ফরিদ আহমেদ

লেখক, অনুবাদক, দেশে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। দীর্ঘ সময় মুক্তমনা ব্লগের মডারেশনের সাথে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের অনুবাদ করেছেন। বর্তমানে ক্যানাডা রেভেন্যু এজেন্সিতে কর্মরত অবস্থায় আছেন। টরন্টোতে বসবাস করেন।

অজাত আত্মজার প্রতি পত্র-০২

(প্রথম পর্বের পর) মা আমার, পৃথিবীটা সব সময়ই ভয়ে পূর্ণ ছিলো, পূর্ণ ছিলো যন্ত্রণা এবং দুর্ভোগের। প্রতিদিনই খবর আসছে দুর্ঘটনার, দেউলিয়া হবার, যুদ্ধের এবং অনাহারে মৃত্যুর। খবর আসছে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকির, এক নায়কদের উত্থান, আর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত এলাকা থেকে ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষ সকলের গণ নির্গমনের। কোথাও কোথাও পুরো গ্রামের লোকেরাই হারাচ্ছে তাদের গ্রাম, প্রাকৃতিক এবং মনুষ্য-সৃষ্ট দুর্যোগের কারণে। শুধু যে এই সব ধ্বংসাত্মক খবরই আসছে, তা নয় ,আরো বড় বড় দুর্যোগ আসার আশংকার কথা শোনা যাচ্ছে। পানির দুর্লভতা লক্ষ লক্ষ মানুষকে ভোগাবে নিকট ভবিষ্যতেই। সাগর পৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধি ডুবিয়ে দিতে পারে আস্ত কোনো শহরকেই।

 

তারপরেও, আমার সোনাপাখি, আমি চাই তুমি এই বৈরী এবং বিপদসংকুল পৃথিবীতে আসো।

আমি আমার নানির জীবন নিয়ে মাঝে মাঝে চিন্তা করি। সেটা করতে গিয়ে আমি তোমার জন্যও আশাবাদী হয়ে উঠি। আমার নানি জানতো না তাঁর বয়স কতো। আমাদের ধারণা হচ্ছে তিনি মারা গিয়েছিলেন ঊন-নব্বই বছর বয়সে। যখন তিনি মারা যান, তাঁর সন্তানেরা এবং নাতি-নাতনিরা তাঁকে ঘিরে ছিলো। তাঁর জন্যেও জীবন একটা আয়াসসাধ্য ব্যাপার ছিলো। এর মাঝে আনন্দের ক্ষণস্থায়ী মুহূর্ত ছিলো, আবার কখনোবা সেটা ছিলো দীর্ঘস্থায়ী। তিনি যখন আমাকে লালন-পালন করতেন, এমন একটা দিনও পাওয়া যাবে না, যেদিন তিনি মৃত্যুর কথা স্মরণ করেন নাই।

আমার মা, যিনি তোমার নানি, তাঁর জীবনটা অবশ্য তাঁর মায়ের জীবনের চেয়ে সামান্য কিছুটা ভালো ছিলো। আমি যখন তাঁর গর্ভে আসি, সেসময় তিনি শহরে বসবাস করতেন। আমি আগের প্রজন্মের মতো গাছের তলায় জন্মাইনি। আমার নাড়িও তিনি কাটেন নাই নিজে নিজে। ডাক্তার এবং নার্সের উপস্থিতিতে তিনি আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন হাসপাতালে। তবে, আমার জন্ম হয়েছিলো অকালে, অকালজাত আমি। ডাক্তার, নার্স এবং হাসপাতালে আসা আমাদের আত্মীয়স্বজন, সকলেই ধরে নিয়েছিলো আমি মারা যাচ্ছি। তাদের এমনতর ভুল ধারণা অকারণে আসে নাই। জন্মের সময়ে আমার ওজন ছিলো মাত্র ৩.৩ পাউন্ড। মা আমাকে তাঁর পেটের উপর শুইয়ে রাখতেন, আমার পিছন মালিশ করে দিতেন আর চাপাস্বরে গুন গুন করে কথা বলতেন আমার সাথে। হাসপাতালের বিছানার চাদর দিয়ে মা, আমাকে আর তাঁকে মুড়িয়ে নিতেন তখন। আমাকে বাঁচানোর এই এক কৌশল ছাড়া মায়ের আর অন্য কোনো উপায় জানা ছিলো না। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত চলে যেতো। আমার দুর্বল হৃৎপিণ্ড দুর্বলভাবে ধুকধুক করতো। এর মাঝে হুটহাট আমি কেঁদে উঠতাম। এই কান্নাই ছিলো আমার বেঁচে থাকার একমাত্র চিহ্ন। মা আমাকে প্রবলভাবে চেয়েছিলেন। ওরিয়ানার মতো তিনি ভাবেন নাই যে জীবন আমাকে কী দেবে? কিংবা হিংস্রতা, দুর্নীতি, অত্যাচার, অরাজকতা এবং অসংখ্য রোগ-শোক এবং আন্দোলন-বিক্ষোভের মধ্যে জন্মে কী লাভ, এই ভাবনা তিনি ভাবেননি। মা শুধু চেয়েছিলেন আমি বেঁচে থাকি। তারপর জীবন যা খুশি দিক আমাকে।

আমার মা একের পর এক গর্ভধারণ করেছেন। গর্ভপাত হয়েছে, আবার তিনি গর্ভবতী হয়েছেন। সন্তান জন্ম দিয়েছেন, জন্মের পর সন্তান মারা গিয়েছে। আবার তিনি গর্ভবতী হয়েছেন। বাবার সঙ্গে মায়ের যতই বারই তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে, ততো বারই মা আমার গর্ভবতী হয়েছেন। শেষ সন্তানটা তিনি মৃত প্রসব করেছেন। বাচ্চাটার নাম ছিলো মোহাম্মদ। সে বেঁচে থাকলে তোমার ছোট মামা হতো।

এইসব গর্ভধারণ এবং গর্ভপাতের ইতিহাস জানাটা আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। তোমার নানি এবং নানির মায়ের অভিজ্ঞতাগুলোই আমাকে এই পৃথিবীতে তোমাকে আনতে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। এই চার প্রজন্মের নারীদের মধ্যে আমি তোমাকে বিবেচনা করছি চতুর্থ প্রজন্ম হিসাবে। প্রথম প্রজন্ম থেকে চতুর্থ প্রজন্ম পর্যন্ত জীবনযাত্রার মানের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। শুধু যে উন্নতি হয়েছে তাই নয়, আরো উন্নতির সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে।

আমি এখন ওরিয়ানার জগতের বাসিন্দা। এই জগত বিজ্ঞানের জগত। এখন তুমি গর্ভে একেবারে বীজ থাকা অবস্থাতেই তারা তোমার ছবি তোলে। গর্ভবতী নারী প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর ডাক্তারের কাছে যায়। দুই মাস শেষ হবার পরে ডাক্তার বলে, “এটা একটা দারুণ রূপান্তর।” আমি ওরিয়ানার লেখা পড়েছি আর হেসেছি মজা পেয়ে। তোমার নানি হলে বলতেন, “কাফেররা এতো সব জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা নিয়েও জানে যে জীবনের সব অংশই দারুণ এক রূপান্তর।” তোমার নানি যাই বলুক না কেন, এই দারুণ রূপান্তর আসলে জ্ঞান-বিজ্ঞানই আনে। গ্রাম থেকে উঠে আসা ওইসব নারীদের তৃতীয় প্রজন্ম হিসাবে এসব বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে প্রচুর এবং তোমাকে গর্ভে ধারণ করার জন্য অজ্ঞানতাকে উপেক্ষা করারও সক্ষমতা হয়েছে আমার। আমাকে ওরিয়ানার মতোই ভাবতে হবে তুমি নিজেই জন্মাতে চাও কী চাও না। তুমি কি এমন একটা পৃথিবীতে আসতে চাও যেটা জুলুম, ধোঁকাবাজি আর দুর্নীতিতে পরিপূর্ণ? তুমি কি তোমার জীবন চাও? আসতে চাও এই ধরায়?

অন্য পছন্দটা হচ্ছে শূন্যতা এবং নীরবতা, যেটা ওরিয়ানা বলেছেন। তুমি কি শূন্যতা চাও? তুমি যেখানে আছো, সেখানে সেই সুনসান নীরবতাতেই কি তুমি থাকতে চাও? ওই নীরবতার জগত মৃত্যুও নয়, কারণ তুমি তো এখনও জন্মই নাওনি পৃথিবীতে।

ওই সুদর্শনা ভঙ্গুর নারীটি তাঁর বাসায় আমার হাত ধরে বলেছিলেন, “তোমার সন্তানকে জন্মাতে দাও।” তিনি নিজের জন্যও এক উত্তর তৈরি করেছিলেন। সেই উত্তরটা আমাকেও টেনেছিলো গভীরভাবে। যখন তিনি গর্ভবতী হয়েছিলেন, তাঁর আশেপাশের প্রায় সবাই-ই তাঁকে গর্ভপাত করার পরামর্শ দিয়েছিলো। কিন্তু, তিনি সেই সব পরামর্শকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর সন্তান জন্ম নিক এই পৃথিবীতে।

তাঁর অজাত সন্তানকে তাঁর সম্প্রদায় কীভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলো, সেই গল্প ওরিয়ানা আমাকে বলেছিলেন। সেই অনাগত বাচ্চার বাবা, ডাক্তার-নার্স, ফার্মাসিস্ট, তাঁর বস, তাঁর সেরা বন্ধু সবাই সেই বাচ্চার জন্মের বিরুদ্ধে ছিলো। প্রত্যেকেই বলেছিলো, “ঝামেলা মুক্ত হও। গর্ভপাত করাও। নিজের পেশার দিকে নজর দাও।” একজন অবিবাহিত এবং একাকী নারী সন্তান নিতে চাচ্ছে, এটা তাদের কাছে ছিলো দায়িত্বজ্ঞানহীন অপরিণামদর্শী আচরণ। বাচ্চার বাবা গর্ভপাতের জন্য যে খরচ হবে, তার অর্ধেক সে দেবে বলেও প্রস্তাব দিয়েছিলো ওরিয়ানাকে। (অর্ধেক এ কারণে যে তার ধারণা ছিলো গর্ভধারণের অর্ধেক দায়িত্বও ওরিয়ানার।)

 

আমি জানি, আমার চারপাশের লোকেরা ওরিয়ানার লোকদের মতো আচরণ করবে না। আমার ডাক্তার একজন সমকামী ব্যক্তি। আমি তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম তিনি আমার ডিম্বস্ফূটনকে বন্ধ করে দিতে পারবেন কিনা, কিংবা আমার ভ্রূণকে নষ্ট করে দিতে। তাঁর উত্তর ছিলো তিনি পারবেন, কিন্তু আমাকে উপদেশ দিয়েছিলেন এই কাজ না করার জন্য। কারণ আমার বয়স সাঁইত্রিশ। সক্ষম একজন নারী আমি। তিনি বলেছিলেন, “বাচ্চাটা নাও। তুমি সুস্থ এবং সবল নারী। বাচ্চা নষ্ট করার মতো এমন ধ্বংসাত্মক ব্যবস্থা তুমি কেন নেবে তার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছি না।” একজন একাকী নারীর সন্তান নেবার কোনো অসুবিধা থাকতে পারে, এ কথা তিনি একবারও আমাকে বলেননি। আমার বস, যাঁকে আমি পালক বাবা ভাবি, তোমাকে পেটে ধরার পর আমি যে সিদ্ধান্ত নেবো , সেটাকেই তিনি সমর্থন করবেন। আমি চিন্তাও করতে পারি না যে তিনি আমাকে গর্ভপাত করার জন্য প্ররোচিত করছেন। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা, আমার সহকর্মীরা, কেউ-ই আমার সিদ্ধান্তের বিপক্ষে দাঁড়াবে না।

অন্যেরা আমার সিদ্ধান্তের বিপক্ষে দাঁড়াচ্ছে না, এটা ঠিক। আমি মূলত যুদ্ধ করছি নিজের সাথে। তোমাকে আমি শুধু একান্তই নিজের জন্য নেবো, যেমনটা ওরিয়ানা চেয়েছিলেন তাঁর বাচ্চার ক্ষেত্রে, নাকি আমি তোমার বাবাকে বিয়ে করবো। ওরিয়ানা যেমন তাঁর বইতে লিখেছেন, সন্তান নেওয়াটা একান্তই নিজের সিদ্ধান্ত এবং পছন্দ। আমি এর সাথে একমত। এটা শুধু নিজস্ব পছন্দই না, এ হচ্ছে স্বার্থপর এক পছন্দ। আমি তোমাকে আমার জন্য চাই। আমার আনন্দের জন্য, আমার বেঁচে থাকাকে সমৃদ্ধ করতে আমি তোমাকে চাই। আমি যেমন তোমাকে নিঃশর্ত এবং নিঃস্বার্থ ভালবাসবো, সেই একই নিঃস্বার্থ ভালবাসা আমিও ফেরত পাবো তোমার কাছ থেকে। তোমাকে জরায়ুতে ধারণ করার অনুভূতিটা কেমন, সেটা আমি ওরিয়ানার ভাষাতেই বলছি। গর্ভধারণের প্রাথমিক পর্যায় নিয়ে তিনি বলেছেন, “আশংকার সুতীক্ষ্ণ সুই এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে আমার মনোভূমিকে, আবার একই সাথে তা জন্ম দিচ্ছে অপার এক আনন্দের ঢেউ।” তুমি আমার শরীরের ভিতরে আরেকটা জীবন হিসাবে বৃদ্ধি পেতে থাকো, এই অনুভূতিটা আমি চাই। আমি তোমাকে কোলে তুলে নিতে চাই, জড়িয়ে ধরতে চাই বুকের মাঝে। আমি চাই তোমাকে এক নতুন জীবন দিতে। আমি তোমাকে চাই, এবং সেই চাওয়াটা শুধু আমার জন্য।

এর প্রতিদানে আমি তোমাকে কী দেবো? প্রথমত আমি তোমাকে শেখাবো কীভাবে জীবনের পথ বেছে নিতে হয়। মাঝে মাঝে খুব বেশি পছন্দক্রম আমাদের অস্থির করে তোলে, কখনো কখনো আবার ভয়ে জমিয়েও দেয়। তুমি যদি সঠিক পছন্দটা বেছে নিতে পারো এইসব অসংখ্য পছন্দের মধ্য থেকে, তুমি সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে পারবে। এটা তোমার নানি কিংবা নানির মা বা তাদের আগের প্রজন্মেরা পারেনি। তবে, এই কাজটা বেশ কঠিন। একটাই মাত্র পছন্দ থাকা বা কোনো পছন্দই না থাকার চেয়ে অসংখ্য পছন্দের মধ্য থেকে নিজের পছন্দ বেছে নেবার শিক্ষাটা অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ।

চলমান... (প্রথম পর্ব এখানে)

2981 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।