(১)
একেকটা বারবি পুতুলের দাম অনেক। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন মেটাল কর্পোরেশন বারবি পুতুল শুধু আমেরিকাতেই তৈরি করতো। বারবির তখন দুনিয়াজুড়ে সেরকম নাম ধামও হয়নি- মেয়েটি তখনও নিতান্তই আমেরিকার।অনেক পরে ওরা বারবি তৈরি শুরু করেছে বিদেশে। চীনাদের মজুরদের শ্রম বারবিকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছে। এখন বারবির রকমফেরও আছে। ইন্ডিয়ান সাজে ইন্ডিয়ান রঙএও বারবি আছে। এইসব কতো কি। সেই সুবাদে বারবির দামও এখন কমেছে।
এই যে দাম কমেছে বলছি, সেটাও কিন্তু আগের তুলনায় কমেছে মাত্র। আমাদের দিশী মধ্যবিত্তের হিসাবে বারবির দাম এখনো অনেক। সর্বশেষ আমি যখন কিনেছি, তখন হাজার টাকায় একটা এমনি সাধারণ বারবি পুতুল পাওয়া যেতো। তিন সাড়ে তিন হাজারে একটা বড় বাক্সে কিছু এক্সেসরিজ সহ একটা বারবি মিলত। বারবির আলাদা একেকটা পোশাক বা একজোড়া জুতা কিনতেও মোটামুটি পাঁচ সাতশ টাকা লেগে যেত। আমার মেয়েরা বারবি কেনা বন্ধ করেছে কৈশোরে পা দেওয়ার আগেই। সেজন্যে আমার আর বারবির খোঁজ রাখা হয়নি।
কিন্তু শুধু যে কন্যাদের জন্যে কেনার জন্যেই বারবির প্রতি আগ্রহী হয়েছিলাম সেকথা ভাববেন না। নিজেও আমি একসময় বেশ মনোযোগ দিয়ে বারবি দেখতাম। কিনতে পারতাম না- কিন্তু ওর খোঁজ খবর রাখতাম। আমাদেড় বাসাবো বাসায় একবার কে জানিনা এক সেট বারবির ছোট ছোট রেপ্লিকা এনেছিল। আমি তখন আইনের ছাত্র। সেই পুতুলগুলিকে আমি সাজিয়ে রাখতাম। সেসময়ের জনপ্রিয় দিশী মডেলদের নামে ওদের নামও রাখতাম। আমার ছোটবোন তখন দেশের হৈচৈ ফেলে দেওয়া বিজ্ঞাপনের মডেল। সেই সুবাদে টেলিভিশনে দেখা অনেক নারী মডেলের নাম জেনে ফেলতাম।
আমেরিকাতে, শুধু আমেরিকাতেই বলি কেন- একরকম সারা দুনিয়ায়ই বলতে পারেন, বারবি হচ্ছে পণ্যরূপ নারীর চূড়ান্ত প্রতিমা। সেটা শুধু যে নারীর শরীরের গঠন কিরকম হবে তারই ইন্ডিকেশন তা কিন্তু নয়। সমাজে নারীর জায়গা কি হবে, নারী যে পুরুষের ভোগের বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়, এমনকি নারী যদি কাজকর্মও করে তারও ধরন কি হলে পুরুষ পছন্দ করবে সেটার প্রতিফলন বারবিতে হয়। এবং এর ইমপ্যাক্ট যে কতো গভীর সেটা চিন্তা করতেও ইয়ে হয়।
(২)
আমেরিকার সংস্কৃতিতে বারবির প্রভাব অনেক। একটি শিশুকে পণ্য অর্থে নারী বানানোর জন্যে বারবি একটি হাতিয়ার। একটা শুধু তথ্য দিয়ে রাখি- যতটুকু মনে পড়ে, বারবি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ইলেকশনেও অংশ নিয়েছিল একবার।
বারবির প্রতি আমার এই টান সেটা কি কেবল রূপবতী তরুণীর প্রতি পুরুষের যে কামনা সেটা থেকেই জন্মেছে? হতে পারে। তবে এমনিতে আমার ওইধরনের পোরসোলিন ত্বক, লম্বা নখ ঐসবের প্রতি বিশেষ টান নাই। নিজের পার্টনার হিসেবে আমি সবসময়ই দীর্ঘকায়া নারীই চেয়েছি- প্রেমে বিবাহে বা ক্যাজুয়াল সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবসময়ই। কিন্তু বারবির মতো ঐরকম ঠুনকো পলকা টাইপ নারীদেহ আমাকে সেইভাবে কখনো আকর্ষণ করেনি। নারীর প্রসাধন আমার কাছে একদম উপেক্ষণীয় কিছু মনে হয়নি- ঐ যে কিছু নারীবাদীরা একসময় লিপস্টিক পরবে না, ওয়াক্সিং করবে না, মেকআপ পরবে না এইরকম ইয়ে করেছিল, সেটা আমার কাছে সম্পূর্ণ সমর্থন করার মতো মনে হয়নি।
বারবির প্রতি আমার আকর্ষণ ছিল বলা কঠিন, কিন্তু বারবি নিয়ে আমার কৌতূহল সবসময়ই ছিল। না, আসলে সেটা কৌতূহলের চেয়েও বেশী। শুধু বারবির কোথা কেন বলি- নারীর পোশাক, নারীর সাজগোজ, নারীর স্বাস্থ্য সবকিছু নিয়েই আমার আগ্রহ ছিল। শাড়ী নিয়ে আগ্রহের কথা তো অনেকেই জানেন। শাড়ী ছাড়াও অন্য পোশাকও আমি মনোযোগ দিয়ে দেখি। চোখ সাজানোর ব্যাপারটা আমার কাছে একটা বিশাল শিল্পকর্ম মনে হয়- কাজল ছাড়া চোখ একটু ইয়ে মনে হয়। লিপস্টিক একটা জটিল ব্যাপার। শুনেছি আজকাল নাকি নানারকম স্বাদের ও গন্ধের লিপস্টিক পাওয়া যায়। থাক, কিছু বললাম না। তবে ঠিকমতো লিপস্টিক পরতে পারাটার একটা ব্যাপার আছে।
বারবির কথা কেন শুরু করেছি সেই কথাটা ভুলে গেলাম। কি কারণে যেন আজ বিকালে বারবির কথা মনে পড়েছিল। আমার মেয়েরা এখন বারবি নিয়ে খেলে না। তবুও ওদের কাছে খুঁজে একটা বারবি পাওয়া গেছে। ওর ছবি তুলেছি কয়েকটা। যাই হোক। বারবিও তো একজন নারীই। নারীর প্রতি আমাদের এখানে যে হিংস্র ধরনের একটা বৈরি মনোবৃত্তি সেটা বলার জন্যে সম্ভবত বারবির কথাটা শুরু করেছিলাম। ভুলে যখন গেছি গেছি। থাক।
(৩)
শুধু নারীর প্রতি যে আমাদের বৈরি মনোবৃত্তি সেটা নিয়ে দুইটা কথা বলে নিই।
আপনি কি দেখেছেন আজকে আর গতকাল একটা ফটোতে সামিয়া জামানের উপস্থিতি নিয়ে কিসব কথাবার্তা হচ্ছে? সামিয়া জামান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিকতাও করেন। একটা গ্রুপ ফটোতে সামিয়া বসেছেন আরেফিন সিদ্দিকির সোফার হাতলে। ব্যাস। হয়ে গেল সামিয়া জামান খারাপ। এটা তো ভাই ঠিক কথা না। গ্রুপ ফটো। আরও অনেকে আছেন সেরকম একটা ফটো নিয়ে কেন প্যাচাচ্ছেন? না, আরেফিন সিদ্দিকিও খারাপ, সামিয়াও খারাপ নাইলে এরকম ইত্যাদি। নিয়মিত যারা প্রতিবাদ করেন, ওরা প্রতিবাদ করেছেন। সোফার হাতলে বসেছে মানেই কি সম্পর্ক হয়ে গেল?
আমাকে একটা কথা বলেন। সামিয়ার যদি আরেফিন সিদ্দিকির সাথে সম্পর্কও থাকে তাতে আপনার কি? না, মেয়েরা কিভাবে বসবে, কিভাবে হাঁটবে, কিভাবে চলবে সব আমরা ঠিক করে রেখেছি। সেইভাবেই তাকে চলতে হবে। নাইলেই সে বেশ্যা। কি মুশকিল! আমরা চাই নারী সেজেগুজে থাক, রূপসী হোক, দেহ সুন্দর হোক, চুল সুন্দর হোক- কিন্তু সব হতে হবে একজনের জন্যে, ওর মালিকের জন্যে। নাইলেই গালি।
এবং এই যে গালি দেয়, এটাকে আমাদের লোকেরা মন্দ কাজও মনে করেনা। নিজের অভিজ্ঞতা বলি। দুইদিন আগে শাড়ীতে বুদ্ধের ছবি নিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছি, সেই পোস্টে অনেকেই আমার সাথে দ্বিমত করেছেন। করতেই পারেন। একটা মেয়ে পোস্টের পক্ষে একটা কিছু লিখে কমেন্ট করেছে, ওকে আমার আরেক তরুণ বন্ধু দিয়েছে ভয়ংকর এক গালি। আমি ওকে বললাম, ভাই গালিটা ডিলিট করেন, আড় মাফ চান মেয়েটার কাছে। সে আবার তর্ক করে, না মেয়েটা আংকেল ভুল বলেছে ইত্যাদি। আরে ভাই, মেয়েটা ভুল বলেছে কি ঠিক বলেছে সেটা তো কথা না, বাজে গালি কেন দিবেন? ওকে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছি, এখন ও বলে বেড়াচ্ছে ভিন্নমতের জন্যে তাকে আনফ্রেন্ড করা হয়েছে ইত্যাদি- এখনো ডিফেন্ড করে যাচ্ছে মেয়েটা কেন ভুল বললো।
(৪)
আর তসলিমাকে গালি দেওয়া তো আছেই। তসলিমা নাসরিনকে গালি দেওয়া আর ওর নিন্দা করাটা যেন বৈধ আরকি। কয়েকদিন আগে তসলিমা একটি পোস্ট দিয়েছে- আমার একটি প্রেমিক আছে ইত্যাদি বলে শেষ কথাটা হচ্ছে নারীরা একজন স্বামীর সাথে কিভাবে সারাজীবন কাটায় সেটা তাঁর কাছে বোধগম্য নয়। এইটা নিয়ে তসলিমাকে মন্দ কথা বলেননি এরকম কেউ আছেন? জানিনা।
আমি প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলাম। এতো তীব্র প্রতিক্রিয়ার কারণ কি? কারণ কি জানেন? সেই পোস্টে তসলিমা বলছেন, নারীটির সাথে নিয়মিত মিলনের পর দুই তিন ঘণ্টা থেকে প্রেমিকটি চলে যায়। তসলিমা বলছেন, ভাগ্যিস সে চলে যায়, দুই ঘণ্টার চেয়ে বেশী প্রেমিকটির সংগ তাঁর অসহ্য লাগে। এরপর সেই প্রশ্ন, একই স্বামির সাথে একজন নারী কিভাবে জীবন কাটায়। এই যে তসলিমা বললেন, দুই তিন ঘণ্টার পরই প্রেমিকটিকে অসহ্য মনে হতে থাকে, এইটা পুরুষ ভাইয়াদের গায়ে লেগেছে। এতো বড় সাহস, তুই মেয়ে মানুষ হয়ে পুরুষকে বলবি অসহ্য লাগে! এইটা তো সহ্য করা যায়না। দে গালি।
এবং আমি দেখলাম, তসলিমাকে নিন্দার তালিকায় আমার ফ্রেন্ডলিস্টের বড় একটা অংশই যুক্ত আছেন। এরা এমনিতে বেশ লিবারেল ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলাগণ, গনতন্ত্রমনা। সবই ঠিক আছে, কিন্তু মাইয়া মানুষ হইয়া তুই এতো বড় কথা কেন বললি? এবং গালি দেওয়াটাকে এরা একটা লেজিটিমেট টুল মনে করেন, যেটা ওরা ব্যাবহার করতে পারে প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসাবে। আপনি যতই বলেন যে না, প্রতিবাদ তো ঠিক আছে, ভিন্নমতও ঠিক আছে, গালি দিলেন ক্যান। ওরা বুঝবে না। ওরা প্রতিপক্ষের ভুল দেখিয়ে জাস্টিফাই করবে নিজের কুকর্ম।
নারীকে গালি দিয়েছে বলে আমার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গেছে। আমাকে তিনি ভয়াবহ ভাষায় যতটুকু সম্ভব হেয় করার চেষ্টা করেছেন, করুক। আমি শুধু শুনতে চেয়েছিলাম যে তিনি বলুন, জ্বে-না, মেয়েটাকে ঐরকম খারাপ ভাষায় গালি দেওয়া ঠিক হয়নি। না, সেইটা তিনি বলবেন না।
(৫)
তসলিমা নাসরিনকে আমরা নানারকম সমালোচনা করি বটে। কিন্তু তিনি কিছু কিছু অমোঘ কথা বলেছেন, সহজ কিন্তু তীব্র সত্য। গদ্যে বলেছেন, কবিতায় বলেছেন। এগুলির জন্যে তিনি সম্ভবত অমর হয়ে গেছেন। এরকম একটা কবিতা আছে 'চরিত্র' নামে। আপনারা পড়েছেন অনেকেই এই কবিতাটি, ছোট কবিতা, আমি তুলে দিচ্ছি। আর বারবির একটা ফটোও দিচ্ছি।
তুমি মেয়ে,
তুমি খুব ভাল করে মনে রেখো
তুমি যখন ঘরের চৌকাঠ ডিঙোবে
লোকে তোমাকে আড়চোখে দেখবে।
তুমি যখন গলি ধরে হাঁটতে থাকবে
লোকে তোমার পিছু নেবে, শিস দেবে।
তুমি যখন গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠবে
লোকে তোমাকে চরিত্রহীন বলে গাল দেবে।
যদি তুমি অপদার্থ হও
তুমি পিছু ফিরবে
আর তা না হলে
যেভাবে যাচ্ছ, যাবে।