চৈতী আহমেদ

প্রধান সম্পাদক, নারী

আমার ইচ্ছে হলে কেনো আমি মানুষ ছোঁবো না!

মাঝে মাঝে মনে হয় সব ছেড়েছুড়ে কোথাও চলে যাই। দুঃখ, প্রবঞ্চনা, তুড়িতে উড়াই বলে ওরা ভাবে আমার কাছেই সামাধান আছে। অবশ্য নাই বা বলি কি করে? এই যে তারা বলছে -খুব কারো সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে! সত্যি বলছি আমার করাল দিনে এই শেয়ার করার জায়গাটাই কোথাও ছিলো না! এমন দিন গেছে আমার চোখের পানিতে আমার কোলের বাচ্চার জামা ভিজে গেছে। তখন মনে হতো, মানুষের তো টিসুবক্সটা এগিয়ে দেয়ারও কেউ থাকে! আমার তাও নেই।

অফিসে জরুরি মিটিং ছিলো। আমাদের সম্পর্কের প্রতি মায়ের স্বাভাবিক বিরোধীতা এড়িয়ে জ্যাম ঠেলে বাসে ঝুলতে ঝুলতে যখন অফিসে গিয়ে পৌছালাম তখন অফিস এডমিনের অপেক্ষায় অন্যরা। 
মিটিং শেষে সে বেরিয়ে গেলো। ফিরলো একটু পরেই। তার রুমে গেলাম। সে কবি মানুষ। দেখলাম চেয়ার ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে আকাশ দেখছে। একটা টিভি চ্যানেলে তখন একটা কবিতার অনুষ্ঠান করছিলাম। সেটা নিয়ে আলোচনা করা দরকার। আমি বললাম 

-তোমার না বারিধারা যাওয়ার কথা, ফিরে এলে?

-যেতে ইচ্ছে করলো না, এদিকে না তাকিয়েই বললো। অবাক হলাম, দায়িত্বের কাছে ইচ্ছেকে মূল্য দিতে তো দেখিনি খুব! 

-কোনো সমস্যা? 

-আমার সমস্যার খোঁজ নিচ্ছো যে বড়? 
সে তাকাচ্ছে না, তখনও আকাশ দেখছে। কণ্ঠে অভিযোগ স্পষ্ট। 
আমি তোমার সমস্যার খোঁজ নেই না!

-সে খুব নাটকীয় ভঙ্গিতে ফিরলো আমার দিকে। 

-যাও নিজের রুমে যাও, আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। 

-কি হয়েছে আমাকে বলবে না?

-তোমাকে কেনো বলতে হবে? তুমি কি আমাকে সব বলো?

-কি বলি না তোমাকে?!!!!

-পায়ে এমন ব্যথা পেলে বলেছো আমাকে? 
চকিতে তাকাই নিজের পায়ের দিকে। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের নখের কোনায় বেশ খানিকটা রক্ত জমে আছে। বাস থেকে নামার সময় কোথায় একটা খোঁচা লেগেছিলো- মনে পড়লো। মিটিংয়ের তাড়া ছিলো তাই পাত্তা দেইনি। পরেতো ভুলেই গেছি। 

-ওহ এটা কখন হলো! রক্ত বেরিয়েছে জানতাম না। 

-তুমি বলোনি, তাই রাগ করে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। যেতে পারলাম না। ফিরতে হলো।

-আরে এটা সিরিয়াস কিছু না

-সিরিয়াস হতো যদি আমার অনুভুতিগুলোর কোনো মূল্য তোমার কাছে থাকতো! 

-কি বলছো? তুমি কি ঝগড়া করতে চাচ্ছো?

ডাক পড়লো রেজাউলের। সেভলন কটন আনা হলো। পুরো অফিসকে টটস্ত করে তার হাটুর উপর আমার পা তুলে শুশ্রূষা চললো আমার আহ্লাদী পায়ের।

ঐ সময়টাতে আমরা ব্যবসায়িক ভাবে একটা কঠিন সময় পার করছিলাম। মাথার ভেতর সমাজ নিয়ে, দেশ নিয়ে নিজেদের লেখালেখি নিয়ে, নাটক নিয়ে, নিজেদের একটা টিভি চ্যানেল নিয়ে সুন্দর সুন্দর সব স্বপ্ন আমাদের মাথার ভেতর।

আমার সব আপত্তি উড়িয়ে দিয়ে এই একাউন্ট সেই একাউন্ট খালি করে চারদিনের মধ্যে গাড়ি কেনা হলো। আমি তাকে বোঝাতে চাইলাম… তার একরোখা ভাব
-আমার বৌ আর বাসে চড়বে না ব্যাস, আমার মা তখনি কেনো জানি না তার নাম পর্যন্ত শুনতে পারতো না। গাড়িতো মা নীচের গ্যারেজে রাখতে দেবে না। সে নিজে গিয়ে পাশের বাড়ির গ্যারেজ ভাড়া করে মাকে হারিয়ে দিলো।

এই প্রেম কাহিনী অনেক লম্বা। যা এখন প্রাসঙ্গিক নয়। 
এই লোকই আমার বাচ্চার জন্মের দিন দশেক আগে আমাকে একা একজন কাজের মহিলার জিম্মায় রেখে ইরানে বেড়াতে চলে গেলো।

সেই সময় খুব কথা বলতে ইচ্ছে করতো! মা হওয়ার অনুভূতিগুলি কাউকে শেয়ার করতে ইচ্ছে করতো। কেউ ছিলো না। কেউ ছিলো না যাকে বলতে পারি ভালোবাসার মানুষটির উপেক্ষার কথা! সেই সময় লিখে লিখে ভরিয়ে ফেলেছি একের পর এক ডায়েরির পাতা।

আজ যখন আমারি মতো মেয়েগুলো ফোনে, ইনবক্সে, এসে বলে আপু আর কিছু না জাস্ট একটু শেয়ার করতে চাই তখন আমি আমার সব জরুরি কাজ ফেলে তাদের কথা শুনতে বসি আকুল হয়ে! ওদের সাথে মেশাই আমার কান্নার রঙ।

এই যে শেয়ারিং এটা সেই জ্যোস্নার ছায়া। নারীতে আমি একটা বিভাগ করেছি "ওলো সই" শিরোনামে যাতে আমার মেয়েরা এসে শেয়ার করতে পারে তাদের কষ্টগুলো, বঞ্চনাগুলো, যেখানে এসে তারা মেশাতে পারে তাদের কান্নার রঙ। কিছুই না, এতে হয়তো খসে পড়বে না পুরুষতন্ত্রের অচলায়তনের একটা বালুও। এই বিভাগে থাকবে না তত্ত্ব বা তথ্যের কচকচানী। শুধু বলে হাল্কা হওয়া। এই হাল্কা হতে না পারার যন্ত্রণায় কত মেয়ে, স্ট্রেস নিতে না পারায় বইতে না পারায় আত্মঘাতি হয়েছে কে রাখে তার হিসাব? আমার গতকাল কেটে গেছে এমনি দু' জনের সাথে কান্নার রঙ মেশাতে মেশাতেই। যাকে সম্ভব পরামর্শ দিয়েছি। যাকে সম্ভব হয়নি তার সাথে মিলিয়েছি আমার কান্নার রঙ।

 -আপু,

এখন এমনি করে কেউ ডাকলে, মোচড় দিয়ে উঠে বুকের ভেতর।এড়িয়ে যেতে চাইলেও পারি না, আপনা আপনি হাত চলে যায় কী-বোর্ডে। খুব বিপন্ন লাগে, আমিতো কাউকে কোনো কুলে পৌঁছে দিতে পারবো না। তবু ডুবন্ত মানুষগুলো খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায়।

 -বলেন

-একটু কথা বলবো, আপনি কি ব্যস্ত? আমি বেশি সময় নেবো না, জাস্ট আমার কিছু কথা বলবো, মেয়েটার কথায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক টান। আমি নিজে থেকে কোনো প্রশ্ন করি না।
-কথা বললে যদি আপনার ভালো লাগে বলেন, এই নেন আমার সব ব্যস্ততা সরিয়ে রাখলাম।

-আপু, মেয়েটা আবারও ডাকে, মনে হলো খুব ফিস ফিস করে লুকিয়ে কথা বলছে। ওর কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে খুব অল্প বয়সের মেয়ে।

-আপু আমি নিউইয়র্ক থেকে বলছি। আপনার লেখা পড়ি, পড়তে ভালো লাগে। খুব বেশি পড়তে পারি না, আমার শাশুড়ি পছন্দ করে না, আমি ফেসবুকে আসি।
নিউয়র্ক বলতে আমার সামনে ভাসে অনেক দূরের খুব আলো ঝলমল আনন্দের এক নগরী।

-আপু, আপনাকে বিরক্ত করছি না তো

-না বিরক্ত করছেন না

-আপু বেশিক্ষণ কথা বলতে পারবো না। আপু আপনাকে মেসেঞ্জারে কল করি? আমি একটু ভাবি

-হ্যাঁ করেন, মেয়েটা কল করে
-আপু… হঠাৎ শুনি মেয়েটি হেঁচকি দিয়ে কাঁদছে

-হ্যালো

-আপু আমার নাক দিয়ে রক্ত পড়তেসে আপু

-সেকি কেনো? কি হয়েছে

-লোকটা আমার নাকে ঘুষি দিসে আমার নাক দিয়ে রক্ত পড়তেসে।

-কে লোকটা?

-আমার স্বামী, দুই বৎসর হইসে ২০১৫ তো এই লোকটা আমাকে বিয়ে করে নিয়ে আসছে দেশ থেকে। আমার এইস এস সি পরীক্ষা ছিলো সামনে দিতে পারি নাই। আমার মাকে বলসে এই খানে আসলে পড়ালেখা করতে দিবে। মিথ্যা বলসে। আপু আমি জোরে কথা বলতে পারতেসি না। আমার ননদ পাশের রুমে নামাজ পড়তেসে।

-আপনি হ্যাজবেণ্ডকে বলেন নাই আপনি লেখাপড়া করতে চান?

-সে ব্যবসা করে, অনেক টাকা, বলে লেখাপড়া করে চাকরি করতে হবে না। 

-বাহ ভালোতো

-ভালো হইতো আপু কিন্তু বলে মেয়েটা থেমে যায়। আমি চুপ করে থাকি সেই আবার বলতে শুরু করে

-আপু সেতো আমাকে ছুঁয়েও দেখে না আপু

-মানে কি? এই না বললেন সে আপনাকে মেরে নাক ফাটিয়ে দিসে।

-হ্যাঁ সে আমাকে সামনে বসাই রেখে কম্পিউটারে ব্লু ফিল্ম দেখে। খুব খারাপ আপু। ঐ গুলি দেখেই তার হয়ে যায়, আমাকে সে ছুঁয়েও দেখে না। তার বয়সও আমার থেকে অনেক বেশি। তার পুরা ফ্যামিলি খুব ধার্মিক। সে নিজেও নামাজ পড়ে রোজা রাখে।

-এখন আমার কি বলা উচিত আমি ভেবে পাই না।

-আপু সে আমাকে ছোঁয় না সেইটা আমি কিছু মনে করি না। কিন্তু আমি ঐসব দেখতে চাই না, আর মাইরও সহ্য করতে পারি না।

-তাকে বলেন আপনি ঐসব পছন্দ করেন না।

-বলসি আপু, সে বলে সে আমার স্বামী, তার কথা আমার শুনতে হবে। অনেক খারাপ খারাপ গালিও দেয়। সে বাসায় আসলে আমার সব জামা কাপড় খুলে রাখতে হয়। কিন্তু জানেন দুই বৎসরে আমি তাকে একবারও জামা কাপড় ছাড়া দেখি নাই। আমার খুব কষ্ট হয় আপু।

-আপনার শাশুড়ি ননদকে বলেন আপনার সমস্যার কথা, আপনার হ্যাজবেণ্ড এর সমস্যার কথা।

-তারা জানে, তারা বলে আমার স্বামী সে যেমন চায় আমার তেমনই চলা উচিত।

-আপনি থাকছেন কেনো ঐ লোকটার সাথে। চলে যান, পুলিশের কাছে যান।

-আমার মায়ের জরায়ুতে ক্যান্সার, বিয়ের সময় বলছিলো আম্মুকে আমেরিকা নিয়ে এসে চিকিৎসা করাবে। এখন বললে খারাপ খারাপ গালি দেয় আর বলে তোর এই রূপ বেঁচে আমেরিকাতে টাকা কামাই করা যাবে না। মাঝে মাঝে যে টাকা পাঠায় তাতে মায়ের চিকিৎসার খরচ হয় না। অশান্তি হবে ভেবে আমার মাও সেই টাকা নিতে চায় না। আমার বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার, বিয়ে করে আলাদা থাকে। মেঝো ভাইটা অটিস্টিক। ছোটো ভাইটা বখে গেছে। মা একটা স্কুলের টিচার ছিলো। এখন অসুস্থতার জন্য কিছু করতে পারে না। আম্মুর চিকিৎসা হবে ভেবে এই বিয়েতে রাজি হইসিলাম। আমার মামারা এই বিয়ে আনসিলো।

-তাই বলে আপনি এই ভাবে কতদিন থাকতে পারবেন?

-জানি না আপু, মাঝে মাঝে আত্মহত্যার কথা ভাবি, কিন্তু আম্মু আর মেঝোভাইটার কথা ভেবে পারি না। আম্মু মারা গেলে আমার মেঝো ভাইটাকে দেখার কেউ থাকবে না। এরা মাঝ মাঝে টাকা দেয়।
মেয়েটা হঠাৎই অস্থির হয়ে উঠে।

-ভালো থাকবেন আপু আমি রাখি

-শোনেন, আপনি ঐ বাড়ি থেকে বের হয়ে যান, ঐ জীবন আপনি মেনে নিয়েন না, না জেনেই আমি হড়বড় করে মেয়েটিকে বলি-পৃথিবীটা অনেক বড় আপনি পুলিশের কাছে যান, গিয়ে বলেন আপনার বিপদের কথা, বলেন আপনার স্বামী আপনার সাথে শোয়ার যোগ্যতা রাখে না। আপনি ঐ লোকটার গিনিপিগ হয়ে আপনার জীবন নষ্ট কইরেন না। যে কোনো কাজ জুটাই নেন, আপনার মায়ের ভাইয়ের দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নেন। আপনি পারবেন। আমি এখানে দেখছি কত আফ্রিকান মেয়েরা ক্লিনিংয়ের কাজ করে দেশে নিজের ফ্যামিলিকে সাপোর্ট দিচ্ছে। তারা একদমই শিক্ষিত না। আপনিও পারবেন। বের হয়ে যান ঐ বাড়ি থেকে। ঐটা কোনো জীবন না। ঐ লোকটার কোনো অধিকার নেই আপনাকে ব্লফিল্ম দেখতে বাধ্য করার। প্লিজ আপনি পুলিশের কাছে যান!

-আপু আমি রাখলাম, আমার শাশুড়ি ঘুম থেকে উঠে গেসে। কিছু মনে কইরেন না আপু। আপনাকে বলে বুকটা হালকা করলাম। আপনার অনেক সাহস আপু। আপনার মতো হইতে ইচ্ছা করে। আমি আপনার লেখা পড়ি। আচ্ছা রাকি আপু বলে মেয়েটা ফোন কেটে দেয়। আমি হতবিহ্বল হয়ে বসে থাকি।

আজ দু’দিন আমি মেয়েটার ফোনের অপেক্ষায় বসে আছি। নিউইয়র্কে আমার এক বন্ধু আছে অনেক বছর, তাকে বলি মেয়েটাকে যেন একটা পথ দেখায়। সে রাজি হয়েছে।  

আজ দু’দিন হলো আমি মেয়েটার ফোনের অপেক্ষায় আছি। পৃথিবীতে কত মানুষের কত রকম বিপন্নতা সব বিপন্নতার সুড়ঙ্গের মধ্যে পাক খেতে খেতে আমি কী-বোর্ডের ‍উপর আঙুল রেখে বাইরে তাকাই- আকাশে গোল একটা নপুংসক চাঁদ। চাঁদ আমাকে মুগ্ধ করে, চাঁদ আমাকে ছুঁয়ে দেখে না। মানুষ তো চাঁদ নয়, আমার ইচ্ছে হলে কেনো আমি মানুষ ছোঁবো না?  

3796 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।