অনুবাদকের নোটঃ আয়ান হারসি আলি তাঁর ‘নোমাড’ বইয়ের পরিশিষ্ট লিখেছেন ‘লেটার টু মাই আনবর্ন ডটার’ নামে। বাংলায় করলে বলা যেতে পারে, ‘অজাত আত্মজার প্রতি পত্র’। পরিষ্কারভাবে এর অনুপ্রেরণা হচ্ছেন বিখ্যাত সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচি। ফালাচি একটা উপন্যাস লিখেছিলেন যার শিরোনাম হচ্ছে ‘লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন’।
আয়ান হারসি আলির ‘লেটার টু মাই আনবর্ন ডটার’-এর বাংলা অনুবাদ এটা। এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় অনুবাদ খুবই দুঃসাধ্য একটা কাজ। অনুবাদ আসলের মতো প্রাঞ্জল হয় না, আড়ষ্টতা থেকে যায়। আমার অনুবাদেও তাই হবে। তারপরেও এই কাজটা করেছি এই ভেবে যে বাংলাদেশে অনেক মানুষই ইংরেজিতে খুব একটা দক্ষ নয়। ইংরেজি ভাষায় কোনো কিছু পড়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না তারা। নিজের ভাষাতে পড়তে চায় সবকিছু।a
অনুবাদের ফলে যে জড়তাযুক্ত ফলাফল আসে, সেটাকে খানিকটা উপশম করার জন্য খানিকটা মুক্ত অনুবাদ করেছি আমি। ইংরেজির সাথে মিলালে আমার এই অনুবাদ হুবহু মিলবে না। মূল অনুবাদের সাথে না মিললেও, মূল ভাবটা ঠিকই পাঠক পাবেন, সে ব্যাপারে নিশ্চিত আমি।
অজাত আত্মজার প্রতি পত্র
মূলঃ আয়ান হারসি আলি
অনুবাদঃ ফরিদ আহমেদ
অসহিষ্ণুতার প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করাটা কাপুরুষতা – আয়ান হারসি আলি
সোনামণি আমার,
অসম সাহসী এবং অসাধারণ এক নারী ওরিয়ানা ফালাচির সাথে আমার পরিচয়পর্ব দিয়েই শুরু করি। ২০০৬ সালের মে মাসের শুরুর দিকে, এক শুক্রবার বিকালে ম্যানহাটনে আমি তাঁর সাথে দেখা করি। তিনি র্যাডিকাল ইসলামের হুমকি নিয়ে অনেক লিখেছেন এবং নানা জায়গায় বক্তব্য রেখেছেন। তাঁর সাথে আমার পরিচয় পরস্পরের পরিচিত এক বন্ধুর মাধ্যমে। পরিচয় হবার পর থেকেই আমি যেন তার সাথে দেখা করি, সেজন্য তিনি বেশ জোরাজুরি করছিলেন। সেই সময়ে তাঁর বিষয়ে আমি শুধু জানতাম যে তিনি অত্যন্ত শক্তভাবে সর্বগ্রাসী ধর্মতত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান এবং নিন্দা করেছেন।
তাঁর বাসায় গিয়ে আমি বেল বাজালাম। দ্রুতই দরজা খুলে গেলো। অত্যন্ত পলকা ধরনের এক নারী আমাকে ঘরে ঢুকতে দিলেন। ছোটখাটো একজন মানুষ তিনি, অত্যন্ত রোগা এবং বিবর্ণ। তিনি আমাকে সম্ভাষণ জানালেন এই বলে, “বাছা, আমার সময় আর বেশি নেই। খুবই ভালো লাগছে যে তুমি আমার সাথে দেখা করতে এসেছো। আমি ক্যান্সারে আক্রান্ত।” অপ্রশস্ত সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তিনি বলতে লাগলেন, “মুসলমানরা আমাকে দমাতে পারেনি, মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট বাহিনীও পারেনি।” তিনি আমাকে ল্যাটিন আমেরিকায় ঘটা একটা ঘটনার কথা বললেন। ব্রাশফায়ারের পর তিনি অনেকগুলো লাশের সাথে দলা পাকিয়ে ছিলেন। মর্গে একজন তাঁকে ঘটনাক্রমে আবিষ্কার করে। তিনি আমাকে তাঁর বিরুদ্ধে করা ইটালিয়ান পাবলিক প্রসিকিউটরের করা মামলার কথাও বললেন। ইসলামের বিরুদ্ধে তাঁর সমালোচনাকে রুদ্ধ করতে ওই মামলা করা হয়েছিলো। “ওই সব অশুভ শক্তি আমাকে দমাতে পারেনি। কিন্তু,ক্যান্সার, এই ক্যান্সার আমার মগজকে কুরে কুরে খাচ্ছে ……” তাঁর কথায় ছন্দপতন ঘটতে থাকে।
তাঁর বসার ঘরে গিয়ে বসলাম আমরা। আমি তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছি, এটাকে উদযাপন করতে ওরিয়ানা বিশালাকৃতির এক শ্যাম্পেনের বোতল নিয়ে এলেন। “তুমি এতো অল্পবয়েসী একটা মেয়ে।” আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বিস্ময়ের সাথে বললেন। আমি শ্যাম্পেনের বোতল খুলতে চাইলাম। তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন, “না, আমি এখনো এটা করতে পারি। আমারই করতে হবে।” শ্যাম্পেনের বোতলের বিশাল আকৃতি এবং তা খুলতে গিয়ে তাঁর হাত কাঁপা দেখে আমি তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেলাম। “না,” তিনি আবারও বললেন শক্তভাবে। “আমি পারবো। আমিই খুলতে চাই।” তিনি আবার কথা বলা শুরু করলেন। তাঁর দেহ ভঙ্গুর, কিন্তু মন অত্যন্ত শক্তিশালী এবং প্রাণবন্ত।
ইটালি, মধ্যপ্রাচ্যে এবং এখন আমেরিকায় তাঁর জীবনপ্রবাহ আমাকে শোনালেন। তারপর এলেন এমন এক বিষয়ে যেটা আমাদের দুজনের পথকে মিলিয়ে দিয়েছে, সেটা হচ্ছে র্যাডিকাল ইসলামের হুমকি। কিন্তু, সেখানেও তিনি স্থির থাকলেন না। অতি দ্রুততায় বিষয় পরিবর্তন করে ফেললেন। “তোমার অবশ্যই বাচ্চা নেওয়া উচিত।” তিনি বললেন। “আমার জীবনের একটা জিনিস নিয়েই আমি শুধু আক্ষেপ করি। আমার কোনো বাচ্চা নেই। আমি একটা বাচ্চা চেয়েছিলাম। এর জন্য চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু সেই চেষ্টাটা অনেক দেরিতে ছিলো। ফলে, ব্যর্থ হয়েছিলাম আমি।” বাচ্চা নেবার জন্য তিনি আমাকে রীতিমতো অনুনয় বিনয় করতে লাগলেন। “একা থাকাটা অনেক কষ্টের। মানুষ তার জীবনে এমনিতেই একা। কখনো সখনো নিঃসঙ্গ হতেই হয়। তারপরেও আমার একটা বাচ্চা থাকলে খুব ভালো হতো। আমার জীবনকে আমি অন্য প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমি যা চেয়েছিলাম, তা করতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। কিন্তু, আমি চাই আমার সেই চাওয়া তোমার হোক। খুব বেশি দেরি হয়ে যাবার আগেই আমি চাই তুমি তোমার নিজের একটা বাচ্চা নাও। ধাবমান অশ্বের মতো সময় দৌড়ায়। আজকে যে বাচ্চাকে তুমি নিচ্ছো না, একদিন তুমি তার জন্য অনুশোচনা করবে।”
তিনি ইটালিয়ান ভাষায় লেখা তাঁর একটা বই আমাকে দিলেন। আমি জানতাম জীবনের অন্য এক গল্প তাঁর বলা বাকি ছিলো আমাকে। কিন্তু, এর মধ্যেই তিনি হয়ে পড়েছেন ক্লান্ত এবং অবসন্ন। দু’বার শুধু বললেন, “বাছা, জীবনকে তুমি তোমাকে অতিক্রম করতে দিও না।” আমি তাঁকে শুভ বিদায় জানাতে চাইলাম। তিনি আমাকে তা করতে দিলেন না। আমাকে আবারও তাঁর বাসায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। আমি যেতে চেয়েছিলাম আবার। তাঁর জ্বলন্ত চোখ, সুতীক্ষ্ণ চোয়াল এবং দৃঢ় সংকল্পপ্রবণ মানসিকতা আমাকে আমার খাদিজা খালার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। চার মাস পরে, ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের পনেরো তারিখ সকালে আমি ওয়াশংটনে আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট এ আমার অফিসে বসে ছিলাম। রেডিওতে শুনতে পেলাম ওরিয়ানা ফালাচি আর নেই। আমি স্পষ্ট মনে করতে পারলাম, তিনি আমাকে বলেছিলেন, “বাছা, আমি যখন মারা যাবো ক্যান্সারে, অনেক লোকই তখন আমার মৃত্যুকে উদযাপন করবে।”
আমি নিজে সেই উদযাপন করাদের দলে নেই। বরং যারা তাঁকে হারানোর জন্য শোক করছে, তাদেরই একজন আমি।
মামণি, ওরিয়ানাই আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে তোমাকে জন্ম দেবার জন্য। যে স্বল্প সময়টা আমি তাঁর সাথে কাটিয়েছি, সেই সময়ে ওরিয়ানা আমাকে তাঁর নিজের গর্ভপাতের কথা বলেছে। এর পর কয়েক মাস পরে আমি তাঁর লেখা ‘লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন’ বইটা পড়েছি। তিনি তাঁর বইতে যে বার্তা দিতে চেয়েছেন সেটা আমার কাছে দু’রকম। মাতৃত্ব হচ্ছে যার যার নিজস্ব পছন্দ এবং নারী-পুরুষের ভালবাসা হচ্ছে ভাঁওতাবাজি। আমি ওরিয়ানার সাথে এক অংশে একমত, অন্য অংশে দ্বিমত রয়েছে আমার। আমার চারপাশে যে সমস্ত নারীরা রয়েছে, মাতৃত্ব তাদের কাছে নিজস্ব পছন্দের নিঃসন্দেহে। কিন্তু অনেক নারীর জন্যই এটা নিজস্ব পছন্দের জিনিস না। নারী-পুরুষের ভালবাসাকেও আমি ওরিয়ানার মতো ভাঁওতাবাজি বলে মনে করি না।
প্রথমেই এসো মাতৃত্ব নিয়ে কথা বলি। তোমার প্র-মাতামহের মা হওয়ার ব্যাপারে খুবই সামান্য নিজস্ব পছন্দ ছিলো। সত্যি কথা বললে তাঁর আসলে কোনো নিজস্ব মতামতই ছিলো না। তাঁর বয়স যখন মাত্র তেরো বছর, তখন একজন বয়স্ক লোকের সাথে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি প্রথম গর্ভবতী হয়েছিলেন। এবং যখন তাঁর বয়স মাত্র ষোল বছর, তিনি যমজ সন্তানের মা হন। তিনি খুব গর্বের সাথে আমাদের বলতেন যে, সন্তান জন্মের পুরো বিষয়টাই তিনি একা সামলেছিলেন। সন্তান জন্মের এই ঘটনা ঘটেছিলো একটা গাছের নীচে। সন্তান জন্ম দেবার পরে সন্তানের নাড়িও তিনি কাটেন। তারপর দুই সদ্যজাত সন্তান নিয়ে তিনি বাড়িতে ফিরে আসেন। শুধু যে সন্তান নিয়েই ফেরেন তা নয়। সাথে করে বাড়ির ছাগল এবং মেষগুলোকেও নিয়ে আসেন। এগুলোকে চরাতেই তিনি বাড়ির বাইরে গিয়েছিলেন। তাঁর এই বিশাল কর্মকাণ্ড দেখে সবার আনন্দিত এবং উল্লসিত হবার কথা ছিলো। গর্ব এবং অহংকারে ফেটে পড়ার কথা ছিলো। কিন্তু, সেটা হয়নি। কারণ, যমজ বাচ্চা দুটো ছেলে সন্তান ছিলো না, ছিলো মেয়ে সন্তান।
তাঁর জীবদ্দশায় শুধু মাতৃত্বই নয়, খুব অল্প জিনিসই তিনি নিজে বেছে নিতে পেরেছেন। ঋতুগুলোও তাদের খেয়াল খুশ মতো আচরণ করেছে। খুব অল্পই বৃষ্টি হতো সেখানে। কাজেই, তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে এক জলাশয় থেকে আরেক জলাশয়ের দিকে ভ্রমণ করতে হতো পানির সন্ধানে। এই যাত্রায় কখনো কখনো বন্য জন্তু আক্রমণ করতো তাঁদের। কখনো বা তাঁরা আক্রান্ত হতো শত্রু গোত্রের দ্বারা। সবুজ চারণভূমি, মরূদ্যান, সামান্য একটু খাদ্য এবং আশ্রয়ের জন্য মানুষ এবং বুনো প্রাণীরা রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে নামতো। আমার নানির জীবন অতিরিক্ত খাবারের বিলাসী জীবন থেকে অপুষ্টি এবং দুর্ভিক্ষের মধ্যে ওঠা নামা করতো। এর মাঝেই আবার আসতো মহামারী। তিনি আমাদের ম্যালেরিয়া সিজনের কথা বলতেন। ম্যালেরিয়া রোগ ছড়াতো মশার কামড়ের মাধ্যমে। মশা তার শিকারের রক্ত খেয়ে সেখানে ম্যালেরিয়ার জীবাণু রেখে বিদায় নিতো। ঘুম থেকে উঠে মায়েরা দেখতো সারারাত জ্বরে ভুগে তাদের বাচ্চারা মরে পড়ে আছে। বিলাপ করতে করতে এরা ছুটে যেতো পাশের কুটিরের দিকে সাহায্যের আশায়। গিয়ে দেখতো সাহায্যতো দুরের কথা, সেই কুটিরেও মরে পড়ে আছে আরেক শিশু। প্রায়শই মাইলের পর মাইল জুড়ে বিস্তৃত জনপদে মড়ক লাগতো। তরুণ-তরুণী, বাচ্চা-বুড়ো, নারী অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে, গায়ে জ্বর এবং মাত্র কয়েকদিন বা সপ্তাহের মধ্যেই মারা যাচ্ছে।
আমার নানি এইসব গল্প বলতেন। অন্য আরো অনেক মহিলার গর্ভবতী হওয়া এবং তাদের সন্তান জন্মদানের গল্প বলতেন। পরিস্থিতির শিকার হয়ে, বিয়ের পিড়িতে বসে বা যুদ্ধের কারণে তাদের সীমাহীন দুর্দশা এবং মৃত্যুমুখে পতিত হবার গল্পও বলতেন। আমার কাছে মনে হতো এটা ছিলো যন্ত্রণার , অস্বস্তিকর পরিবেশ এবং যুদ্ধের এক অনুভূতিহীন চক্র।
দুঃসাহসী, দুরন্ত এবং দুর্দমনীয় ওরিয়ানা ফালাচি তাঁর অজাত বাচ্চাকে লেখা চিঠিতে তাঁর ভয়ের কথা স্বীকার করেছেন। এই ভয় যন্ত্রণা, দুর্ভোগ এবং মৃত্যুর নয়। এই ভয় ছিলো তাঁর অনাগত সন্তানের জন্য। তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন এই ভেবে যে, হিংস্রতা, মৃত্যু, যন্ত্রণা এবং অশেষ দুর্ভোগের এই পৃথিবীতে তাকে আনার জন্য তাঁর সন্তান তাঁকে দায়ী করতে পারে। ওরিয়ানার কাছে জীবন হচ্ছে প্রতি মুহূর্তের প্রচেষ্টা এবং যুদ্ধ, যাকে নবায়ন করতে হয় প্রতিদিন সকালেই। আনন্দ আসে এর মাঝে স্বল্পস্থায়ী সময়ের জন্য। কিন্তু, এর জন্য দাম দিতে হয় প্রচুর পরিমাণে।
মা আমার, পৃথিবীটা সব সময়ই ভয়ে পূর্ণ ছিলো, পূর্ণ ছিলো যন্ত্রণা এবং দুর্ভোগের। প্রতিদিনই খবর আসছে দুর্ঘটনার, দেউলিয়া হবার, যুদ্ধের এবং অনাহারে মৃত্যুর। খবর আসছে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকির, এক নায়কদের উত্থান, আর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত এলাকা থেকে ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষ সকলের গণ নির্গমনের। কোথাও কোথাও পুরো গ্রামের লোকেরাই হারাচ্ছে তাদের গ্রাম, প্রাকৃতিক এবং মনুষ্য-সৃষ্ট দুর্যোগের কারণে। শুধু যে এই সব ধ্বংসাত্মক খবরই আসছে, তা নয় ,আরো বড় বড় দুর্যোগ আসার আশংকার কথা শোনা যাচ্ছে। পানির দুর্লভতা লক্ষ লক্ষ মানুষকে ভোগাবে নিকট ভবিষ্যতেই। সাগর পৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধি ডুবিয়ে দিতে পারে আস্ত কোনো শহরকেই।
তারপরেও, আমার সোনাপাখি, আমি চাই তুমি এই বৈরী এবং বিপদসংকুল পৃথিবীতে আসো।
আমি আমার নানির জীবন নিয়ে মাঝে মাঝে চিন্তা করি। সেটা করতে গিয়ে আমি তোমার জন্যও আশাবাদী হয়ে উঠি। আমার নানি জানতো না তাঁর বয়স কতো। আমাদের ধারণা হচ্ছে তিনি মারা গিয়েছিলেন ঊন-নব্বই বছর বয়সে। যখন তিনি মারা যান, তাঁর সন্তানেরা এবং নাতি-নাতনিরা তাঁকে ঘিরে ছিলো। তাঁর জন্যেও জীবন একটা আয়াসসাধ্য ব্যাপার ছিলো। এর মাঝে আনন্দের ক্ষণস্থায়ী মুহূর্ত ছিলো, আবার কখনোবা সেটা ছিলো দীর্ঘস্থায়ী। তিনি যখন আমাকে লালন-পালন করতেন, এমন একটা দিনও পাওয়া যাবে না, যেদিন তিনি মৃত্যুর কথা স্মরণ করেন নাই।
আমার মা, যিনি তোমার নানি, তাঁর জীবনটা অবশ্য তাঁর মায়ের জীবনের চেয়ে সামান্য কিছুটা ভালো ছিলো। আমি যখন তাঁর গর্ভে আসি, সেসময় তিনি শহরে বসবাস করতেন। আমি আগের প্রজন্মের মতো গাছের তলায় জন্মাইনি। আমার নাড়িও তিনি কাটেন নাই নিজে নিজে। ডাক্তার এবং নার্সের উপস্থিতিতে তিনি আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন হাসপাতালে। তবে, আমার জন্ম হয়েছিলো অকালে, অকালজাত আমি। ডাক্তার, নার্স এবং হাসপাতালে আসা আমাদের আত্মীয়স্বজন, সকলেই ধরে নিয়েছিলো আমি মারা যাচ্ছি। তাদের এমনতর ভুল ধারণা অকারণে আসে নাই। জন্মের সময়ে আমার ওজন ছিলো মাত্র ৩.৩ পাউন্ড। মা আমাকে তাঁর পেটের উপর শুইয়ে রাখতেন, আমার পিছন মালিশ করে দিতেন আর চাপাস্বরে গুন গুন করে কথা বলতেন আমার সাথে। হাসপাতালের বিছানার চাদর দিয়ে মা, আমাকে আর তাঁকে মুড়িয়ে নিতেন তখন। আমাকে বাঁচানোর এই এক কৌশল ছাড়া মায়ের আর অন্য কোনো উপায় জানা ছিলো না। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত চলে যেতো। আমার দুর্বল হৃৎপিণ্ড দুর্বলভাবে ধুকধুক করতো। এর মাঝে হুটহাট আমি কেঁদে উঠতাম। এই কান্নাই ছিলো আমার বেঁচে থাকার একমাত্র চিহ্ন। মা আমাকে প্রবলভাবে চেয়েছিলেন। ওরিয়ানার মতো তিনি ভাবেন নাই যে জীবন আমাকে কী দেবে? কিংবা হিংস্রতা, দুর্নীতি, অত্যাচার, অরাজকতা এবং অসংখ্য রোগ-শোক এবং আন্দোলন-বিক্ষোভের মধ্যে জন্মে কী লাভ, এই ভাবনা তিনি ভাবেননি। মা শুধু চেয়েছিলেন আমি বেঁচে থাকি। তারপর জীবন যা খুশি দিক আমাকে।
আমার মা একের পর এক গর্ভধারণ করেছেন। গর্ভপাত হয়েছে, আবার তিনি গর্ভবতী হয়েছেন। সন্তান জন্ম দিয়েছেন, জন্মের পর সন্তান মারা গিয়েছে। আবার তিনি গর্ভবতী হয়েছেন। বাবার সঙ্গে মায়ের যতই বারই তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে, ততো বারই মা আমার গর্ভবতী হয়েছেন। শেষ সন্তানটা তিনি মৃত প্রসব করেছেন। বাচ্চাটার নাম ছিলো মোহাম্মদ। সে বেঁচে থাকলে তোমার ছোট মামা হতো।
এইসব গর্ভধারণ এবং গর্ভপাতের ইতিহাস জানাটা আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। তোমার নানি এবং নানির মায়ের অভিজ্ঞতাগুলোই আমাকে এই পৃথিবীতে তোমাকে আনতে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। এই চার প্রজন্মের নারীদের মধ্যে আমি তোমাকে বিবেচনা করছি চতুর্থ প্রজন্ম হিসাবে। প্রথম প্রজন্ম থেকে চতুর্থ প্রজন্ম পর্যন্ত জীবনযাত্রার মানের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। শুধু যে উন্নতি হয়েছে তাই নয়, আরো উন্নতির সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে।
চলমান...