আমার বাড়ি গ্রামে। আমি বড় হয়েছি গ্রামে এবং সিলেট শহরে মামার বাসায়। তাই আমি মোটামুটি গ্রাম এবং শহরের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত আছি। শহরে অনেক টা স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করতে পারলেও গ্রামে এমন চলাফেরা করা যায়না। তার অন্যতম কারন হলো গ্রামের মানুষ অনেক সহজ সরল হলেও অনেক কুসংস্কার আছে।গ্রামের কুসংস্কার গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো কোন হিন্দু লোক মুসলিম ঘরে খেতে পারবেনা। তাতে নাকি জাত থাকবেনা!! আবার কোন মুসলিম লোক কে হিন্দুদের ঘরে খেতে দেওয়া যাবেনা। এবং হিন্দুদের রান্না ঘরেও প্রবেশ করতে দেওয়া হতনা, এতেও নাকি জাত চলে যেত!! আমার মা এনজিও তে কাজ করতেন। সে সুবাদে আমাদের এলাকার কয়েকটা গ্রামের লোক আমার মা কে ডাক্তার দিদি বলে ডাকতেন। আমার মাকে আমাদের আশেপাশের কয়েকটা গ্রামের লোক চিনতেন এবং অনেক সম্মান করতেন। আমাদের ঘর ছিল অঘোষিত ফার্মেসী (বিনামূল্যে)। মা অনেক ধরনের ঔষধ এনে রাখতেন আমাদের ঘরে। গ্রামের কারো জ্বর, কাশী, মাথা ব্যাথা, ডায়রিয়া, আমাশয় হলেই আমাদের ঘরে চলে আসতেন ঔষধ নেওয়ার জন্য।
আমার মায়ের একজন অফিসার ম্যাডাম (মুসলিম) ছিলেন, উনার বাড়ি সুনামগঞ্জ এর তাহিরপুর। উনি একটা ৫০ মটোরসাইকেল নিয়ে ফিল্ড এ কাজ করতেন। তো প্রতিমাসে অন্তত আমাদের এলাকায় আসতেন ৪/৫ বার। কাজ শেষ হলেই উনি চলে আসতেন আমাদের ঘরে। এসেই আমাদের সামনের ঘরের বিছানায় ধপাস করে শুয়েই আমার মাকে অর্ডার করতেন প্রীতি (আমার মায়ের নাম) আর সহ্য হচ্ছেনা, যা আছে তা দিয়েই খাবার দিয়ে দাও। প্রথম দিকে আমাদের কেমন সংকোচ লাগতো উনি একজন অফিসার উনাকে কিভাবে ঘরে যা আছে তা দিয়েই খাওয়াবো। পরে দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। ঘরে যা থাকতো তা দিয়েই উনাকে খাওয়াতেন আমার মা। উনার শাক সবজির প্রতি আলাদা টান ছিল। উনি আমাদের ঘরে আসলে সবচেয়ে খুশি হতাম আমি কারন উনার সাথে কথা বলতে অনেক মজা লাগতো। আর উনার মটরসাইকেল টা তো বোনাস ছিল। প্রথম দিকে আমাদের গ্রামের অনেকেই কেমন চোখে দেখতেন এটা। কিন্তু আমাদের ঘরের কেউ সাম্প্রদায়িক মনমানসিকতার নাই বলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই ছিল। পরে দিয়ে গ্রামে এটা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল।একবার আমি আমার বন্ধু শাকিলের সাথে সিলেট থেকে রাতে ফিরছিলাম আমাদের গ্রামের বাড়িতে। রাত ১১ টায় এসে পৌছেছিলাম আমাদের পাশের গ্রামের রেল স্টেশনে। পৌছার পর শুরু হলো ঝড় আর তুফান। রে স্টেশন এর পাশেই শাকিলের বাড়ি তাই চলে গেলাম তাঁর বাড়িতে। রাতে ফ্রেস হয়ে যখন খাবার জন্য ডাকলেন কাকী (শাকিলের আম্মু কে কাকী ডাকতাম) তখন আমি গেলাম তাঁদের খাবার টেবিলে। কাকী আমাকে বললেন বাবা ইলিশ মাছ রান্না করেছি। আমি আর শাকিল খেয়ে দেয়ে তাঁর ঘরে গিয়ে ঘুমালাম। আমার কাছে এটা অনেক স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। এখন গ্রামে অনেকটা কুসংস্কার কমে গেছে। অনেক যায়গায় নাই বললেই চলে।
হিন্দু নাকি মুসলিম এইটা নিয়ে ভাবার কি আছে? সবাই মানুষ এটা মনে করলেই সব কিছু সহজ হয়ে যায়। খাবার খেয়ে জীবন ধারন করে পৃথিবীর সকল প্রাণী। খাবারের কোন জাত থাকতে নেই। তবে হ্যাঁ কারো রুচি না হতে পারে অনেক খাবারেই। যেমন অনেকে অনেক ধরনের মাছ মাংস খায়না। আমি গরু খাইনা তাই বলে যারা গরু খায় তাঁদের কে ঘৃনা করার প্রশ্নই আসেনা। রোজা মাস আসলেই আমাদের ঘরে ইফতারি খাওয়ার একটা নেশা। প্রতি বছর রোজা মাসে ইফতারি খাবার জন্য অনেক আয়োজন থাকে।
আমি দুবাই আসার পর অনেকের সাথেই চলাফেরা করেছি এবং করছি। আমি পেয়েছি অনেক অসাম্প্রদায়িক মানুষ কে। যারা মানুষ কে মানুষ ভাবে। ধর্মের মাধ্যমে আলাদা করে দেখেনা। ধর্ম পালন করেও তাঁরা অসাম্প্রদায়িক। নিজের ধর্ম পালন করে এবং অন্য ধর্মালম্বীদের কে ও সম্মান করে। আমার চেনা কিছু লোক আছেন যারা অনবরত কাজ করছেন অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনে। আমার বিশ্বাস মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া বেশীর ভাগ মানুষ অসাম্প্রদায়িক। কিছু লোক নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগায়। সাধারন মানুষ কে ভুল বুঝায়।
লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক: সংহতি সাহিত্য পরিষদ, আরব আমিরাত শাখা।
(লেখাটি একটি মানবিক বাংলাদেশের দাবিতে #BeHumaneFirst অনলাইন ক্যাম্পিং-এর সৌজন্যে প্রকাশিত)