ইমন সঙ্গীত একাডেমিতে ভারতের জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত গায়িকা ইমন চক্রবর্তীর বসন্ত উৎসব অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানের উপলক্ষ্য ছিলো বাংলার মানুষকে একত্রিত করে গায়িকা ইমনচক্রবর্তীর মা’কে শ্রদ্ধা জানানো। ভারত এবং বাংলাদেশ থেকে বিশিষ্ট শিল্পীরা এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। সমারোহেই এই অনুষ্ঠান পর্ব সফল হলো।
আমার যাওয়ার মূল কারণ ছিলো গায়িকা ইমন চক্রবর্তী। আমার দিদি নয় বছর আগে একটি দুর্ঘটনায় মারা যান। আমি আমার দিদি এবং আমার সব থেকে কাছের বন্ধুটিকে হারিয়ে ফেলেছিলাম।
এই ন’টা বছর ধরে আমি প্রবল স্নেহের অভাবে ভুগেছি। অনেক মানুষের স্নেহ পেয়েছি, কিন্তু দিদি’র স্নেহের অভাব আমি সব সময় অনুভব করেছি।
আমার মধ্যে তীব্র অপূর্ণতা তৈরি হয়েছিলো। গায়িকা ইমনের মাঝে আমি আমার হারিয়ে যাওয়া দিদিকে যেন খুঁজে পেয়েছি। আমি এই স্নেহের লোভ সংবরণ করতে পারি নি। একজন বড় মাপের মানুষ এবং আমি সাধারণ একজন মানুষ এই পার্থক্যটাও আমার কখনো মনে হয় নি ইমনের সাথে মিশে। ইমনও ভীষণ স্নেহশীল। আমার এই আবেগকে সবসময় অবলীলায় প্রশ্রয় দিয়েছেন। আমিও এই স্নেহে মেতে গেছি। এই স্নেহের লোভেই আমি ইমনের সাথে দেখা করতে যাই বসন্ত উৎসবের অনুষ্ঠানে।
অনুষ্ঠানে যাওয়ার পর গায়িকা ইমনের সাথে যখন আমার প্রথমবার দেখা হলো, আমি তীব্র আনন্দ, তীব্র আবেগে অস্থির হয়ে উঠি। একটি ঘোরের মধ্যে সময় কাটাতে শুরু করি। যখন গায়িকা অনেক দূর থেকে আমায় কাছে ডাকে, আমি ছুটে যাই তাঁর কাছে। গিয়েই প্রণাম করি। ইমনও আমাকে দিদির মতো করে স্নেহ করে, আদর করে, জড়িয়ে ধরে। ঐ মুহূর্তে আমি এতটাই আবেগের মধ্যে ছিলাম যে ইমনের পিঠের খোলা জায়গায় আমার হাত চলে যায়। আমি ব্যাপারটি বুঝতে পারি। হাত সরানোর চেষ্টাও করি। কিন্তু আমার হাত যেন তখন স্থির মনে হয়। আমি হাত সরাতে পারি নি।
অনুষ্ঠান পর্বে অনেক আনন্দের মধ্যেও এই ব্যাপারটি আমার গায়ে কাঁটার মত বিঁধতে থাকে। আমার মধ্যে কখনো গোঁড়ামি বাসা বাঁধতে পারে নি। সবসময় নারী সুরক্ষা সচেতনতায় এগিয়ে থেকেছি। আমার আদর্শ আমাকে প্রতিমুহূর্তে নারীর প্রতি হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে শিখিয়েছে। আমার মধ্যে নারী ও পুরুষ বৈষম্যের গোঁড়ামি নেই। আমি এটি খুব ভালো করেই বুঝি যে যেই পরিস্থিতিতে আমি পড়েছিলাম, সেটি নিছকই একটি দুর্ঘটনা। সেখানে আমার কোনো দোষ নেই। গায়িকা ইমনও আমার সাথে কোনো খারাপ আচরণ করে নি এই নিয়ে। বরং আমাকে এরপরও ভীষণ স্নেহ করেছেন, আমার আবদারে আমার সাথে ছবিও তুলেছেন। কিন্তু কোথাও আমার মধ্যে একটি হীনমন্যতা কাজ করছে যে গায়িকা প্রকাশ না করলেও তাঁর মনে কি আমাকে নিয়ে কোনো খারাপ ধারণা উৎপন্ন হলো! সে কি এমন ভাবলো যে আমি মুখে দিদি দিদি বলে ডাকি, অথচ আমি তাঁকে খারাপভাবে ছোঁয়ার চেষ্টা করলাম! এমন যদি তাঁর মনে এসেও থাকে, সেটা তো অমূলক নয়।
(প্রতীকী ছবিতে আমি এবং গায়িকা ইমন চক্রবর্তী।)
আজকাল বাসে, ট্রেনে, রাস্তাঘাটে হামেশায় এমনভাবে নারীর শ্লীলতাহানি করে পুরুষতান্ত্রিক পুরুষেরা। নারীকে তারা যৌনবস্তুর অধিক কিছুই ভাবে না। তাই আজ যদি গায়িকা এমন কিছু ভেবে থাকে, সেটি আমার ক্ষেত্রে ভাবা উচিৎ না হলেও সমাজ পরিস্থিতিতে অমূলক কিছু নয়।
এই একটি হীনমন্যতা আমার মনে তোলপাড় করে তুলছে ওই সময় থেকেই। কোনো নিস্তার পাচ্ছি না। অথচ আমাদের মতো সচেতন মানুষের চিন্তাতে এমনটা হওয়ার কথা নয়।
১) একজন মানুষ, সে নারী হোক বা পুরুষ, সে কেমন পরিধেয় পরিধান করবে, সেটা তার ব্যক্তিস্বাধীনতার আওতায় পড়ে। তাই ওই ঘটনায় গায়িকা ইমনের কোনো দোষ নেই।
২) সম্পর্ক বন্ধুত্বের হোক, বা ভাই বোনের, অন্তরঙ্গ স্নেহ, ভালোবাসার মুহূর্তগুলিতে এমন স্পর্শের মতো ঘটনা ভীষণ স্বাভাবিক। সেখানে কোনোরকম পাপবোধ আসা উচিৎ নয়। কারণ এমন সম্পর্কগুলি ভীষণ নিষ্পাপ হয়।
আমার সাথে ইমনের সম্পর্কও এমনই একটি নিষ্পাপ সম্পর্ক। এরপরও যেহেতু ভার্চুয়াল জগতের বাইরে গিয়ে একটি প্রথম দেখা, পরিচয়ের প্রথমদিন, তাই একে অপরের চিন্তা ও প্রকৃতি সম্পর্কে দু’জনেই অবগত নই। এমন পরিস্থিতিতে সেই মানুষটির আমার সম্পর্কে একটি খারাপ ধারণা হতেই পারে। ঠিক এই চিন্তাটিই আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।
বাসে, ট্রামে, রাস্তাঘাটে নারীর প্রতি এই পুরুষতান্ত্রিক পুরুষ সমাজের যে আচরণ, সেই আচরণে শুধু একজন নারীই লাঞ্ছিত হয় না, একজন পুরুষ যে সমানাধিকারে বিশ্বাসী, তার মাথাও নিচু হয়ে যায় একইভাবে। পুরুষতান্ত্রিক পুরুষ সমাজের অমানবিক আচরণের জন্য সমস্ত পুরুষকেই নারীর ঘৃণার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেনো, সব পুরুষই যেন সমান দোষী হয়ে ওঠে নারীর চোখে। নারীকে যেমন তার প্রতি হওয়া অন্যায়কে নিয়ে বাঁচতে হয়, তেমনই মানবিক চিন্তা পোষণকারী পুরুষগুলিকেও বাঁচতে হয় নারীর চোখে অপরাধী হয়ে।