সুষুপ্ত পাঠক

বাংলা অন্তর্জালে পরিচিত "সুষুপ্ত পাঠক" একজন সমাজ সচেতন অনলাইন একটিভিস্ট ও ব্লগার।

গর্বিত অজিল ও মৃত্যু পরওয়ানায় থাকা আফগান নারী ফুটবলাররা

ইউরোপীয়ান ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা উয়েফা যদি এখনি দাওয়াতী ইসলামকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তাহলে খুব সামনেই এক শ্রেণির ফুটবলার হাঁটুর নিচ অব্দি শর্টস পরে খেলার আবদার জানাতে পারে। ব্যাপারটা যে অসম্ভব তা বলতে পারবেন না। ইরানী নারীদের হিজাব ও লং শর্টস পরার আলাদা অনুমতি দেয়ার সঠিক কোনো ব্যাখ্যা বা অবস্থান নেই ফিফার। পুরোটাই ইসলামী শরীয়তের পক্ষে ফিফার নতজানু হওয়া ছাড়া।

নারীর প্রতি একটি বিশেষ মতবাদের অশালীন অবস্থানকে কেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ ক্রীড়া সংস্থা অনুমোদন দিবে? না, বিষয়টা আসলে হালকাভাবে নেয়ার মতো কিছু নয়, আফ্রিকান ও মিডলইস্টের কিছু মুসলিম ফুটবলার যারা ইউরোপীয়ান লীগে খেলছন, তারা খুব সচেতনভাবে ইসলামের তাবলীগ করে চলেছেন ফুটবলকে কেন্দ্র করে। বহুজাতিক ইউরোপীয়ান সমাজে মুসলিম জাতীয়তাবাদকে প্রচারমূলকভাবে তুলে ধরে যে জাতীয়তাবাদ সংকট তৈরির চেষ্টা চলছে সেটা খেলাধূলার মতো বিনোদনের জায়গায় একেবারেই অনাকাঙ্খিত। ফিফা কিংবা উয়েফা কেনো বর্ণবাদী প্রচারকে অনুমোদন দিয়ে যাবে? কোনো সাদা চামড়ার ইউরোপীয়ান খেলোয়ার যদি আজকে বলে ‘আমি সাদা বলে গর্বিত’ তাহলে নির্ঘাৎ ফিফা বা উয়েফা সেই খেলোয়ারকে ছেড়ে দিবে না। আর চারদিকে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাবে ‘বর্ণবাদী’ চিৎকারে। অথচ জার্মানির অজিল কত সহজে বলে ফেলেন, ‘আমি মুসলিম বলে গর্বিত’!আমরা অনেকেই আফগান নারী ফুটবল দলের কথা জানি না। অজিল গর্বিত সে মুসলমান বলে। আর আফগান নারীরা মুসলিম বলেই ফুটবল খেলে আজ মৃত্যু পরওয়ানা নিয়ে আত্মগোপনে! এমনকি আফগান নারী ফুটবল টিমের মার্কিন কোচ সাবেক মার্কিন ফুটবল তারকা কেলি লিন্ডসে প্রাণভয়ে আজতক আফগানিস্থানে পা রাখতে পারেন নি। তিনি ভিডিও কনফেরান্সের মাধ্যমে কোচিং করাচ্ছেন তার শিষ্যদের।

ইসলামী শরীয়তে নারীদের মাঠে গিয়ে খেলাকে সমর্থন করে না। এই বাধ্যবাধকতার কারণেই সাধারণ আফগানরা তাদের নারী ফটবলাদের প্রকাশ্যে থুতু ছিটিয়ে দিয়েছে। মারধোর থেকে শুরু করে হত্যার উদ্দেশ্যে মাইন পেতে রেখেছিলো। এক যুবককে ছুরি মারা হয়েছিলো কারণ তার বোন ফুটবল খেলে! নারী ফুটবলার এবং তাদের পরিবারগুলো সাধারণ আফগানদের কাছে ঘৃণার শিকার যেমন হচ্ছে তেমনি ফান্ডামেন্টালিস্ট মুসলিমদের হাতে সহিংস আক্রমণের ভয়ে সর্বদা তটস্থ থাকছে। ধর্মীয় এই বিশ্বাস, শরীয়তের এই বিধান পৃথিবীর যে কোনো শিক্ষিত মুসলিমকেই বিব্রত করতে পারে। অথচ অজিল ‘মুসলিম’ বলে নাকি গর্বিত!

ইরানী মেয়েদের হিজাব ও লং শর্টস পরে খেলার অনুমোদন দিয়েছে তাদের সরকার। বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের মেয়েদের হিজাব পরে ফুটবল খেলতে হয় না। তবে আফগানিস্থানের মতো বাংলাদেশী কিশোরী ফুটবল টিমকে লোকাল বাসে কটুক্তির শিকার হতে হয়েছে সাধারণ মানুষদের।

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে মেসুত ওজিল, মৌজা ডেম্বলে, রিয়াদ মাহরেজ, পল পগবা ও মোহাম্মদ সালাহ্‌সহ বেশ কিছু আফ্রিকান ও মিডলইস্ট মুসলিম ফুটবলাররা খেলেন। এদের নিজ দেশে প্রচন্ড দারিদ্রতা, অশিক্ষা, অপুষ্টির সঙ্গে আরো একটি বড় সমস্যার নাম ইসলাম। ইসলামী দুটো গ্রুপের সংঘর্ষে গৃহযুদ্ধে দেশছাড়া বহু আফ্রিকান, মধ্যপ্রাচ্যবাসী ইউরোপে এসে দাবী করে তারা একেকজন ‘গর্বিত মুসলমান’! ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জাতীয় দলের হয়ে খেলা মুসলিম ফুটবলার অভিবাসী হিসেবে এসব দেশে আশ্রয় নিয়েছিলো। নিজ দেশে তারা ইসলামী শাসন দেখে এসেছে। কেমন করে ধর্মের বিধান ধরে ধরে মানুষকে নাজেহাল করা হয় তার বাস্তব অভিজ্ঞতা এদের অনেকেরই আছে। মসজিদে বোমা মেরে দুই গ্রুপের মুসলমানদের রক্তের হোলি খেলার কথা এরা জানে না তা নয়। যেমন ইংলিশ লীগের লিভারপুলের মোহাম্মদ সালাহ্‌। মিশরের খেলোয়াড় সালাহ’র অজানা নয় তার নিজ দেশে ধর্মীয় পরিচয় কতখানি ভাগ্য বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠে। কপ্টিক খ্রিস্টানদের মিশরীয়রা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রেখেছে। শিয়া সুন্নি বিভক্তি মিশরে রক্তাক্ত পরিণতির কথাও সালাহের অজানা নয়। তবু সে খেলাকে উছিলা করে ইসলামের তাবলীগ চালাচ্ছে খেলার মাঠে। মিশরের ‘আমিও মুসলিম হবো’ এরকম একটি নওমুসলিম মিশনের আহ্বান গানের প্রচার চালাচ্ছে।

বামপন্থিদের সব সময় দেখতাম খ্রিস্টান মিশনারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতো ‘ওরা মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ধর্মনষ্ট করে’। ‘আমিও মুসলিম হবো’ এরকম গানের পাশ্চত্যের তাত্ত্বিকদের কোনো সাড়া শব্দের কথা জানা নেই। উয়েফা কি ভবিষ্যতে খেলার মাঠে ‘আমিও খ্রিস্টান হবো’ কিংবা ‘আমিও ইহুদী হবো’ এই জাতীয় সাম্প্রদায়িক উস্কানীমূলক গানকে এলাও করবে? আর তাতে যে পরিমাণ ধর্মীয় রেষারেষির সৃষ্টি তৈরি হবে তার দায় কি ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা নিজ কাঁধে নিতে রাজি আছে? ইতিহাসের একটা বড় অংশ ধর্মীয় এবং জাতিগত পরিচয়ের জের ধরে রক্তাক্ত প্রতিশোধমূলক সংঘাতের পরও কেনো এই ধরণের ধর্মীয় চিহ্ন আর আচারকে বিশ্ব ক্রীড়া সংস্থাগুলোর বড় কর্তারা দেখেও না দেখার ভান করছেন? অবিলম্বে খেলোয়ারদের মাঠে ক্রুশ আঁকা, সেজদা কিংবা মোনাজাত নেবার ধর্মীয় আচারণ নিষিদ্ধ করা হোক। যত দ্রুত এটি বিশ্ববাসী বুঝতে সক্ষম হবে তত মঙ্গল।

ইসলামী শাসন একটা জাতি ও দেশের জন্য কতখানি বিপর্যয়ের হতে পারে তার সবচেয়ে বড় চিত্র হতে পারে ইরান আর আফগানিস্থান। আমরা যদি ১৯২০ সালের আফগানিস্থানে একটু চোখ বুলাই আমাদের কারোরই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করবে না এটি সত্যিই আফগানিস্থান কিনা? চোখ বিস্ফরিত করে আসুন আফগানিস্তানের সে সময়কার জনপ্রিয় ইংরেজি সাময়িকী ‘জাভান্দুন’-এর পাতায় একটু চোখ বুলাই।

নিচের ছবিটি ‘জাভান্দুন’ পত্রিকার একটি প্রচ্ছদ।১৯২০ সালে কাবুলে বাস করতো শিক্ষিত প্রগতিশীল আফগানরা। আর জাভান্দুনে লেখালেখি করতেন আফগানিস্থানের প্রগতিশীল লেখক চিন্তাবিদরা। নিচের জাভান্দুনের ভেতরের পাতার একটি ছবিতে তখনকার আফগান নাগরিক জীবনের কিছু চিত্র দেখা যাচ্ছে।যে আফগানিস্থান এখন বিশ্বে এক নিষিদ্ধ দেশ যেখানে ভয়ে কেউ ভ্রমণ করতে চায় না সেই আফগানিস্থান ১৯৫৫ সালে বিমান সার্ভিস চালু করেছিলো কাবুল থেকে তেহরান, দামেস্ক, বৈরুত, আর আংকারা হয়ে জার্মানির ফ্রাংকফুর্ট পর্যন্ত! জাভান্দুনের পাতায় সেই বিমান সংস্থার একটি বিজ্ঞাপন (ছবি নিচে) অতিতের সোনালী দিনের স্মৃতি বহন করে চলেছে।কালো কালো বস্তার মতো বোরখায় ঢাকা আফগান নারীদের পশুর মতো করে থাকতে বাধ্য করার চিত্রটাই আজ বিশ্ববাসীর কাছে আফগানদের একমাত্র পরিচিতি। অথচ মাত্র ১৯৭০ সালে জাভান্দুনের পাতায় আফগান নারীদের যে চিত্র প্রকাশিত হতে দেখা গেছে তা আজ বিশ্বাস করাই কঠিন। নিচের ছবিতে দেখুন জাভান্দুনের পাতায় ১৯৭০ সালের আফগান সমাজের নারীদের একটি ইতিহাস হয়ে থাকা ছবি।আফগানিস্থানে মাদ্রাসার ছাত্রদের হাতে গড়ে উঠা 'তালেবান' যখন ক্ষমতা কেড়ে নেয় তখন জাভান্দুন পড়ার মতন আর কোনো পাঠক অবশিষ্ঠ রইলো না। এমন কি জাভান্দুনের প্রকাশক লেখক সম্পাদক প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালান। বন্ধ হয়ে গেলো পত্রিকা। এখনো জাভান্দুনের দুর্লভ কিছু কপি সংরক্ষিত আছে যা থেকে মাত্র ৫০ বছর আগের একটি প্রগতিশীল দেশ কি করে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় নিমজ্জিত হতে পারে তার প্রমাণ করা যায়। ইউরোপ আমেরিকায় স্বঘোষিত 'গর্বিত মুসলিমদের' কাউকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে এই দগদগে সত্যকে দেখালেই আপনি 'ইসলাম বিদ্বেষী'। মুসলমানদের যেখানে লজ্জি হতওয়ার কথা কাবুল তেহরান আর সৌদি আরবের জন্য, আফগান কিশোরী ফুটবল দলের জন্য সেখানে তারা গর্বিত! এটা কেবল মুসলমানদের জন্য আশংকার কথা নয়, এটা গোটা সভ্যতার জন্য অশনি সংকেত...।

(ছবি সূত্র: বিবিসি)

1934 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।