রাকিবুল ইসলাম

সাংবাদিক,লেখক ও ছাত্র নেতা।

ঘরে বাইরে সমান তালে চলছে নারী নির্যাতন

সরকারি তরফে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে মুখে ফেনা তোলা হচ্ছে একদিকে, অন্যদিকে সেই নারীর ওপরই চলছে নানামুখী নির্যাতন। ঘরের ভেতর কিংবা বাইরে কোথাও নিরাপদ নন নারী সমাজ।

নারী যেন মানুষ নয়, মানবোচিতও নয়, নারীর সঙ্গে তাই যা খুশি করা যায়। সমাজের কথা বলছেন- এ কোন সমাজে বাস করছি আমরা, যেখানে কিনা মা-বোন-প্রিয়তমার সম্মানের দিকে কারো এতটুকু ভ্রুক্ষেপ নেই! নারী মানে দুর্বল, নারী মানে এতটাই সহজলভ্য যে, এখন জন্মদিনের উপাচার হিসেবেও তাকে গছিয়ে দেওয়া যায়।

আমি ঠিক বুঝতে পারি না, কতটা নিচে নামলে তবে পশুর সঙ্গে আমাদের চরিত্রগত আর কোনো ফারাক থাকবে না। প্রাণী হিসেবে আমরা এখন উদ্বাহু হয়ে ভোগের নৃত্য করছি। সেখানে পছন্দের সামগ্রী হিসেবে বেশ বিকোচ্ছে আমাদের নারীরা।

সাম্প্রতিক সময়ে দৈনিক পত্রিকার পাতায় আর সোশ্যাল মিডিয়ায় যে বিষয়টি বার বার চোখে পড়ছে সেটি হলো ‘ধর্ষণ’। তিন অক্ষরের ছোট এই শব্দের ছায়া এতই কুৎসিত যা ব্যাখ্যা করতে গেলেও ভ্রুকুঞ্চন অনিবার্য। ভোগবাদী সমাজে নারীমুক্তির স্লোগানের আড়ালে নারীর অবস্থান আসলে কোথায়? গত কয়েক মাসে ধর্ষণের সংবাদ গুলো বিশ্লেষণে যে চিত্র উঠে এসেছে তা সত্যি ভয়াবহ। এক একটি ধর্ষণ ঘটনা পুরো জাতিকেই লজ্জার কাঁটাতারে বিদ্ধ করছে।

প্রতিদিনই আমাদের দেশের কোথায়ও না কোথায়ও মেয়ে শিশু, কিশোরী ও যুবতী নারীদের ধর্ষণের পর হত্যা বা হত্যার চেষ্টা চলছে। যে সব ধর্ষিতা কিশোরী বা যুবতী নারী প্রাণে বেঁচে যাচ্ছে তাদের জীবনে নেমে আসছে অমানিশা। পরিবার ও সমাজ তাদেরকে ভালোভাবে গ্রহণ করছে না। অথচ তাদের কোনোই অপরাধ নেই। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের স্বীকার নারীরা আত্মগ্লানি সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। অনেক মেয়ে ধর্ষিত হওয়ার পর লোকলজ্জার ভয়ে বিষয়টা পিতামাতাকেও জানাতে ভয় পায়। ফলে ধর্ষকরা পার পেয়ে গিয়ে সমাজে বুক ফুলিয়ে বেড়ায় এবং তারা বারংবার মেয়েদের প্রতি অশালীন আচরণ করতে প্রলুব্ধ হয়।

আমরা বর্তমানে দাবি করছি- সমাজ এগিয়েছে, আধুনিকতা এসেছে। সমাজের কতিপয় মানুষের কর্মকাণ্ডে সমাজ ক্রমেই কলুষিত হয়ে উঠছে। এমনকি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নারী ও শিশুদের ওপর ধর্ষণ ও সহিংসতার মাত্রা লাগামহীনভাবে বেড়ে যাচ্ছে। বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় সহিংসতার শিকার অনেক নারী ও শিশু চাইলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারে না। সহিংসতার শিকার হয়েও তারা তা সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছে। ধর্ষকদের টার্গেট শিশু ও কিশোরী। ২ বছর কিংবা ৫ বছরের শিশুও ধর্ষকের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। যে বয়সে তারা পুতুল খেলে, ধর্ষণ কী তা-ও জানে না, বোঝার মনমানসিকতাও গড়ে ওঠেনি, সে বয়সেই তাকে ধর্ষিত হতে হচ্ছে।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন যে, মূলত দরিদ্র শ্রেণির শিশুরা শ্রমজীবী বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে এ শিশুদের দেখার কেউ থাকে না। নারী গৃহকর্মীরা ধর্ষণের ঝুঁকিতে থাকছে বেশি। অনেকে অজ্ঞতার কারণে আর বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণের পর আদালত বা পুলিশের দোড়গোড়ায় পৌঁছাচ্ছেন না। ফলে এ সব অপরাধ ঘটছেই। অনেক শিশু বা অভিভাবকই জানে না কোথায় অভিযোগ জানাতে হয়। অনেকে দেখছেন অনেক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে কিন্তু বিচার তো হচ্ছে না। পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে মিটমাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

অনেক দেশে কিন্তু দ্রুত বিচার আইনে সাজা হয় এবং মানুষ তা দেখে সচেতন হয়।

প্রতিনিয়ত ঘরে-বাইরে নানাভাবে নির্যাতিত-নিগৃহীত হচ্ছে নারী। পারিবারিক বিরোধ, প্রতিহিংসা, লালসা ও স্বার্থের বলি হচ্ছে শিশুরাও। বর্তমানে পরিবারের সদস্য, শ্বশুরালয়, কর্মস্থলের সহকর্মী ও গৃহকর্তা-কর্ত্রী, কারো কাছেই যেন নিরাপদ নয় নারী-শিশু। নারী ও শিশু নির্যাতনের কঠিন আইন বাংলাদেশে বিদ্যমান। কিন্তু সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ নেই। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, আইনের শাসনের অকার্যকারিতা, প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ প্রভৃতি কারণে আজও নারী ও শিশু ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

কেন ধর্ষকরা এতো বেপরোয়া?

আমাদের দেশে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, কোনো নারী ধর্ষণের  শিকার হলেই সমাজের অঙুলি থাকে নারীর দিকেই। ফলে ধর্ষিতার ঠাঁই মেলে না সমাজ বা পরিবারে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কোনো ভাবেই মেনে নেয় না তাকে। অথচ মেয়েটির কোনো অপরাধই নেই, সে পরিস্থিতির শিকার। ফলে ধর্ষিতা নারী চরম দুর্ভোগে পড়ে হয় আত্মহননের পথ বেছে নেয়, নয়ত বিপথগামী হতে বাধ্য হয়।

এছাড়া রয়েছে পুলিশ ও প্রশাসনের ব্যর্থতা ও উদাসীনতা। অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থতাকে আড়াল করতে আইনি জটিলতাকে দায়ী করা হয়। অথচ সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা বজায় রাখার মূল দায়িত্ব পুলিশের।

গত সাড়ে ৫ বছরে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) সারাদেশে ধর্ষণের যে চিত্র তুলে ধরেছে তা রীতিমতো চমকে ওঠার মতো। তাদের দেয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত সাড়ে ৫ বছরে দেশে ৫ হাজার ২৪৮টি ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।

বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা (বিএমবিএস) বলছে, গত ৬ মাসে ১৪১ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৪ জনকে আর গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪৩ নারী।

শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম বলছে, চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে শুধুমাত্র শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৯৪টি। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৬ জন শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৮ শিশুকে আর ৩ জন শিশু ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে। এছাড়া ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে আরো ২৮ শিশু। চলতি বছরে ৩ মাসে ধর্ষণের শিকার ১৮৭ নারী। দেশে কী হচ্ছে এসব এর শেষ কোথায়? আসুন নারী পুরুষ নয় এক পরিচয়ে এগিয়ে যাই আমরা মানুষ।

প্রতিবাদ হোক সর্বত্র।

1968 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।