রীতা রায় মিঠু

লেখক।

গুরুত্বহীন জিরো

আমার বন্ধুলিস্টে দেশের নামী দামী কয়েকজন সম্মানী ব্যক্তি আছেন, তাঁরা আমার বন্ধু লিস্টের 'অলঙ্কার', শোভা। বন্ধুলিস্টের চমক বৃদ্ধি করতে আমিই মাঝে মাঝে নামী দামী, সম্মানী ব্যক্তিদের কাছে বন্ধু অনুরোধ পাঠাই, তাঁদের কেউ আমার অনুরোধটুকু গ্রহণ করেন, কেউ করেন না। যাঁরা আমার অনুরোধ গ্রহণ করেন, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকি, তাঁদের ছবি আমার ফ্রেন্ড লিস্টে অন্যেরা দেখতে পায়, আমি গৌরব বোধ করি।

আমার ফ্রেন্ডলিস্টে শতকরা ৯৯ দশমিক ৯৯ জনই হচ্ছে আমার মতো অনামী অদামী, এই অনামী অদামী বন্ধুগুলো লিস্টে নামী ব্যক্তিদের ছবি দেখে আমাকেও নামী আর দামী ভেবে বসে থাকে।

মূল কথায় আসি, কিছুদিন হলো, কেউ কেউ ইনবক্সে আমায় অনুরোধ করে, আমি তাদের দিদিতো, কারো কাজলা দিদি, কারো বা মল্লিকাদি। অনুরোধ করে তাদের জন্য মোটামুটি ভালো একটা চাকরির সুপারিশ যেন করি, আমারতো অনেক নামী দামী ক্ষমতাবান ব্যক্তির সাথে পরিচয় আছে, সেই দাবীতে।

ছেলেগুলো অনুরোধ করে, আমার কান্না পায়। প্রথম প্রথম তাদের জন্য অনেকের কাছে সুপারিশ করেছি, কিন্তু কারো ভাগ্যে সিঁকে ছিঁড়ে নি। আমি তাদের বলতে পারি নি যে সুপারিশ করতে গিয়ে আমাকে কত ব্যথা হৃদয়ে লুকিয়ে ফেলতে হয়েছে। ছেলেগুলোর সাথে সামনা সামনি পরিচয় নেই, তাতে কি, ওরা আমার অনেক আদরের ভাই। ওরা কেউ অলস নয়, কারো উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে চায় না, সকলেই শিক্ষিত, ভালোভাবে বাঁচতে চায়। ভালো একটা কাজ পেলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে চায়।

আমাকে ওরা দিদির মতো ভালোবাসে। আমিও দিদির মতো করেই ওদের বুঝাই, নিজের চেষ্টায় এগোতে বলি। ওরা আরেকবার শুধায়, "দিদি, তোমারতো কত বড় বড় মানুষের সাথে পরিচয়, একটু বলে দাওনা"।

গতকালও এক ভাই আমায় ইংলিশে লিখলো ঢাকা বেইসড ভালো কোনো কাজের সন্ধান যদি থাকে এবং যদি আমি ওকে হেল্প করতে পারি। ওর ইংলিশ বানান দেখে আমি চমৎকৃত হয়েছি।

ওর সাথে কথা বলে চমৎকৃত হয়েছি, কিন্তু ওকে সরাসরি বলেছি, "আমি নিজেই ওয়ালমার্টের শ্রমিক, আমি শ্রমিক বলেই তোমাদের প্রয়োজন এবং দুঃখ বুঝি। কিন্তু যাঁদের কাছে বলতে বলছো, তাঁরা কেউই তোমার আমার মতো শ্রমিক নন। ওনাদের দরজা আমার থেকে অনেক অনেক দূরে।

আমার লিস্টে ওনাদের নাম দেখে আমাকে কত কেউকেটা ভেবে ফেলেছো, তাই না? তোমার আগে আরও কয়েকজনের জন্য দুই একজনের কাছে অনুরোধ করেছিলাম, লাভের মধ্যে এটুকুই হয়েছে, যদিওবা তাঁরা কেউ আমার সাথে কথা বলেন না, তবুও মাঝে মাঝে আমার দুই একটা ছবিতে, দুই একটা স্ট্যাটাসে 'লাইক' দিতেন, সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে"।

ছেলেটি বললো, "তাহলে থাক দিদি, আমার জন্য তোমাকে আর কাউকে বলতে হবে না।"

তাকে বললাম, "তোমার ইংলিশ এত ভাল, ইংলিশ বানান এত শুদ্ধ, তুমি খুবই মেধাবী। তুমি হতাশা এবং ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলে নতুন করে ভাবো, তুমি পারবে। যাদের লেখায় বানান শুদ্ধ হয়, তারা অনেক মেধাবী হয়। স্বাধীন ব্যবসা শুরু করো নাহয়"।

ছেলেটি বলল, "দিদি thanks for your appreciation. take care & have a nice time. Thanks"

আমার খুব খারাপ লাগছে বলতে, আমি একটা মাকাল ফল। আমি মুখে মুখে অনেক খই, মুড়ি ভেজে ফেলি, আসলে আমি গুরুত্বহীন 'জিরো'। গুরুত্বহীন জিরো অংকের সামনে থাকে, তাতে অংকের মান পরিবর্তন হয় না। অর্থাৎ ১ এর সামনে ০ দিলে ০১ হয়, অর্থাৎ ১ এর মান ১ই থেকে যায়। যদি গুরুত্বপূর্ণ জিরো হতাম, ১ এর পেছনে বসতাম, তাহলে ১ বদলে ১০ করে দিতাম।

আমি কারো কোনো উপকারে আসি নি, শুধু অন্তরের ভালোবাসাটুকু মুখে মুখে সবাইকে বলে যাই। ইচ্ছে করে সবার উপকার করি, কিন্তু বাস্তবে আমি নিরুপায়।

2801 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।