সুষুপ্ত পাঠক

বাংলা অন্তর্জালে পরিচিত "সুষুপ্ত পাঠক" একজন সমাজ সচেতন অনলাইন একটিভিস্ট ও ব্লগার।

হুমায়ূন আহমেদের নবীজিকে নিয়ে উপন্যাস

হুমায়ূন আহমেদ প্রচন্ডভাবে প্রভাবিত ছিলেন মাওলানা মুহিউদ্দীন খান দ্বারা। মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের বড় পরিচয় তিনি ‘মাসিক মদিনা’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। এই কাগজটি ৫০ বছর ধরে এদেশে নারীদের পর্দায় থাকতে, জিহাদের মাধ্যমে ইসলাম কায়েম করতে, ইসলামের শত্রু ইহুদীনাসারা মুশরিক (হিন্দুদের) বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রচার চালিয়ে গেছে। মাসিক মদিনার এই প্রসঙ্গে পরে আসি, শুরুতে জননন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে খান সাহেবের সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলে নেই-।

মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের প্রতি মুগ্ধতা হুমায়ূন আহমেদ নানা ইন্টারভিউতে অতিতে প্রকাশ করেছিলেন। এর দরূণ হুমায়ূনের প্রতি মাদ্রাসা এবং আলেম সমাজ বরাবরই অমনোযোগী ছিলেন, অর্থ্যাৎ হুমায়ূন আজাদ বা শামসুর রাহমান, শাহরিয়ার কবীরদের যেভাবে নাস্তিক-ইসলাম বিদ্বেষী ধরে তাদের লেখালেখিকে মনিটরিং করতো সেরকম লাল দাগে হুমায়ূন আহমদ কখনই পরেন নি। সম্প্রতি যুগান্তর পত্রিকা তাদের ‘ইসলামী পাতায়’ ফের হুমায়ূন-মুহিউদ্দীন খানের সম্পর্ক নিয়ে রিপোর্ট করায় পুরোনো অনেক জিনিস সামনে চলে আসছে। হুমায়ূন আহমেদদের বাড়িতে ‘মাসিক মদিনা’ পত্রিকা নিয়মিত রাখা হতো। তার বাবা ফয়েজ আহমেদ এবং মা এই কাগজের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। এ থেকে তাদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাস সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায়। ব্যক্তিগত পর্যায়ে মুহিউদ্দীন খানের সঙ্গে হুমায়ূনের বাবা-চাচাদের গভীর সম্পর্ক ছিলো।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু এবং প্রক্রিয়াধীন সময়ে হুমায়ূন আহমেদ এই সংগ্রামের একদম বিপরীত অবস্থানে ছিলেন। তিনি ছাত্রদের ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ শ্লোগানে বিরক্ত এবং অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। জীবনের পরবর্তীকালে তিনি এই বিষয়ে লেখক ইমদাদুল হক মিলনের কাছে তীব্র অনুশোচনা প্রকাশ করেছিলেন। পাকিস্তান ভেঙ্গে যাবার প্রশ্নে আলেমদের সবাই রাজাকার আল বদর বাহিনীতে যোগ দিয়ে গণহত্যায় যোগ দেন নি। যারা দিয়েছিলেন তারাই যুদ্ধাপরাধী। বাকীদের যারা পাকিস্তান ভাঙ্গার বিরোধী ছিলেন এটা তাদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থান। মাওলানা মুহিউদ্দীন খানদের মতো মানুষরা ‘মুসলিম কওমে’ বিশ্বাসী ছিলেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিচয়ে পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে যাওয়া ঈমানের খেলাফ। মুহিউদ্দীন খানের সঙ্গে হুমায়ূনের বাবা ফয়েজ আহমেদের গভীর সম্পর্ক ছিলো। ফয়েজ আহমদ আকস্মিক পাক বাহিনীর হাতে মারা না পড়লে তার অবস্থান বাংলাদেশের পক্ষে থাকত নাকি পাকিস্তানের পক্ষে বলা মুশকিল। এটা প্রায় সব বাঙালি মুসলমানের বেলাতে অবশ্য সত্য। হুমায়ূনের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উদাসিনতায় পারিবারিক আবহ কতখানি প্রভাবিত ছিলো তা অনুমান করা যায়, মাসিক মদিনা পত্রিকার গ্রাহক হওয়া একটা পরিবার গোড়া মুসলিম হতে বাধ্য।

মদিনা পত্রিকায় মাওলানা মুহিউদ্দীন খান জিহাদ সম্পর্কে লিখেছিলেন, আবু বকরের জমানায় যাকাত ও হযরত মুহাম্মদের নব্যুয়ত অস্বীকারকারী (মুরতাদ) মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাহাবীরা অস্ত্র ধারণ করেছিলেন তার দলিল আছে (হজ্ব, কোরবানী, জেহাদ ও তবলীগ প্রসঙ্গ, লেখক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃষ্ঠা-৭৫-৭৬)। তখনো দেশে শামসুর রাহমানের উপর হামলা হয় নি। তসলিমা নাসরিন এবং হুমায়ূন আজাদের মতো প্রকাশ্য ধর্মত্যাগীদের উপর হুলিয়া জারি হয় নি- তারও বহু বছর আগে থেকে মাওলানা মুহিউদ্দীন তার কাগজে দ্বিনী শিক্ষা দিচ্ছেন যে, ইসলাম অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করার দলিল আছে! অর্থ্যাৎ আজকের চাপাতী প্রজন্ম মাসিক মদিনা পত্রিকার উত্তরসুরী বলাই যায়। সেই কাগজের প্রাণপুরুষ মুহিউদ্দীন খানের পাবলিসিটি করতে গিয়ে হুমায়ূন আহমদ একবার মিডিয়াতে বললেন, ‘বইমেলায় সবাই আমার বই নিয়ে ব্যস্ত থাকে আর আমি খুঁজি মুহিউদ্দীন খানের লেখা নতুন বই। এই যে তাঁর লেখা ‘কুড়ানো মানিক’ এটা আমার পড়া সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ’। পুরোটা পড়তে পারেন এখান থেকে- https://www.jugantor.com/islam-life/33951/

হুমায়ূন আহমেদ বাঙালি মুসলমানের স্ববিরোধীতার একটা প্যাকেজ বলা চলে। একই সঙ্গে তিনি রবীন্দ্রনাথ এবং নবীজিকে ভালোবাসেন কিভাবে? শেষ জীবনে হুমায়ূন নামাজ কালাম ধরেছিলেন।

আমেরিকার চিকিৎসা করতে যাবার সময়ও তিনি জায়নামাজ সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। গীতবিতান কিংবা ধূসর পান্ডুলিপি নয়- হুমায়ূনের আমেরিকা যাত্রায় নিত্যসঙ্গী ছিলো মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের লেখা বই ‘স্বপ্নযোগে রসূল’! হাসান রাজা কিংবা লালন ফকিরের মরমি জগত বা রবীন্দ্রনাথের চাঁদের আলোতে ততদিনে সম্ভবত হুমায়ূন আহমেদকে আর মুগ্ধ করে না- কেননা হুমায়ূন আহমদ তখন স্বপ্নে হযরত মুহাম্মদের দেখা পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন! হুমায়ূন আকস্মিক হার্ট এ্যাটার্কে মারা না গেলে আরো অনেকদিন বেঁচে থাকলে আমরা যে তাকে শেষতক কোথায় স্থান দিতাম বলা মুশকিল।

মুসলমানদের মধ্যে যাদের আধুনিক প্রগতিশীল বলে জানি তারা দীর্ঘ জীবন পেলে শংকা থেকে যায় মৃত্যুর আগে হঠাৎ নবীপ্রেমি না হয়ে উঠেন। একজন নারী নিপীড়নকারী, কাফের মুশরিক- এরকম বিভাজনকারী একজন মানুষকে মহান অনুসরণীয় আদর্শ মানুষ হিসেবে চিত্রিত করে এই অন্ধকারাচ্ছন্ন জাতির বারোটা বাজানোটাই হবে তাদের শেষ কাজ। যেমন হুমায়ূন আহমদ ‘নবীজি’ নামে উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলেন!

সীরাত বা নবী জীবনী লেখার জন্য মুহিউদ্দীন খান হুমায়ূন আহমেদকে অনুরোধ করেছিলেন। কথা মতো হুমায়ূন আহমেদ সেটা শুরুও করেছিলেন। সম্ভবত ‘কাঠপেন্সিল’ বইতে তার বিস্তারিত বর্ণনা হুমায়ূন আহমেদ করেছিলেন। হুমায়ূন বইয়ের ছোট একটা অংশ শুরু করে হঠাৎ জেদ ধরলেন তিনি স্বপ্নযোগে নবীজির দেখা না পেলে উপন্যাস আর শুরুই করবেন না! আমাদের আফসোস এরপর হুমায়ূন মারা যাওয়ায় তার উপন্যাস ‘নবীজি’ আমরা পড়তে পারলাম না। সীরাত ও হাদিস থেকে মশলা নিয়ে হুমায়ূন লিখতে শুরু করেছিলেন হযরত মুহাম্মদকে নিয়ে উপন্যাস। এই একজন ধর্মীয় পুরুষের মুখের বয়ান নিয়ে রচিত হাদিস, তার জীবন নিয়ে লেখা সীরত আজ সারা পৃথিবীতে মুসলমানদের সন্ত্রাসী দল গঠন করতে দালিলিক প্রমাণ হিসেবে কাজ করছে।

পৃথিবীতে মুসলিম নারী হিসেবে জন্ম নিয়েই তথাকথিত পর্দার বাধ্যবাধকতার বেড়াজালে পড়ে নিপীড়িত হওয়ার পিছনে এই ধর্মীয় পুরুষের বাণী ও কথিত তার খোদার নির্দেশ অভিশাপের মতো কাজ করে চলেছে। অমুসলিমদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে, তাদের সম্পত্তি গণিমতের মাল হিসেবে লুন্ঠন করে, তাদের নারীদের নিজেদের মধ্যে বিলিবন্টন করে নিয়ে যে ইসলামী খিলাফতের সূচনা ঘটেছিলো তারই দরজা দিয়ে আল কায়দা, তালেবান, আইএস, আনসারুল্লাহ’র মতো দল গড়ে উঠছে। হুমায়ূনের ‘নবীজি’-তে কি বণু কুরাইজার সেই হতভাগ্য কিশোরদের কথা উঠে আসতো যাদের নবীর নির্দেশে হত্যা করা হয়েছিলো? নাভির নিচের চুল দেখে বারো-তেরো বছরের বাচ্চাদের হত্যাকে তার জাদুকরী ভাষাতে কিভাবে মহৎ কাজ হিসেবে ফুটিয়ে তুলতো দেখার স্বাদ ছিলো! কিংবা বাবা-ভাইদের হত্যাকারীর সঙ্গে ইহুদী কন্যা সাফিয়ার সেই রাতেই বাসরঘর যাপনে বাধ্য করাকে হুমায়ূন কিভাবে তার প্রিয় নবীজির পক্ষ নিতো জানতে খুব কৌতূহল হয়। হতে পারে এসব ঘটনা বেমালুম চেপে যেতেন…। এমনিতেই বরাবর কৌতূহল ছিলো মদিনা পত্রিকার সম্পাদক যার প্রিয় লেখক সেই তিনি কিভাবে ব্লগার কিলিং সম্পর্কে মন্তব্য করতেন? …অনুমান করতে পারি অবশ্য, কিন্তু তিনি যা বলেন নি তা বলিই বা কিভাবে!

2070 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।