দীপনা চাকমা দীপু

লেখক ও একটিভিস্ট।

ঘাতক -২য় পর্ব

তারই সূত্রে তজিম আর আজুলীর পরিচয় ঘটে। দলীয় কাজের দায়িত্ব নিয়ে তজিম আজুলীদের এলাকায় অন্যান্য সহযোদ্ধাদের সাথে অবস্থান করে। মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের মেয়ে আজুলী। তাদের গ্রামের একটা জায়গায় তজিমদের খাবার ঘর। নিজেরাই পালাক্রমে রান্না করে। মাত্র দু’বেলা খাবার খায়। খুবই সাদাসিধে খাবার। আবার অনেকেই ঠিকভাবে রান্নাটা পারতো না বলে খাবার গুলো একেবারে বিস্বাদ লাগে।
আজুলী প্রথমে এসবের কিছু জানতো না, বুঝতো না। রাজনীতি শব্দটাকে সে চিনতোই না। তজিমদের মতো ঘরবাড়ি ছেড়ে জুম্ম জাতির মুক্তি সংগ্রামে সামিল হওয়া বিপ্লবী নেতাকর্মীদের ব্যাপারে তার কোনোদিন আগ্রহ ছিলো না। সে তার পড়ালেখা এবং ভবিষ্যত জীবন গঠন নিয়ে চিন্তা ভাবনায় মত্ত ছিলো।

একদিন সন্ধ্যাবেলায় পার্টির একটা ছেলে দু’জন তরুণীকে সঙ্গে করে আজুলীদের বাড়িতে আসে। জানায়, তরুণীদের থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। ছেলেটি চলে গেলে অতিরিক্ত জায়গা না থাকায় আজুলী তরুণীদের তার শয়নকক্ষে নিয়ে যায়। সৌজন্যতা বশত কুশলাদি বিনিময় করে। ওদের কথাবার্তা ব্যবহার আজুলীর ভালো লাগে। নিজের অজান্তেই তাদের সাথে গভীর কথোপকথনে মিশে যায়।

আজুলীর সাথে ওরা পাবর্ত্য চট্টগ্রামের অতীত ও বর্তমান বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। তারা নারী সংগঠনের কর্মী। পার্টির সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। সরকার, সেনাবাহিনী, সেটলার এবং ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত সম্পর্কে ধারণা দেয়। আজুলীর আত্মকেন্দ্রিক মনে জুম্ম জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম নেয়। জাতির ভবিষ্যত পরিণতি নিয়ে ভাবে।সেই দু"জন নারীকর্মী প্রতিসন্ধ্যায় খাবার খেয়ে আজুলীদের বাড়িতে রাত কাটাতে আসে। আজুলী ভাবে এত তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে কিভাবে সারারাত কাটিয়ে দেয়। তাদের কি খিদে লাগে না? যদি ও প্রতিবার রাতের খাবার খাওয়ার সময় ওদেরকে খাবার খেতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তারা প্রতিবারই সৌজন্যতার সাথে ফিরিয়ে দেয়।

একরাতে আজুলী ওদেরকে জোর পূর্বক ধরে খাবার খেতে বাধ্য করে। খেয়াল করে ওরা খুব মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছে। মনে হয় তারা ক্ষুধার্ত অথবা ঠিকমতো খাওয়া হয় নি। তারপরের দিন সন্ধ্যে বেলায় সে কৌতূহল বশত তাদের সাথে পার্টি খাবার ঘরে খেতে যায়। দেখতে পায় রান্নার পর্ব সেরে রাঁধুনী বাদে বাকি সবাই অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ভাবে বসে খাচ্ছে। আর দু’জন রাঁধুনী পরিবেশন করছে। আজুলীও নারীকর্মীদের সাথে খাবার খেতে বসে। তরকারী বলতে কচু শাক আর পাঁচমিশালী সব্জি। সে যখন এক গ্রাস মুখে দেয় এতই বিস্বাদ যে না পারছে ফেলতে না পারছে গিলতে। একটা তরকারীতে লবণ কম আরেকটাতে ঝোল বেশি আর ভাতগুলো ভীষণ পোড়া গন্ধ। কিন্তু সবাই চুপচাপ খাচ্ছে যেন কতইনা স্বাদের। আজুলী কোনোমতে সেই গ্রাসটুকু খেয়ে আর খেতে পারে নি।

"আমরা প্রতিদিন দু’বেলা এ রকম খাবার খেয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণাধীন অধিকার প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য বছরের পর বছর আন্দোলন করে যাচ্ছি।" হঠাৎ পাশ থেকে একজন ছেলে আজুলীকে উদ্দেশ্য করে বলে। আজুলী ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলেটির দিকে তাকায়। ছেলেটি বিনীত হাসি দিয়ে বলে, হাই আমি তজিম।

সেই প্রথম তজিমের সাথে আজুলীর পরিচয়। এরপর মাঝে মাঝে রাস্তাঘাটে দেখা হয়। কুশলাদি বিনিময় হয়। ভদ্র নম্র বিনীত স্বভাবের তজিমকে স্বাভাবিক ভাবে ভালো লেগে যায় আজুলীর। কিন্তু সেটা যে বিয়ে পর্যন্ত গড়াবে সে কখনো ভাবে নি। কারণ, তাদের দু’জনের মাঝে প্রণয়ের কোনো আভাস দেখা দেয় নি। তজিম কি ভেবেছে সেটা আজুলী জানে না কিন্তু আজুলী ভুল করেও ভাবে নি কোনোদিন দু’জনের বিয়ে হবে। 

দীর্ঘ কয়েকমাস পর আজুলীর বৌদি আজুলীকে একান্তে ডেকে তজিমের সাথে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করে। তজিমের পরিবারের পক্ষ হতে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার জন্য লোক আসতে চায়। আজুলীর পরিবারও রাজী। শুধু মাত্র আজুলীর মতটাই প্রয়োজন। আজুলী কোনোকিছু না ভেবে সরাসরি না বলে দেয়। এরপর পরিবারের সবাই আজুলিকে বোঝায়। জীবন সঙ্গী হিসেবে তজিম আজুলীর জন্য উপযুক্ত পাত্র। অনেক আগে থেকেই তজিমের ব্যক্তিগত পরিচয় পারিবারিক মূল্যবোধ ইতিহাস সবকিছু আজুলীর পরিবার জেনে নেয় যা আজুলী বিন্দুমাত্র টের পায় নি।
তাই সবাই তজিমকে বিয়ে করা উচিত বলে মত দেয়।

যেখানে সবাই একমত সবকিছু জেনে সেখানে আর দ্বিমত করবে বা কেনো। তাই আজুলী বিয়েতে মত দেয়। এরপর কোনো এক শুভক্ষণে আজুলী আর তজিমের পার্টি নিয়মানুসারে অত্যন্ত সাদামাটা ভাবে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়। বিয়ের কয়েক মাস পরে তজিমের অনেক দূরে অত্যন্ত দূর্গম জায়গায় গিয়ে কাজ করার নির্দেশনা আসে। পার্টির নির্দেশনুযায়ী নববিবাহিতা স্ত্রী আজুলীকে নিজ পিত্রালয়ে ফেলে রেখে তজিমকে সেই দূর্গম অঞ্চলে দায়িত্ব পালনের জন্য চলে যেতে হয়।

তজিমের সান্নিধ্য বিহীন বিরহী সময় কাটে আজুলীর। সপ্তাখানেক পর পর তজিমের সংক্ষিপ্ত আকারের চিঠি আসে। সে চিঠিগুলো বার বার পড়ে তজিমকে অনুভব করে। কিন্তু সে অনুরাগ মেশানো দীর্ঘ চিঠি তজিমকে পাঠায়। সবসময় উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকে। একদিকে সেনাবাহিনীর ঘৃণ্য তৎপরতা অন্যদিকে নিজ বিরোধী ভাইদের অতর্কিত হামলায় প্রায়ই নেতাকর্মী মারা যাচ্ছে। দু’দল থেকেই মারা যাচ্ছে। হামলা পাল্টা হামলার কোনো শেষ নেই।

এক সময় আজুলী বুঝতে পারে সে আর একা নয়। তার শরীরে আরেক জনের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। সেই সুখবরটা প্রথমেই সে চিঠির মাধ্যমে তজিমকে জানায়। যার প্রত্যুত্তরে আজকের এই চিঠি।

প্রায় একমাস পর তজিমের আর একটা চিঠি আজুলীর হাতে পৌঁছে। জানিয়েছে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। কবে কখন আসতে পারবে কোনো নিশ্চয়তা নেই। এভাবে শুধুমাত্র চিঠির মাধ্যমে কয়েক মাস যোগাযোগ চলে। আজুলীর গর্ভের সন্তান যখন সাতমাস পূর্ণ হতে চলেছে তখন তজিম লোকমারফত খবর পাঠায় সে কিছুদিনের মধ্যে আসতে পারে। আজুলী খবর শুনে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠে।

কত মাস দেখা হয় না ,কথা হয় না । সে আসলে চোখ ভরে দেখবে , মন ভরে কথা বলবে। এছাড়া আরো কত কি ভেবে রেখেছে। তীর্থের কাকের মতো দরজায় বসে উঠানের দিকে রোজ তাকিয়ে থাকে এই এলো বলে।

একদিন সকালে খবর আসে তজিমকে সেনাবাহিনীরা ধরে নিয়ে গেছে।

(চলমান)….


1418 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।