আমি তোমাদের “চলুন সবাই মানবিক হই/#BeHumaneFirst“ এই স্লোগান ও এই ক্যাম্পেইনকে সমর্থন ও আশীর্বাদ জানাই।
এই ক্যাম্পেইন এখন সফল হওয়া দরকার কারণ মানবতার বিপদ এখন শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এবং ধর্ম উন্মাদনা, বর্ণবিদ্বেষ, গোত্রবিদ্বেষ সাংঘাতিক আকার ধারন করেছে। এটা শুধু মানবতাকেই ধ্বংস করবে না, মানবসভ্যাতাকেও হয়তো বিলুপ্ত করে দেবে। বিশেষ করে বাংলাদেশে এই মানবতার আন্দোলনকে শক্তিশালি করা দরকার।
বাংলাদেশ কিন্তু গত হাজার বছর ধরেই একটি মানবিকতার দেশ, এই দেশে কখনওই ধর্ম উন্মাদনা, উগ্রতা স্থান পায় নি, সেই মধ্যযুগ থেকে শুরু করে একেবারে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত বাংলাদেশে একটি মানবিকতার বহমান স্রোত ছিলো। এখানে শ্রীচৈতন্য এসেছেন, সুফি আওলিয়া এই দরবেশরা এসেছেন , তো এখানে মিলিতভাবে কিছু নতুন ধর্ম সৃষ্টি হয়েছে । সুফি বৈষ্ণবধর্ম এগুলো, এগুলো কোনো হিংস্র ধর্ম নয়, এগুলা মানবতার একটা সম্মিলিত রুপ। ইসলামও এখানে এসে উগ্রতা লাভ করে নি, বরং হোসেনশাহী আমলে মুসলমান শাসক দ্বারাই রামায়ণ, মহাভারত বাংলায় অনুবাদ হয়। এইযে একটা ব্যাপার ছিলো, আমরা আমাদের প্রতিবেশী হিন্দুদের কাকাবাবু, জ্যাঠাবাবু ডাকতাম, তারা হয়তো আমাদের বাবাদের চাচা ডাকতেন, সরস্বতী পূজায় আমরা যেয়ে মিষ্টি খেতাম। তারা আমাদের ঈদে আসতো, কোনো সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি ছিলো না।
এই ভেদবুদ্ধি অনেক পরে এসেছে, এই দেশভাগের আন্দোলন শুরু হওয়ার পরে। হিন্দু মহাসভা মুসলিমলীগ এইসব সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান তৈরি হওয়ার পরে এইসব ভেদ-বুদ্ধি হয়েছে। ব্রিটিশদের ও পরিকল্পনা ছিলো যেটার কারণে তারা বিভেদ বাড়িয়ে দেওয়ায় চেষ্টা করেছে। রাজনৈতিক দ্বন্দটাকে হিন্দু মুসলমানের দ্বন্দে পরিণত করার একটা চেষ্টা করেছে।
কিন্তু আমি আমার শৈশব কৈশোরে দেখেছি যে আমাদের গ্রামে কখনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় নি, আমাদের গ্রামে কখনো কোনো হিন্দুর বাড়ি লুট হয় নি, হিন্দুরা পুজা করতে কখনো ভয় পায় নি, মসজিদে আমরা আযান দিয়েছি, পাশেই মন্দিরে উলুধ্বনি হয়েছে, শঙ্খধ্বনি হয়েছে, কেউ কারো ধর্মে বাধা দেয় নাই। অর্থাৎ আমার ধর্মও বলে ‘লাকুম দ্বীন উকুম উলিয়া দ্বীন’। তোমার ধর্ম তোমার জন্য, আমার ধর্ম আমার জন্য। এটাই তখন প্রচলিত ছিলো। হিন্দুদের দুর্গা পুজায়, কালিপুজায় কেউ বাধা দেয়নি। তাদের সম্পত্তি লুট করে নি, এটা শুরু হয় পাকিস্তান আমলের আগ থেকেই, হিন্দুদের শত্রু ঘোষণা করে তাদের সম্পত্তি লুট করার জন্য আইন করে এসব করা হয়েছে। এটা রাজনৈতিক নেতাদের দুই সম্প্রদায়েরই এবং কিছু ধর্মীয় নেতা যারা কওমি স্বার্থের বাহক, এটা তাদের ষড়যন্ত্রের ফল। এই ষড়যন্ত্র থেকে বাংলাদেশ বের হয়েছিলো বাংলাদেশ মুক্ত করার জন্য এবং বঙ্গবন্ধুর ডাকই ছিলো অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার। এটা আমরা পূরণ করতে পারি নি, তাকে হত্যা করার পর আমাদের সামরিক শাসক ক্ষমতায় আসেন তিনি ছিলেন পাকিস্তানের একজন গোয়েন্দা বিভাগের লোক এবং ক্ষমতায় আসার পরে তিনি দেশকে একটি আধা পাকিস্তান বানাবার চেষ্টা করেছেন। যে স্বাধীনতার শত্রু জামাত, তিনি তাদের পলাতক অবস্থা থেকে ডেকে এনে ক্ষমতায় বসিয়েছেন, ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি বাংলাদেশে শুরু করেছেন। এইযে একটি প্রক্রিয়া, এই প্রক্রিয়ার ফলে আজ বাংলাদেশে ধর্ম উন্মাদনা দেখা দিয়েছে, এটাকে প্রতিরোধ করা না গেলে বাংলাদেশের ঐতিহ্য যেন অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
আজকে খুবই দুঃখের কথা যে ধর্ম নিরপেক্ষতা বা সেকুলারিজমতা নিয়ে অশোক থেকে আকবর পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন, আমরা আজ তাদের নিয়ে গর্ব করি যে, ভারতে অশোক চক্র বা আকবরকে এখনও সম্মান করা হয়। সেই ধর্ম নিরপেক্ষতা আজ বিসর্জিত হয়েছে।
যে কংগ্রেস গত নির্বাচনের আগের নির্বাচনেও সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে নির্বাচনের মূল উপজীব্য করেছিলেন, তার ছেলে রাহুল এখন গুজরাটে গিয়ে শিবসেনা মন্দিরে পূজা দিয়ে নির্বাচনে নামেন। ভারতে হিন্দুত্ববাদ মাথাচাড়া দিয়েছে, বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে। আমেরিকার মতো দেশে “আমেরিকা ফার্স্ট” নাম দিয়ে সেখানে বর্ণবিদ্বেষ এবং শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যাবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যেতো মুসলমানে মুসলমানে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলছে। ইসলামের নানারকম অপব্যাখ্যা দিয়ে জিহাদি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। সর্বত্রই পৃথিবী আজ বিশাল চ্যালেঞ্জের সম্মূখীন।
জীবনানন্দ দাস বলেছিলেন, এমন “অদ্ভুত আধার এক আসিয়াছে নেমে পৃথিবীতে”; -সেই আঁধার কিন্তু এখন প্রকৃতপক্ষেই নেমেছে। এখন যদি আমাদের যুবশক্তিকে এই বিপথগামীতা থেকে ফিরিয়ে না আনা যায়, তাদেরকে মানবতা ধর্মে দিক্ষিত করা না যায়, তারা প্রত্যেকেই কেউ কারো ধর্মে আঘাত না দিয়ে, ধর্মবোধে আঘাত না দিয়ে যে যার ধর্ম পালন করুক। আমাদের দেশে বর্তমানে যে সিভিল সোসাইটি তাদেরকে সরব হতে হবে।
মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, জাতি-উপজাতি এমনকি আস্তিক থেকে নাস্তিক পর্যন্ত সবার অধিকার আছে। আমরা বলতে পারি না কাউকে নাস্তিক বলে তাকে মারার বা তাকে নাগরিক অধিকার বঞ্চিত করার কোনো অধিকার আমাদের নাই। মওলানা আকরাম খাঁ ছিলেন পাকিস্তান আমলের একজন শ্রেষ্ঠ আলেম, মুসলিম লীগের নেতা। একবার তাকে বলা হয়েছিলো যে, নাস্তিকেরা যদি সাহিত্য রচনা করে তা কি পাঠ করা যাবে? তিনি বলেছিলেন সেই বিখ্যাত উক্তিটি, আমার এখনও মনে আছে। “নাস্তিক্যবাদ যদি সাহিত্যের বাণী মূর্তি ধারণ করে তাহাকেও আমাদের গ্রহণ করিতে হইবে।”
আজকে মওলানা আকরাম খাঁর মতো মওলানা বাংলাদেশে কয়জন আছেন জানি না। বরং বাংলাদেশে জামাত হেফাজত এর আন্দোলনের যে আধিক্য, ইসলাম নিয়ে অন্যায় অপব্যাখ্যা দেয়া দেখে মনে হয় মানবতা আজ কোথাও নেই। মানবতাকে সম্পুর্নরুপে ঝেটিয়ে বিদায় করে সেখানে ধর্ম উন্মাদনা, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ স্থান পাচ্ছে। কোনো কোনো জায়গায় ভাষা বিদ্বেষের কারণেও সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো হচ্ছে। আজ এর বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার এবং মানুষের কাছে আবার মানবতার বাণী পৌঁছে দেয়া দরকার।
তা যদি না পারা যায় তাহলে পারমাণবিক বোমায় পৃথিবী ধ্বংস হবে না, এই ধর্মান্ধতা আর সাম্প্রদায়িকতার বোমাতেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে, মানবসভ্যতা বিলুপ্ত হবে, এই সাবধান বাণী আপনাদের সকলের জন্য আমি উচ্চারণ করে রেখে গেলাম।
(Published as part of social media campaign #BeHumaneFirst to promote ‘Secularism’ in Bangladesh)