেই শিক্ষাও তো আপনারা নিয়েছেন বলে মনে হয় না। এখন তো সব দল বেঁধে আওয়ামী লীগে গিয়ে ঢেকুর তুলছেন আর ভাবছেন যে নাহ, এতদিনে বিপ্লবের মেওয়া ফলেছে বটে, মেওয়া খাই

তরুণ বন্ধুরা, মনে রাখবেন, বিপ্লবের জন্যে আপনার আকাঙ্ক্ষা জরুরি তো বটেই, আপনার টিম থাকাটাও আবশ্যক। কিন্তু সাথে জনগণকেও থাকতে হবে, জনগণের মধ্যে মানে কিনা সমাজের মধ্যে বিপ্লবের ক্ষুধাটাও থাকতে হবে। নাইলে আর যাই হোক, বিপ্লব হবে না। কেননা, বিপ্লব কোনো ক্রিকেট ম্যাচ না, বা কোনো ডান্স কম্পিটিশন না। বিপ্লবের দুইটা অংশ, প্রথম অংশ হচ্ছে ধ্বংস করা আর দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে ধ্বংসস্তূপের উপর নয়া সমাজ তৈরি করা। এই দুইটা অংশই থাকতে হবে আপনার বিপ্লবের ডিজাইনে। আর আপনার বিপ্লবের মিস্ত্রি হবে জনগণ। আপনি? আপনারা ডিজাইন করবেন, স্ট্রাকচার আঁকবেন আর সেটা বুঝাবেন মিস্ত্রিদেরকে। নাইলে? নাইলে কাঁচা কাজ হবে।

1470 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।