(১)
সন্ধ্যায় বন্ধুকে ফোন করেছি, বন্ধু চট্টগ্রাম থাকেন। ওর বাসায় মহা উত্তেজনা- বন্ধু, বন্ধুপত্নী আর আরেকজন বন্ধু এরা তিনজন মিলে অভিসম্পাত দিচ্ছেন আরেক বন্ধুকে আর তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে। এই শেষোক্ত বন্ধুটির সাথে আমার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা অতো বেশী নাই, আর ওর দ্বিতীয় বা প্রথম কোন স্ত্রীকেই কখনো সামনাসামনি দেখিনি। ফেসবুকে সংযোগ- সে তো আছেই, তাকে কি আর যোগাযোগ বলা যায়? উত্তেজনার কারণ হচ্ছে এই শেষোক্ত বন্ধুটি প্রথম স্ত্রী থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় বিবাহ করেছেন। এই নয়া স্ত্রীটি অপেক্ষাকৃত কম বয়সী এবং শারীরিকভাবে প্রথমার চেয়ে রূপসী। প্রথমাটি নাকি কালো আর শেষের জন ফর্সা।
ঘটনা হচ্ছে এরকম- দ্বিতীয়া আর আমার বন্ধুটি পেশাগতভাবে একসাথে কাজ করার সময় পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। সেই সময় দ্বিতীয়া বিবাহিতা ছিলেন। সেই বিয়েটি ভেঙ্গেছে বেশ আগে। বছর দেড়েক আছে দ্বিতীয়ার কোল আলো করে একটি সন্তান এসেছে। সন্তান জন্মের পরে আমরা জানতে পারি এই সন্তানটি আমাদের বন্ধুর এবং ওরা নাকি বিবাহ করেছে গোপনে। একটু আফসোস হয়েছে যে ব্যাটা ফাজিল বিবাহটা গোপনে করলো কেন? আজকাল কাচ্চি খাওয়ার উপলক্ষ্য খুব একটা পাই না। এছাড়া দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রেম সম্পর্ক বিবাহ এইসব নিয়ে আমাদের আর কি বলার আছে!
কিন্তু প্রথমা তো এইখানে প্রতারিত বোধ করছেন। ওর স্বামী ওর সাথে বিবাহিত থাকা অবস্থায় আরেকজনের সাথে প্রেম করবেন, আরেকজনকে বিবাহ করবেন, সেই ঘরে আবার বাচ্চা ফুটাবেন। এইটা তো প্রথমা খুব আনন্দের সাথে মেনে নেননি। প্রথমার সন্তান আছে। ওরাও বড় হয়েছে- কৈশোরের শেষ ধাপে ছেলে আর মেয়ে- ওরাও দুঃখিত হয়েছে, পিতার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছে। ওদের মায়ের সাথে অন্যায় হয়েছে মনে করে ওরা খুবই ক্ষুব্ধ। ওদেরকে দোষ দিতে পারবেন না।
ওরা দেখেছে ওদের পিতার পেশাগত জীবনের শুরুতে যখন কঠিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল তখন পিতার পাশে ওদের মা ছিল। দুঃখ কষ্ট সহ্য করেছে। আর এখন যখন ওর দুই পয়সা হয়েছে, এখন কম বয়সী নয়া বৌ নিয়ে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে। খারাপ লাগবে না? লাগবেই তো। সেই সাথে সম্ভবত যোগ হয়েছে এই নতুন সম্পর্ক নিয়ে দাম্পত্য কলহ। আর এইসব কলহের ক্ষেত্রে স্বামী প্রবরটি সম্ভবত প্রথমাকে নির্যাতনও করেছে। সন্তানরা পিতার উপর ক্ষুব্ধ হবেই। স্বাভাবিক।
(২)
সন্ধ্যা বেলায় বন্ধুকে ফোন করেছি, এমনিই হাই হ্যালো বলার জন্যে। বন্ধু মহা উত্তেজিত। ঐ দুই বউওয়ালা সাহসী 'ব্যাটা'র স্ত্রী, প্রথমা, আর সন্তানেরা এসেছিল একটু আগে। ওর সন্তানেরা খুব রেগে আছে ঐ দ্বিতীয় বিবাহ আর সে ঘরের সন্তান নিয়ে। জানতে চাইলাম, এটা তো পুরনো ইস্যু, এতদিন পর আবার কি এমন হলো যে হঠাত উত্তেজনা? ঘটনা হয়েছে এই যে, এই স্বামী সাহেব চট্টগ্রাম থেকে সফরে বেরিয়েছেন উত্তরাঞ্চল সফরে, সাথে দ্বিতীয়া। বিভিন্ন শহরে বন্দরে গঞ্জ গ্রামে যাচ্ছেন আর সেখান থেকে দ্বিতীয়া ও নয়া সন্তানের সাথে ফটো পোস্ট করছেন। ফেসবুকে সেইসব ফটো দেখে প্রথমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে ছবি, টাইটানিক স্টাইলে ছবি।
টাইটানিক স্টাইলে ছবির কথা শুনে একটু চমকে উঠেছি। মানে কি? ন্যুড নাকি? না ন্যুড না। দুইজনে দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে হাওয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে ঘনিষ্ঠভাবে। সিনেমায় ছিল বিশাল জাহাজ, আটলান্টিক সাগর- আর আমাদের এরা ফটো তুলেছে নৌকোর গলুইয়ে উত্তরের কোন এক নদীর বুকে, এই পার্থক্য। এই ফটো দেখে প্রথমা এবং ওর সন্তানেরা খুব রেগেছেন। বুড়া বয়সে ঐ ব্যাটা 'খানকি' একটাকে সাথে নিয়ে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে, ওর না হয় লজ্জা শরম নাই, আমাদের কি লজ্জা শরম নাই? এইসব ছবি আবার ফেসবুকে পোস্ট করছে, লোকের কাছে আমাদেরকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে। ওর যদি এতোই খায়েস, পয়সা দিলেই তো এইরকম খানকি পাওয়া যায়। ও ফুর্তি করতে থাক, কিন্তু পাবলিকলি ফটো দেওয়া কেন ইত্যাদি। (শব্দটা ব্যাবহার করতে চাচ্ছিলাম না। অতি বাজে শব্দ- আপত্তিকর। শ্লীলতার বিচারে না, রাজনৈতিকভাবে এটা একটা অতি আপত্তিকর শব্দ। অন্যায় শব্দ। কিন্তু শব্দটা উল্লেখ করছি আমার বন্ধু এবং ওর বন্ধুর স্ত্রী ও সন্তানদের অন্যায় আচরণের মাত্রা বুঝানোর জন্যে। মাফ করবেন।)
এইখানে এসে বন্ধুর উপর রেগে যাই। তোমার বন্ধুর স্ত্রী এবং সন্তানেরা তোমার সামনে একটি মেয়েকে এইরকম গালাগালি করছে আর তোমরা ওদেরকে বাঁধা না দিয়ে, না বুঝিয়ে উল্টা ওদের সাথে গলা মিলিয়ে ওদের মতো করে একই ভাষায় গালাগালি করছো! এইটা কিরকম হলো রে ভাই! এই নারীটি আর পুরুষটি পরস্পরকে ভালবেসেছে, ভালোবেসে বিবাহ করেছে। ওদের একটা ফুটফুটে বাচ্চাও হয়েছে। এইখানে মেয়েটির অপরাধটা কোথায় যে ওকে এই ভাষায় গালি দিচ্ছ তোমরা?
(৩)
হ্যাঁ, পুরুষটি আগে থেকেই বিবাহিত ছিল। এটা একটা অস্বস্তিকর কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি। একটি নারী আর একটি পুরুষ দুইজন একসাথে সারা জীবন কাটানোর নিয়ত নিয়েই বিবাহ করে। বিবাহের অংশ হচ্ছে পরস্পরের প্রতি একগামি-বিশ্বস্ততার প্রতিজ্ঞা। এই বিশ্বস্ততার প্রতিজ্ঞা সকলের ক্ষেত্রে সবসময় অটুট থাকে না। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই স্বামী ও স্ত্রী পরস্পরের প্রতি এই প্রতিশ্রুতিতে অটুট থাকতে পারে না। এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কাজটা একজন পুরুষ যেমন করে সেরকম একজন নারীও করতে পারে। এটা ভালো কি মন্দ, মন্দ হলে কতোটা মন্দ সে কথা আলাদা। কিন্তু এর জন্যে দোষ হলে তো পুরুষটার যতটুকু দোষ, নারীটার দোষ তো তার চেয়ে বেশী হতে পারে না। ধরে নেন যে আমার সেই বন্ধুর বন্ধুটি যে তরুণীটির সাথে প্রেম করেছে, ঘরে এক স্ত্রী থাকতেও ওকে আবার বিবাহ করেছে, সেটা অন্যায় ছিল। অন্যায়টা কি দ্বিতীয়া করেছে? দ্বিতীয়া একা করেছে?
তাইলে গালিটা দ্বিতীয়াকে গালি দিচ্ছ কেনো তোমরা? তাও আবার খানকি বলে? তোমরা বেশ ভদ্র সুশীল হয়েছো, ভাল কথা, তোমাদের সামনে দুইটা বাচ্চা একজন মহিলাকে খানকি বলে গালি দিতে থাকল, তোমরা ওদেরকে এইটা বলা জরুরী মনে করলে না যে ওদেরকে থামাই, বলি যে না, নারীকে এইরকম গালি দেওয়া অন্যায়। আমি যখন বললাম যে এইরকম গালি দেওয়া তো ঠিক না, ওরা বিয়ে করেছে, দুই বিয়ে আমাদের আইনে অনুমোদিত, মুসলমানদের ধর্মে অনুমোদিত। সেটাও না হয় বাদ দিলাম। মেয়েটাকে গালি দেওয়ার কি আছে? তুমি তাকে জাস্টিফাই করতে গেলে! কি আশ্চর্য!
নিজেকে দিয়ে চিন্তা কর। তোমার দুই সন্তান- দুই কন্যা। আমি নিজেও দুই কন্যা সন্তানের পিতা। আমরা কামনা করি যে আমদের মেয়েরা একটিই প্রেম করবে, একটিই বিবাহ করবে, এক পুরুষের সন্তানই গর্ভে ধারণ করবে, একজন পুরুষের সাথেই জীবন কাটাবে। কিন্তু এইরকম নাও হতে পারে। মানুষের জীবন এরকম সরল রেখার মতো হয় না। আমার কন্যা কিংবা তোমার কন্যা, ওরাও যার সাথে প্রথমবার প্রেম করবে তাকেই বিবাহ নাও করতে পারে। আমার কন্যারা একজনকে বিবাহ করে একজনেরই সাথে জীবন কাটাবে সেই নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? কাল যদি তোমার কন্যা দ্বিতীয় বিবাহ করে বা আমার কন্যা বিবাহের পর আরেকজনকে ভালোবেসে সংসার ভেঙে দেয় তাইলে সে কি খুব অভিনব কিছু হবে?
সেরকম পরিস্থিতিতে তোমার কন্যাকে যদি কেউ এইরকম গালি দেয় আমি তো তার জিহ্বা ছিঁড়ে নিতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবো না। আমি এটাও জানি আমার কন্যাকে যদি কেউ সেরকম পরিস্থিতিতে কেউ এইরকম গালি দেয় তুমি তার কল্লা কেটে ফেলতে চাইবে। চাইবে না? তাইলে এই মেয়েটিকে এইরকম গালি দেওয়ার আগে তোমার জিহ্বা কেনো আড়ষ্ট হয়ে গেলো না?
(৪)
না, আমি কাউকে খুব বেশী মহান হতে বলছি না। আমি কেবল আমার বন্ধুদের বলি, মানুষের প্রতি খানিকটা সম্মান রেখে কথাবার্তা বলতে। আর মানুষ মানে কেবল পুরুষ না, নারীও আছে। আমাদের প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতির বাইরে নারী পুরুষের সম্পর্ক যে হয়না তা তো নয়। সেটা যদি অন্যায় হয় তাইলে অন্যায়টা দুইজনেরই। আর যদি অন্যায় মনে না হয় তাইলে তো কোন কথা নাই। শুধু নারীকেই যেন আমরা দোষারোপটা না করি। আর ঐ যেসব শব্দ বলে গালি দেয় মানুষ- একজন মানুষ যদি ভালোবাসে আরেকজনের সাথে মিলিত হয়, হোক সেটা সামাজিক প্রথা প্রতিষ্ঠানের বাইরে- তাতে একটি নারী ঐরকম ইয়ে হয়ে যায় না। মানুষের পার্সোনাল ব্যাপার বলেও তো একটা ব্যাপার আছে, নাকি?
একজন নারীকে চট করে একটা গালি দিয়ে ফেলার আগে, আমার বীরপুরুষ মরাল-পুলিশ বন্ধুরা, মেহেরবানী করে আপনার নিজের জামার ভিতরের মানুষটাকে আর তার অতীত বর্তমানকে একটু দেখে নেবেন। বেশী কথা বলতে চাই না, আমার আবার পেটে কথা থাকে না, কি বলতে গিয়ে কার হাঁড়ি হাটেই ফাটিয়ে দিই ঠিক নাই।
আর আমার এইসব বন্ধুদের স্ত্রী এবং বান্ধবীদের প্রতিও দুইটা কথা বলার আছে। আপনারা কি দেখেন না আপনার পতিখানা বা প্রেমিকখানা নারীকে কি দৃষ্টিতে দেখছে? যে পুরুষ অপরের স্ত্রীকে অবলীলায় খানকি বলে গালি দিয়ে ফেলতে পারে তার চোখে তার নিজের স্ত্রী কি? আপনার স্বামীটি বা প্রেমিকটি কি মনে করেন যে তিনি আপনাকে কিনেছেন? কেনা বাঁদি কেনা বাঁদিই- সেটা ডলার রুপী বা থাই বাথ দিয়ে কেনেন আর দেনমোহর দিয়ে কেনেন। যিনি নারীকে এইরকম কেনাবেচার ধন মনে করেন, ওর ইয়ে বরাবর তিনটা লাথি মারতে পারেন না?
থাক। আর কিছু বলছি না। মেজাজটা ঠিক থাকছে না আজকাল। কখন কি বলে ফেলি। এখন তো আবার ধুম করে লোকে মামলা ফামলা করে দেয়। থাক।