লীনা পারভীন

কলামিষ্ট

লেখক ও ব্যক্তি হুমায়ুন আহমেদ: একটি ব্যক্তিগত অনুভুতি

হুমায়ুন আহমেদ আমাদের দেশের এই সময়কার একজন জনপ্রিয় লেখক। বই বিক্রির সংখ্যায় সম্ভবত তাঁর কাছে ধারে এখনও কেউ আসতে পারে নি। লেখার গুণগত মানের উঠানামা আছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। একজন লেখকের সকল লেখাই যে গুণগত দিক দিয়ে সব সময়েই একই ধারার হবে সেই বিশ্বাস রাখাও অবৈজ্ঞানিক বলেই মনে করি আমি। অন্তত একটি বই যদি জীবনের কথা বলে, মানুষের কথা বলে সকলের হৃদয়ের কাছে পৌছাতে পারে সেখানেই বুঝতে পারা যায় সেই লেখকের ভিতরে গুণগত মান আছে কী নাই। সৃষ্টিশীল মানুষ হিসাবে তিনি এখনও অনন্য সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।

তরুণ প্রজন্মকে তিনি বই পড়তে শিখিয়েছেন। টেলিভিশনে নাটক মানেই হুমায়ুন আহমেদের নাটকের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো মানুষ। সিনেমাতেও তিনি দেখিয়েছেন মুন্সিয়ানা। গানগুলো হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

মধ্যবিত্ত জীবনের নানা ধরণের টানাপোড়েনকে তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন জীবন থেকে। তার প্রকাশও করতে পেরেছিলেন দক্ষতার সাথে। চরিত্রগুলো সবকটাই আমার আপনার জীবনের মাঝে লুকিয়ে আছে। সাহিত্যের ভাষাকে কতটা সরল ও সাবলীল করলে পাঠকের হৃদয়ে পৌছানো যায় তিনি সেটাকে দেখিয়েছেন। অনেকের কাছেই তাই অনুপ্রেরণার আরেক নাম হুমায়ুন আহমেদ।

লেখক হিসাবে তিনি কতটা কালজয়ী সে হিসাব করতে হলে বেঁচে থাকতে হবে বহুকাল। কারণ কোনো একটি লেখাকে সমসাময়িক অবস্থায় বিবেচনা করতে গেলে ভুল হতে পারে যেহেতু এই কালটাকে আমরা ধারণ করছি, তুলনা করতে পারছি বাস্তবতার সাথে। কিন্তু যখন সময়ের স্রোত সামনে যাবে, কালের পরিক্রময়ায় পরিবর্তন আসবে মানুষের চিন্তার জগতে, ভাবনার আকৃতিতে এবং তাকে কেন্দ্র করে যে জীবন গড়ে উঠবে কেবল তখনই সঠিকভাবে মুল্যায়ণ সম্ভব হয় একটি সময়ের সাক্ষীকে। আমি এভাবেই বুঝতে চাই।

সব ছাড়িয়েও হুমায়ুন আহমেদ একজন ব্যক্তিও বটে। তাঁরও রয়েছে একটি ব্যক্তিগত জীবন। সে জীবনে আছে তাঁর পরিবার পরিজন। ব্যক্তি হুমায়ুনের আজকের হুমায়ুন হয়ে উঠার পিছনের রয়েছে তাঁর প্রথম স্ত্রী গুলতেকিনের এক মারাত্মক প্রভাব। ছিলো ভালোবাসার সম্পর্ক। ছিলো সন্তানেরা। কিন্তু জীবনের মাঝ নদীতে এসে সেই একই হুমায়ুনের নৌকায় একটি নতুন স্রোতের ধাক্কা লাগলো। শাওনের প্রতি তাঁর আবেগকে আমরা যদি সাংসারিক হিসাবে বা জীবনের গতানুগতিক অংকে মিলাতে চাই তবে অবশ্যই সেখানে হুমায়ুন আহমেদ একজন বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া মানুষ। আবার ভিন্ন এক দৃষ্টিতে যদি আমরা দেখতে চাই তবে শাওনের মাঝে তিনি হয়তো নতুন এক প্রাণের সন্ধান পেয়েছিলেন যেটি তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন অনেক বছর ধরে সংসারি হয়ে থাকা গুলতেকিনের মাঝে।

সৃষ্টিশীল মানুষদের জীবনের রং পাল্টায় বিভিন্নভাবে। প্রেম কী শাশ্বত? মনে করি না। চিরজীবন একজন মানুষের প্রতি প্রেমের গভীরতা একই থাকবে বিষয়টা কী আসলেই তেমন? জটিল এক হিসাব। এখানেই হতে পারে তর্ক। তবে আর সংসার কেনো? স্ত্রী/স্বামী/সন্তানের সম্পর্ক কেনো? এর পিছনে কী কোনো প্রেমই নেই? নেই কী স্নেহ ভালোবাসার সম্পর্ক? খুব একটা পরিষ্কার না। তবে মনে হয়, প্রেমের চেয়েও সেখানে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ চলে আসে বেশী।

সাংসারিক অনেক হিসাব নিকাশের মাঝে জাগতিক কর্মকান্ডে একটা সময় হারিয়ে যেতে পারে প্রেমিকের সেই চেনা হৃদস্পন্দন। তবে কী মানুষ প্রেমশূন্য থাকে? সম্ভব নয়। প্রকৃতির মাঝে যারা নিজেকে খুঁজে পেতে চান, যারা সৃষ্টি করতে চান নতুন জীবনের কাহিনী তারা প্রেম ছাড়া বাঁচতে পারে না। শুরু হয় এক ধরণের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের খেলায় নিজের মনকে জয়ী বলে ঘোষনা করতে পারার সাহস বেশীরভাগেরই থাকে না। চাহিদা থাকে কিন্তু কেউ সেটাকে দমন করে স্বৈরাচারী কায়দায়, কেউ মিটাতে চায় পরোক্ষ উপায়ে। হুমায়ুন আহমেদরা হয়তো বেছে নেয় কোনো এক শাওনকে। হয়তো গুলতেকিন যিনি একটা সময় ছিলেন হুমায়ুনের সমস্ত প্রেরণার নাম সেখানেই স্থান পেয়েছে শাওন।

সৃষ্টিশীল মানুষদের সৃষ্টিকেই তাই উদাহরণ হিসাবে গ্রহণ করা উত্তম। তাদেরকে সংসারের জটিল কুটিল হিসাব থেকে মুক্ত করে দেখাতে না পারলে বড্ড প্যাঁচ লেগে যাবে।

 

2328 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।