দীপনা চাকমা দীপু

লেখক ও একটিভিস্ট।

ঘাতক -১ম পর্ব

সাধারণ হলুদ খামে মোড়ানো একটা চিঠি। তাও আবার ভীষণ হালকা। হতে পারে কয়েক লাইন মাত্র। তাতে কি? বহুদিনের প্রতীক্ষিত একটা ছোট্ট চিঠি আজুলীর জন্য কতটুকু আনন্দের বন্যা বয়ে এনেছে তা একমাত্র আজুলীই জানে। পাশের বাড়ির কলেজ পড়ুয়া ছেলেটি আজ কলেজ থেকে ফিরে সোজা আজুলীর কাছে চিঠিটা পৌঁছে দেয়।

আজুলীর স্বামী তজিম চিঠিটা পাঠিয়েছিলো। হাত বদল হয়ে কলেজ পড়ুয়ার ছেলেটির মাধ্যমে আজ দুপুরে আজুলীর হস্তগত হয়। চিঠিটা পাওয়ার সাথে সাথে আজুলী শয়ন কক্ষে গিয়ে খাম ছিঁড়ে সযত্নে চিঠিটা বের করে। মিষ্টি একটা সম্বোধন ...
"চিক্কো"

অনেক ব্যস্ততার মধ্যে ও তোমার ভাবনা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। জাতির মুক্তির জন্যে দলীয় কাজ সম্পাদন করতে গিয়ে তোমাদের প্রতি কোনো প্রকার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে আজ আমি অক্ষম। তুমি ভালো থাকার চেষ্টা করো, ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করো। নিজের জন্য না হোক অন্তত তোমার শরীরে যে বেড়ে উঠছে তার কথা ভেবে হলে ও খাওয়ার চেষ্টা করো।
তোমাকে ভালবাসা ছাড়া কখনো ভালো খাবার ভালো থাকার এবং ভালো পোশাক দিতে পারি নি এবং পারছিও না । তবু ও ভালো থেকো। আমি ও ভালো আছি।
"তজিম"
ব্যস এইটুকু। লেখার ধরণ দেখে বোঝা যায় ভীষণ তাড়াতে লিখেছে। সম্ভবত নিজের এলাকার কাউকে পেয়ে সে চিঠিটা লিখেছে। তারপর ও আজুলী বার বার চিঠিটা পড়তে থাকে। কোথায় যেন কোন লাইনটা পড়া হয় নি। বার বার খুঁতিয়ে দেখে।

শুধু আজ নয়, যতবারই তজিমের চিঠিগুলো আসে ততবারই সে এমন করে পড়ে। সে জানে তজিম ভীষণ ব্যস্ত থাকে তার দলীয় কাজ নিয়ে। জনগণের সাথে একান্তভাবে মিশে যাওয়া । জাতির জন্য অধিকার আদায় করার লক্ষ্যে আন্দোলন সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করা। ইত্যাদি দলীয় কাজের পাশাপাশি নিরাপত্তা বজায় রাখা ও তার বা তাদের সবসময় সজাগ থাকতে হয়। ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত চরম পর্যায়ে। যে কোনো মুহূর্তে নিজ ভাইয়ের হাতে প্রাণ যেতে পারে। তাছাড়া সেনাবাহিনীর ধর পাকড়, নির্যাতন, মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে ঢোকানোসহ কতকিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে উভয় দল থেকে মারা যাচ্ছে, পঙ্গু হচ্ছে, অপহরণ হচ্ছে, খুন গুম হচ্ছে।

প্রায় একমাস আগে আজুলী অনাগত মা হওয়ার সংবাদটি চিঠিতে লিখে জানিয়েছিলো। অনেক মান অভিমান অনুরাগ অনুযোগ ভরে দীর্ঘ একটা চিঠি লিখেছিলো। সেই চিঠির প্রতিউত্তর আজ সে পেলো খুব সংক্ষিপ্তকারে। তাতেই সে খুশি। তজিম তাকে খুব ভালোবাসে। একজন স্ত্রী হিসেবে স্বামীর কাছে যতটুকু সম্মান শ্রদ্ধা পাওয়ার কথা সে সবকিছু পেয়েছে। শুধু পায় নি আর্থিক নিরাপত্তা।

তজিমরা যদি নিজভূমি থেকে উচ্ছেদ না হতো তাহলে এই আর্থিক অভাবে কষ্ট পেতো না। তজিম যখন অনার্স পড়ছিলো সে সময় তাদের গ্রাম থেকে সামান্য দূরত্বে সেটলার বাঙ্গালী পাড়া থেকে একটা সেটলারের মরদেহ রাতের কোনো এক সময় তজিমদের গ্রামের মাঝখানে রাস্তার ধারে সেটলাররা রেখে আসে। পরেরদিন সকালে সেটলার বাঙ্গালীরাই আবার খুঁজে পাওয়ার ভান করে তজিমদের গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ তুলে। তার কিছুটা সময় পরে কোনো ধরণের আশংকা দেখা দেওয়ার আগেই হঠাৎ করে কয়েক’শো সেটলার দেশীয় অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে তজিমদের গ্রামে হামলা করে।

সম্মুখে যাকে পেয়েছে তাকে কুপিয়েছে মেরেছে নারীদের ধর্ষণ করেছে। তজিমদের গ্রাম ছাড়া ও আশেপাশের বেশ কয়েকটা গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। জিনিসপত্র লুঠ করেছে। ধৃত জুম্মনারীদের একস্থানে জড়ো করে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। তিনমাস বয়সী সন্তানকে নিয়ে পালানোর সময় এক নারীকে ধরে বাচ্চাকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে মেরে ফেলে মৃত শিশুর মরদেহের পাশে মাকে সবাই মিলে ধর্ষণ করে ।

এভাবে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে নিরীহ জুম্মদের মেরে কেটে ধর্ষণ করে বিতাড়িত করে জায়গাজমি দখল করা হয়। সেদিন যে প্রাণ বাঁচিয়ে কোনোমতে পালিয়ে এসেছিলো গ্রাম ছেড়ে আর কোনোদিন ফিরে যেতে পারে নি অনেকের মতো তজিমরাও। সে নারকীয় ঘটনার পর তজিম পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে জাতিকে সেনা সেটলার এবং রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নের হাত রক্ষা করার লক্ষ্যে জুম্ম রাজনীতিতে যোগ দেয়।
তারই সূত্রে ........( চলবে)

2603 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।