
‘আমার সোনার বাংলা গানটি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। এ গানের রচয়িতা ও সুরকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই গানটি রচিত হয়েছিল। ১২ জানুয়ারি, ১৯৭২ তারিখে মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে এ গানটির প্রথম দশ লাইন সদ্যগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয়সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত হয়’। গানটি নিয়ে শুরু থেকে বিতর্ক ছিল। আমরাও কিছু প্রশ্ন তুলব। তারপূর্বে পুরো গানটিকে পাঠ করে নেয়া যাক।
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি ।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি ॥
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি ॥
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে ।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে—
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি ॥
তোমার এই খেলাঘরে শিশুকাল কাটিলে রে,
তোমারি ধুলামাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি ।
তুই দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে,
মরি হায়, হায় রে—
তখন খেলাধুলা সকল ফেলে, ও মা, তোমার কোলে ছুটে আসি ॥
ধেনু-চরা তোমার মাঠে, পারে যাবার খেয়াঘাটে
সারা দিন পাখি-ডাকা ছায়ায়-ঢাকা তোমার পল্লীবাটে,
তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই, ও মা, তোমার রাখাল তোমার চাষি ॥
ও মা, তোর চরণেতে দিলেম এই মাথা পেতে—
দে গো তোর পায়ের ধুলা, সে যে আমার মাথার মানিক হবে ।
ও মা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে,
মরি হায়, হায় রে—
আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা, তোর ভূষণ ব’লে গলার ফাঁসি’ ।
এহি বাহ্য দৃষ্টি সাধন !
‘আমার সোনার বাংলা’ বাংলাদেশের এই জাতীয়সঙ্গীতটির রচয়িতা কে? এই প্রশ্নে নানাবিধ বিতর্ক থাকলেও রবীন্দ্রনাথের নামেই চলছে গানটি। যদিও অনেকেই গানের সুরের বিষয়ে বলেছেন, ‘তিনি গগন হরকরার আমি কোথায় পাবো তারে’গানটির সুর থেকে নিয়েছেন। গগণের যে সুরটি সাধু সমাজে প্রচলিত আছে সেই সুরের সাথে রবীন্দ্রনাথের গানের সুরের মিল অস্বীকার করবার উপায় নেই।কিন্তু গানটির রচয়িতার প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই, জাতীয়সঙ্গীত হিসাবে রবীন্দ্রনাথের গান আমার সোনার বাংলা যে রবীন্দ্রনাথেরই এমন কোনও প্রশ্ন কোথাও দেখা যায়নি! বর্তমানে গানটির সুরের প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গানের সুরটি গগনের গান থেকে নিয়েছেন। এরকম সিদ্ধান্ত বাক্যে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমাদের কাছে যে প্রশ্নটি তৈরী হয়েছে যার উৎসও হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা গানটিই। প্রশ্নটি কেন উঠছে সে বিষয়ে গোড়ার কথা বলা দরকার।
গত রোজার ইদে ফকির নহির শাহ’র বাড়ীতে যাই গোষ্ঠ বিষয়ক আলাপ এবং ভক্তিযোগের কারণ। সাঁইজী সাধুসংগীত বিষয়ক একটি আলাপে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির রচয়িতা কে’। সাঁইজীর এ প্রশ্নে একটু বিব্রত হয়েছি বটে কিন্তু অধিক কৌতুহল নিয়ে চেয়ে আছি তাঁর দিকে। ফের প্রশ্ন করলেন গানটির রচয়িতা কে? বললাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তবে সুরের বিষয়ে ফয়সালা আছে! সাঁইজী বললেন, এই গানটিকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় অনুপ্রেরণা হিসাবে গেয়েছি।রবীন্দ্রনাথের ভেবে গাইনি। দ্বিজের ভনিতায় গেয়েছি। ওটা যদি ঠাকুরেরই গান হবে তো ভনিতায় ভূষণের নাম কেন?
দ্বিজ ভূষণ চাঁদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি এখনও। সাধুরা ভূষণের কিছু গান করে থাকেন। জনপ্রিয় হওয়া ‘আমি হৃদ মাঝারে রাখবো ছেড়ে যাব না’ গানের কথাও সাধক দ্বিজ ভূষণ চাঁদের। দুঃখের বিষয় হলো অধিকাংশ শিল্পীরা এই গানটিকেও সম্পূর্ণভাবে পরিবেশন করেন না। গানের কথায় বিকৃতি তো রয়েছেই।
কোথায় পাবো তারে এই গানটির রচয়িতা কে সেই প্রশ্নটি আসছে এখানে, রচনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে সুরের বিষয়ে এমনিতেই সমাধান আসবে। এইগানের সুর এবং ঢং মাতৃভক্তিমূলক। শাক্তসংগীতিও বলা যায়। একই ঢংয়ে রামপ্রসাদেরও গান রয়েছে। এই ক্ষেত্রে গানটির মূল রচয়িতার প্রশ্নে ক্ষেত্র সমীক্ষা করা যেতে পারে। যেমন এখানকার গানে কোথাও রচয়িতার নাম রয়েছে গানের শেষ অন্তরায়, আবার কোনও গানের ভেতর রচয়িতার নাম নেই। এই প্রশ্নের পক্ষে বাইরে থেকে তথ্যপঞ্জি যাচাই -বাছাই করা, কিংবা ভিন্ন কোনও যুক্তি এনে গানটির রচয়িতার প্রশ্নে গানটির সাথে যুক্ত করবার প্রয়োজন নেই। গানটি নিজেই বলছে যে, তার রচয়িতা কে! যেমন লালন ফকিরের কোনও কালাম (সাধুরা গান বলেন না, কালাম বলেন) শুনে থাকেন তাহলে দেখেবেন যে, তাঁর অধিকাংশ কালামেই ফকির লালন বলে এবং তিনি সিরাজ সাঁই’য়ের দোহাই দিয়েছেন। এই যে গানের ভেতর নিজের স্বাক্ষ্য দেওয়ার রেওয়াজ, এটা কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুরু, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, এইসব অঞ্চলের সাধুগুরু মহৎদের গান পরিবেশন করার একটা বৈশিষ্ট।কবীরও নিজের নামে ভনিতা দিয়েছেন। ভুল্লে শাহ থেকে অনেক সাধকই নিজেদের নাম ভনিতা করে বলেছেন।‘আমার সোনার বাংলা’ গানেও সে বৈশিষ্ট আছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের গানে এই ভনিতা নেই। রাধারমণ, রামপ্রসাদের গানেও নিজেদের অবস্থান চিহ্নিত করেছেন। গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানের মধ্যে নিজের নামে ভনিতা দিয়েছেন এভাবে যে,‘ও তার বসত কোথায় না জেনে তায় গগন ভেবে মরে’, এখানে ‘গগন ভেবে মরে’ শব্দগুলির মধ্যে দিয়ে নিজের অবস্থা এবং অবস্থান বুঝিয়েছেন, তেমনি ‘আমার সোনার বাংলা গানের মধ্যে দিয়’ দ্বিজ ভূষণ চাঁদ বলেছেন!,‘তোর ভূষণ ব’লে গলার ফাঁসি’। এখানে শুধু ভূষণ ব’লে এই কথা লেখা আছে, দ্বিজ ভূষণ বা দ্বিজ ভূষণ চাঁদ লেখা নাই। যদিও ভনিতা দেখে এই গানের ধরন রচয়িতার নাম আমরা জানতে পারি, ভূষণ নিশ্চই কোনও জামা কাপড়ের নাম নয়, এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও কোনও ছদ্মনাম নয়, ভূষণ একজন ব্যক্তির নাম, রবীন্দ্রনাথ সেই ব্যক্তির নামে কেন নিজ গানের ভনিতা দিতে চাইবেন এটা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়।
আমার সোনার বাংলা গানটির রচনার বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে কিছু বলেছেন? ফকির লালন শাহ কিংবা গগন হরকরা এবং আরো কতিপয় বিশিষ্ট সাধক সঙ্গীত রচয়িতার বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক কিছু লিখলেও আমার সোনার বাংলা গানটির বিষয়ে তিনি নিজে কিছু বলেননি যতটুকু জানতে পেরেছি অর্থাৎ এর রচয়িতা তিনি না অন্য কেহ! যদিও, এই গানটির কোনও পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি। রচনার তারিখও সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ নিজে এই গানের বিষয়ে কোনও বক্তব্য দেননি, কিন্তু তাঁর স্বাক্ষরেই গানটি মুদ্রিত হয়েছিল বঙ্গদর্শন পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যাতে। এ বিষয়ে যতটুকু তথ্য পাওয়া যায়,‘আমার সোনার বাংলা গানটি রচিত হয়েছিল ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। গানটির পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি, তাই এর সঠিক রচনাকাল জানা যায় না (প্রশান্তকুমার পাল, রবিজীবনী, পঞ্চম খণ্ড, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৯০, পৃ. ২৫৮-৫৯)। সত্যেন রায়ের রচনা থেকে জানা যায়, ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে আয়োজিত একটি প্রতিবাদ সভায় এই গানটি প্রথম গীত হয়েছিল। এই বছরই ৭ সেপ্টেম্বর (১৩১২ বঙ্গাব্দের ২২ ভাদ্র) সঞ্জীবনী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরে গানটি মুদ্রিত হয়। এই বছর বঙ্গদর্শন পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যাতেও গানটি মুদ্রিত হয়েছিল। তবে ৭ অগস্ট উক্ত সভায় এই গানটি গীত হওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না(প্রশান্তকুমার পাল, রবিজীবনী, পঞ্চম খণ্ড, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৯০, পৃ. ২৫৮-৫৯)। বিশিষ্ট রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পালের মতে, আমার সোনার বাংলা ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫ অগস্ট কলকাতার টাউন হলে অবস্থা ও ব্যবস্থা প্রবন্ধ পাঠের আসরে প্রথম গীত হয়েছিল (প্রশান্তকুমার পাল, রবিজীবনী, পঞ্চম খণ্ড, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৯০, পৃ. ২৫৮-৫৯)।আমার সোনার বাংলা গানটি রচিত হয়েছিল শিলাইদহের ডাক-পিয়ন গগন হরকরা রচিত আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে গানটির সুরের অণুষঙ্গে। সরলা দেবী চৌধুরানী ইতিপূর্বে ১৩০৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে তাঁর শতগান সংকলনে গগন হরকরা রচিত গানটির স্বরলিপি প্রকাশ করেছিলেন। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের বঙ্গভঙ্গ-সমসাময়িক অনেক স্বদেশী গানের সুরই এই স্বরলিপি গ্রন্থ থেকে গৃহীত হয়েছিল। যদিও পূর্ববঙ্গের বাউল ও ভাটিয়ালি সুরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি ইতঃপূর্বেই হয়েছিল বলে জানা যায়। ১৮৮৯-১৯০১ সময়কালে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদারির কাজে ভ্রমণ ও বসবাসের সময় বাংলার লোকজ সুরের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তা ঘটে। তারই অভিপ্রকাশ রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী আন্দোলনের সমসাময়িক গানগুলি, বিশেষত আমার সোনার বাংলা’, সূত্র।)। বলা হচ্ছে যে রবীন্দ্রনাথের ‘স্বাক্ষরেই গানটি মুদ্রিত হয়েছিল বঙ্গদর্শন পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যাতে’। প্রশ্ন হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ স্বাক্ষরের সাথে তারিখ দেবেন না এটা ভাবা যায় না এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ গান যা ছাপা হতে যাচ্ছে! অথবা যিনি ছেপেছেন তিনি গানের পটভূমি সম্পর্কে, তার সময়কাল সম্পর্কে তথ্যদেবার প্রয়োজন বোধ করেননি!
যখন রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরে গানটি মুদ্রিত হলো তখন এই প্রশ্ন তোলা যথার্থ হবে কী যে গানটি রবীন্দ্রনাথের নয়, যদি গানটি রবীন্দ্রনাথের হয়ে থাকে তাহলে ‘তোর ভূষণ ব’লে গলার ফাঁসি’ এই ভূষণ বলতে যে অনন্ত দিক নির্দেশনা রয়েছে সে বিষয়ক ফয়সালা হওয়া অবশ্য এখনও গবেষণা সাপেক্ষ !