৫
আজ সৌমেনের মনটা অদ্ভূত বিষণ্ণ হয়ে আছে। মারিয়াম আকূল হয়ে তার হাত ধরে আছেন। সৌমেনের দীর্ঘ অনেকগুলো দিনের প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। যাকে সে গভীরভাবে ভালোবাসতো, যে মেয়েটা তাকে অকারণেই ছেড়ে গিয়েছিলো, এতদিন অন্য আরেক পুরুষের সাথে প্রেমে মত্ত ছিলো, সেই পুষ্পিতা আবার তার জীবনে ফিরে আসতে চাইছে কিন্তু কিছুতেই সৌমেন সেটা সহজভাবে নিতে পারছে না, তাকে ফিরিয়ে দিতেও পারছে না। মারিয়ামের মনে হলো, এ্ররকম একটা সংকটে এই দুঃখী ছেলেটার পাশে দাঁড়ানো তার অবশ্য কর্তব্য। ছেলেটার কষ্ট দেখে তার মনে হতে থাকে, তার সন্তান যেন কষ্ট পাচ্ছে।
বলবে আমাকে কি হয়েছে?
পুষ্পিতার জীবনটা ভীষণ অন্যরকম ছিলো, সৌমেন শুরু করে। ওর একটা নিষ্ঠুর অতীত ছিলো। তুমি বিশ্বাস করবে না, মেয়েটাকে সেই কৈশোর থেকে তারুণ্যের এতটা পথ হেঁটে আসতে হয়েছে অনেক তিক্ততার মধ্য দিয়ে। পুষ্পকে বেছে নিতে হয়েছিলো, পতিতাবৃত্তির জীবন। কিন্তু সেগুলো সৌমেনের কাছে কোনো বিষয়ই ছিলো না। সে সংস্কারমুক্ত। ভালোবাসা ছিলো তার কাছে অনেক দামী। ভীষণ আগলে রেখেছে সে সময় মেয়েটাকে। শরীর-মনে্র ভালোবাসা দিয়ে ওকে পূর্ণ করে দিতে চেয়েছে।
তাহলে কেনো সম্পর্কটা ভেঙ্গে গেলো? সৌমেন তার প্রেমিকাকে মেয়েপনার দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলো। সে নিজেও তার বয়সীদের মতো শুধু উদ্দাম আবেগে না ভেসে- তার ভালোবাসার উপর ভর করে নিজের সমস্ত মেধাটুকুকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলো। কিছু একটা হয়ে উঠবার জন্য লড়াই শুরু করেছিলো, সাথে সাথে চেয়েছিলো, পুষ্পিতাও যেন তার নিজের জীবনটা আবার গুছিয়ে নেয়। ছেলেটা তার প্রেমিকাকে প্রচণ্ড ভালোবেসেছে কিন্তু কোনো সংকীর্ণতার বেড়া-জালে আটকে রাখতে চায়নি কিছুতেই। মুক্ত করে দিয়েছিলো, মেয়েটা যাতে নিজেকে চিন্তায় চেতনায়, জ্ঞানে ঋদ্ধ করে নিতে পারে। সেটুকু নেবার মতো যথেষ্ঠ মানসিক পরিপক্কতা পুষ্পিতার ছিলো না। সে সৌমেনের ব্যাস্ততাকে মেনে নিতে পারেনি, তার স্বপ্ন পূরণের পথে সহযাত্রী হতে পারে নি বরং মুক্তির আনন্দকে অপব্যবহার করে, সৌমেনকে কাঁদিয়ে পুষ্পিতা অপার স্বাধীনতায় অন্য কারো আকাশে ডানা মেলেছিলো। খুঁজে নিয়েছিলো, অন্য ভালোবাসার মানুষ। ভয়াবহ সময় কাটিয়েছে সৌমেন সেই দিনগুলোতে। সৌমেনের কাতর গলা শুনে মারিয়ামের বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। আহারে কতটা যন্ত্রণা ছেলেটা বুকের মধ্যে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।
এটুকু শুনেই এত কষ্ট পাচ্ছ। এটা আমার জীবনের প্রথম প্রেম নয়। প্রথম যাকে ভালোবেসেছিলাম, তার জন্য তো আমি মরতে বসেছিলাম। কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে গেছি। সেও আরেক ভয়ানক গল্প।
মারিয়াম খুঁজে পান না, সব তরুণ হৃদয়েই কেমন করে এরকম ভয়ানক সব গল্প লুকিয়ে থাকে, যা তাদের একান্ত নিজের। সহজে কেউ সে সব গল্পের খোঁজ পায় না।
কিন্তু এবার তো পুষ্পিতা ফিরে এসেছে, তোমাকে আপন করে পেতে চাইছে। কেনো তাকে তুমি তোমার জীবনে আর ফিরিয়ে নিচ্ছ না? যার জন্য তুমি এত কেঁদেছ, এত অপেক্ষা করেছ, রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটিয়েছ।
সৌমেন দ্বিধান্বিত হয়, কী এক অব্যক্ত বেদনায় ম্লান হয়ে থাকে। মারিয়াম বুঝতে পারেন একটু সময় আসলে ওর দরকার। সৌমেন ওর জীবনে ঘটে যাওয়া অতীতের কথা বলতে গিয়ে, পুষ্পিতাকে ভালোবাসা এবং ভালোবাসা হারানোর বেদনার কথা বলতে গিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠলে মারিয়াম তাকে বুকে জড়িয়ে নেন। সৌমেন পরম নির্ভরতায় মারিয়ামের বুকে মুখ গুঁজে নির্ভার হয় যেন।
তিনি ব্যক্তি সৌমেনকে যতটা আঁকড়ে ধরেছেন, তার চাইতে সৌমেনের বর্নাঢ্য জীবন তাকে টানছে বেশি। “তুমি পুষ্পিতাকে ভালোবেসে আবার নতুন করে শুরু করো”। তিনি ছেলেটাকে আস্বস্ত করার চেষ্টা করেন।
প্লীজ আমাকে একটু একা থাকতে দাও, আমার মতো করে। আমি আর কাউকে বিশ্বাস করি না। আবার নতুন করে কোনো কষ্ট পেতে চাই না। আমি নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছি। মারিয়াম বুঝতে পারেন, এসবই তার অভিমানের কথা-ছেলেটা অসম্ভব নির্ভরতা পছন্দ করে। একটু উষ্ণতার জন্য ও কেনা গোলাম হয়ে যেতে পারে।
মারিয়ামও নির্ভরতা চেয়েছিলেন, সৌমেনরও তাই। অসম বয়সের বেদনার্ত দুই মানব-মানবি কি করে যেন আকুল করা তৃষ্ণা নিয়ে দুজন- দুজনের শরিরের খুব কাছে কখন চলে এলো সৌমেন সেটা টেরই পেলো না।
৬
বেশ কিছুদিন ধরেই মারিয়ামের হাব-ভাব রহমানের ভালো ঠেকছে না। সেদিন সকালবেলা জোর করে চেপে ধরতেই, নির্বিকারভাবে স্বীকার করলো-তার মানসিক নির্ভরতার কথা, বন্ধুত্বের কথা। এমন ভাবে বললো, যেন এটা তেমন কোনো ব্যাপারই নয়। রহমান চিৎকার করেছিলেন খুব, লজ্জা করে না তোমার?
লজ্জা করার কি আছে? যাকে কখনই বন্ধু ভাবতে পারনি, বিশ্বাস করনি, যার উপর তোমার কোনোকালেই ভরসা তৈরি হয়নি, সে কার সঙ্গে জড়ালো কি না জড়ালো সেটা জানতে চাওয়াতে তো তোমারই লজ্জা করা উচিৎ- বলতে চেয়েছিলেন মারিয়াম কিন্তু কথা বাড়ান নি। বন্ধুত্ব কিম্বা প্রেমের মতো গভীর বিষয়ে কথা বলার জন্য যে ডায়ালগ, ডিসকাশন, উইট বা হিউমার সেন্স একজন মানুষের থাকা উচিৎ সেটা রহমানের নেই বলেই তিনি মনে করেন।
নির্লজ্জ বেহায়া মেয়েমানুষ কোথাকার, স্বামী, সংসার, সন্তান ফেলে ছেলের বয়সী একজনের সাথে প্রেম করার কথা ভাবলে কি করে? উত্তর দাও। চুপ করে থেকো না, বাঘের মতো গর্জে উঠছিলেন, রহমান বার বার।
আমি প্রেম করছি না। মারিয়াম যথেষ্ঠ আত্ম-বিশ্বাসের সাথে উত্তর দেন।
হাঁটুর বয়সী এক ছেলের সাথে এখানে ওখানে ঘুরে-বেড়াও ঘর-সংসার ফেলে রেখে, এইটারে কি বলে? থাপড়ে তোমার দাঁত ফেলে দেয়া উচিৎ। ওহ! তাইতো এটাকে প্রেম বলে না, বলে পরকীয়া। ভালো যুক্তি দেখিয়েছো। যুক্তির অভাব কোনোকালেই ছিলো না তোমার। বদ মানুষের কোনো যুক্তির অভাব হয় না। ঘর-সংসার ফেলে পর পুরুষের সাথে ফষ্টি-নষ্টি করা। তোমার কি মনে হয় না, তুমি আমাকে ডেলিরেটলি অপমান করছো?
মারিয়াম চুপচাপ থাকেন। কিছু কথার উত্তর দিতে চান না তিনি। মৌনতাই হয়তো তার প্রতিবাদের ধরণ।তিনি কার সঙ্গে মিশবেন, কথা বলবেন, বিষয়গুলো তার ব্যক্তিগত হওয়াই উচিৎ ছিলো। প্রত্যেকটা মানুষেরই ফ্রিডম অফ চয়েস থাকে। তার জীবনে পছন্দ করার স্বাধীনতা কোনো কালেই নেই। বিবাহিত জীবনে তার প্রতিটা সকাল সন্ধ্যা কেটেছে অন্য আরেকজনের নির্দেশনায়। মারিয়াম কখন কি করবে, কার সাথে কথা বলবে, কোন শাড়িটা পরবে, কোথায় যাবে, প্রত্যেকটা বিষয় এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত। একবার এক ছেলে কলিগের সাথে রিক্সায় চড়ার অপরাধে তাকে অনেক অপমানিত হতে হয়েছিলো। মারিয়াম ভুল্ভেই যেতে বসেছিলেন যে তার যে তার নিজস্ব চাওয়া-পাওয়া বলে কিছু আছে। থাকার জন্য একটু মুক্ত বাতাস বা যাকে বলে, অক্সিজেনের জন্য মারিয়াম আজকাল খুব হাঁসফাস করেন।
ঝগড়ার মাঝখানে, মোমেনার মা এসে-চায়ের খবর দিয়ে যায়। সকালের এক কাপ চা তার আয়েশের। সুখি-সংসারী আয়োজনে তিনি আগা-গোড়া মোড়ানো। লোকে জানে, দাম্পত্য জীবনে তারা খুব সুখী। অনেকেই ঈর্ষা করে, তাদের সুখ দেখে। দীর্ঘদিনের সুখী সুখী অভ্যাসে মোমেনার মায়ের দেয়া চায়ের খবর তার ভেতরের তৃষ্ণা বাড়িয়ে তোলে। অদ্ভূত এক তৃষ্ণা চক্ষে আর বক্ষে নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়ান। কি যেন খুঁজে বেড়ান। মূল্যবান কিছু? বন্ধুত্ব? প্রেম? দাসত্বের থেকে মুক্তি? তিনি যে লেখালেখির কথা ভাবছেন, আসলে কী লিখতে চান তিনি। কোনো তিক্ততা নিয়ে তার কথা বলতে ইচ্ছা করে না। কী কথা বলবেন তিনি, রহমানের সাথে।
মারিয়াম এই বয়সে এসে উপলব্ধি করেন যে, এই যে এত এত সম্পর্ক তার বেশির ভাগই ফাঁপা। জগতের বেশির ভাগ প্রেম বা সম্পর্কের ভেতর আর যাই হোক কোনো বন্ধুত্ব নেই। সুখী সুখী চেহারার আড়ালে, বন্ধুত্বের বোঝা-পড়াটা কোথাও নেই। আর বন্ধুত্ব তৈরি করার মতো সময়ও কারো হাতে নেই। সবারই বড্ড তাড়া। কিসের তাড়া সেটা অবশ্য স্পষ্ট নয়। কেউ কাউকে বিশ্বাস করবার কোনো সামাজিক দায় নেই। প্রত্যেকটা মানুষই এখন কোনো না কোনভাবে অতৃপ্ত, বিচ্ছিন্ন,বড্ড একা।
রহমানের সাথে তার এই যে বন্ধুত্বহীন প্রেম, শরির বিনিময় এবং বর্তমানে সৌমেনের সাথে প্রেমহীন বন্ধুত্ব, শরির বিনিময়- সম্পর্ক দুটোরই কোনো নাম দিতে পারছেন না। তাহলে তিনি দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবেন কি করে? বিপ্লব কি একা একা হয়? বিপ্লবের জন্য সহযাত্রীর প্রয়োজন হয়। একে অন্যের পরিপূরক হতে হয়।
রহমানের সাথে তার মানসিক সংযোগ নেই বলেই হয়তো, সৌমেনকে সঙ্গে নিয়েই অনেকটা পথ মানসিকভাবে হাঁটতে চাইছেন, প্রলেতারিয়েত সংজ্ঞা থেকে নিজেকে বের করে আনতে চাইছেন অন্যদিকে সৌমেনকে তিনি তার পুরো জীবনের দায়িত্ব দিয়ে অযথাই ছেলেটার জীবনকে দূর্বিসহ করে তুলতে চাইছেন না-এসব কথা তিনি কী করে বোঝাবেন রহমানকে।
চা খেতে খেতে রহমান খেঁকিয়ে ওঠেন, তুমি থাকবে আমার সাথে- সবকিছু ছিবড়ে করে নিয়ে, স্ফূর্তি করবে আরেকজনেক সাথে, আমার সংসারে এসব চলবে না। তোমাকে আজ থেকে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে হবে।
কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, শোনার অপেক্ষা না করে, রহমান প্রচণ্ড রাগ নিয়ে নাস্তার টেবিল ছাড়েন।
আজকাল রক্ত-মাংসের মানুষ ছাড়াও আরো কিছু অনুষঙ্গ, প্রত্যেকটা মানুষের মনের গভীর গোপন ফাঁকগুলোকে ভরিয়ে রেখেছে, যেগুলোর খুব গাল ভরা নাম রয়েছে। এই যেমন, সেলফোন, ট্যাবলেট, এবং তার অন্তর্গত জগৎ ফেইসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম। সেগুলোই আজ সবার বড্ড চেনা, সেখানকার ছায়ামানুষেরাই অনেক বেশি মানবিক। খুব ভালো বন্ধু, এদের কাছে যে কোনো মানুষের কান্না-হাসি লুকানো বড্ড সহজ। ডায়নিং টেবিলে একা একা বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মারিয়াম কিছুক্ষণের জন্য ‘মুখ-বই’ এর শরণাপন্ন হন। লীনা মেসেজ পাঠিয়েছেন-“দেখেছেন, নারীরা কেমন ক্ষেপে উঠেছে, প্রতিবাদ স্বরুপ, একজনের লিঙ্গ কর্তন করেছে। এবার যদি পুরুষগুলো জব্দ হয়। দেখবেন, উইমেন্স চ্যাপ্টারটা খুব দ্রুত উপরে উঠে যাবে। ঐ পেইজটা সমাজের পালস ধরতে পেরেছে”। নাদেরা মেয়েদের একটি আলাদা পাতা শেয়ার করেছেন- সেখানে নির্যাতিতা নারীরা এক হয়েছেন। পুরুষতন্ত্রর বিরুদ্ধে সবাই এক হয়েছেন। নারীদের প্রতিকূলতা ভাঙ্গতে তারা ভয়েজ রেইজ না করলে, কোনো ভাবেই এর উত্তরণ সম্ভব নয়।
মারিয়াম তার সীমিত সাহিত্য বোধ, গৃহস্থালীর সামান্য অভিজ্ঞতা, চরম নৈতিকতার ধারক ও বাহক হয়ে শরৎচন্দ্রের নায়িকাদের মতো যার লেখালেখির চৌকাঠ ডিঙ্গানো অথবা জীবন-যাপন, সেই মারিয়ামও আজকাল নারীবাদ নিয়ে দারুণ ভাবেন। বুর্জোয়া, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ শব্দগুলোর মানে নতুন করে আবার শেখেন। বিপ্লব একটা শুরু হয়েছে ঠিকই যেখানে, নারীরা শক্তিধর হয়ে উঠছে কিন্তু পুরুষরা দাঁড়িয়ে আছে, বিপক্ষ শক্তি হিসেবে। একে অপরের পরিপূরক না হলে, সহযাত্রী না হলে, এমন বিচ্ছিন্নতা দিয়ে কি আসলে কোনো বিপ্লবে জয় লাভ করা সম্ভব? যা হোক সবাই মুখে মুখে যে অধিকার নিয়ে সোচ্চার সেটা তিনি নিজের জীবনে প্রয়োগের জন্য লড়াইয়ে নামেন।
স্ক্রল করতে করতে মারিয়াম দেখতে পান, নতুন মেসেজের নোটিফিকেশন। রহমান তাকে জানায়, তার ভুলগুলোকে তিনি কোনোভাবেই ক্ষমা করতে পারবেন না কারণ তিনি ছেঁড়া স্যাণ্ডেল রিপেয়ার না করে, নতুন কেনারই পক্ষপাতি। তবে তার সন্তানদের মা হওয়ার উপলক্ষ্যে, সমাজে সুখি চেহারা বজায় রাখার স্বার্থে, বিশেষ বিবেচনায় মারিয়ামকে তিনি আরেকবার সুযোগ দিতে চান।
৭
দিনের এসময়টা সৌমেন তার জন্য অপেক্ষা করে, অনলাইনে। সৌমেনের সঙ্গে তার যাপিত জীবনের গল্পটা অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠতে পারতো, সম্পূর্ণ হতে পারতো, জাত-বর্ণ- ধর্ম নির্বিশেষে একটি সম্ভাবনার গল্প হতে পারতো কিন্তু তিনি বেশ বুঝতে পারছেন, দিন দিন কেমন যেন বদলে যাচ্ছে ছেলেটা। তবে কি পুষ্পিতা তার জীবনে সত্যিই ফিরে এলো? সৌমেনের চোখের তারায় তার জন্য আর সেই আগের টান দেখতে পান না, কণ্ঠে নেই পুরানো সংস্কার আর মূল্যবোধ ভাঙ্গার উৎসাহ। হুট করে কোথায় যেন একটা কী ঘটে গেছে ছেলেটার মধ্যে। তবে কী সাবেক প্রেমিকাকে ফিরে পেয়ে তাকে সে ভুলে যাচ্ছে!
মারিয়ামের ভীষণ ভয় করে, সৌমেনকে তিনি হারাবেন, এটা ভাবতেই পারেন না। তিনি তো নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিলেন। সৌমেনের ব্যক্তিগত জীবনের প্রেম-ভালোবাসায় তার কোনো আগ্রহ নেই অথচ তিনি প্রবলবভাবে চান, সৌমেনের সব অধিকার তার হাতেই থাক। তিনি ওর সাথে ভাগ করে নিতে চান জীবনের কপটতাহীন বেদনা কিম্বা আনন্দের গল্পগুলো। একমাত্র সৌমেনের কাছেই তিনি রোজ রোজ মিথ্যা অভিনয়ের গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন। সৌমেনের হাতে গল্পে গল্পে তুলে দিতে চেয়েছিলেন, তার ভেতরের ‘আমি’কে। ভীতু, নরম, ছেলেমানুষ, বিষয়-বাসনাহীন ‘আমি’কে। তেমন কিছু তো চান নি ছেলেটার কাছে-একটু সময় চেয়েছিলেন মাত্র।
কী মনে করে আজ হঠাৎ তিনি প্রশ্ন করেন, তুমি কি আমার দায়িত্ব নেবে সমু? একেবারে? আমি আমার জীবনে এবার সত্যিকারের একটা সিদ্ধান্ত নিতে চাই। হয়তো উত্তরটা মারিয়ামের জানাই ছিলো, তবুও তার বুক তোলপাড় করে, সৌমেন বলতে থাকে-
এটা কখনো সম্ভব নয়। তোমার এই চাওয়াটা কি চূড়ান্ত অন্যায় নয়? তোমার ঘর আছে, স্বামী-সন্তান আছে।
আমি যে আমার দাসত্ব ভাঙ্গতে চেয়েছিলাম। আমার নতুন করে বেঁচে থাকার জন্য তুমি হয়ে উঠেছিলে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন।
তার জন্য কি আমাকেই বেছে নিতে হবে? জগতে কি আর কোনো পুরুষ নেই?
তুমিই তো আমাকে নিজের মতো করে, নিজের জন্য বাঁচতে শেখালে। স্বপ্ন দেখালে। কত ভালোবাসা, মায়াময়, সময় কেটেছে আমাদের, যে বিশ্বাস আর নির্ভরতা নিয়ে তোমার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলাম, তার কি কোনো মূল্য নেই।
উঁহু শরির আমার কাছে মূল্যবান কিছু নয়, আর তাছাড়া তুমি আমার জীবনে প্রথম নারী নও, তোমারও তাই। সুতরাং তোমাকে স্পর্শের কোনো মূল্য আমার কাছে নেই। যুক্তিবাদী সৌমেন যেন এমনই একটা দিনের অপেক্ষায় ছিলো। সে বুঝিয়ে দেয়, কথা যখন উঠে গেছে সেটা তাড়াহুড়ো করে আজকেই শেষ হওয়া দরকার। যেন তার বড্ড তাড়া, একটু দাঁড়ালেই-মারিয়ামের দায় তাকে নিতে হবে!! মারিয়ামকে লিখতে উৎসাহিত করেছে বলে, মারিয়াম সিন্দাবাদের ভূতের মতো তার ঘাড়ে চেপে বসবে আর সে দায় সৌমেন বয়ে নিয়ে বেড়াবে, এমন অযৌক্তিক ছেলে সে কখনই নয়। ছটফটে সৌমেন বেশী কথায় যেতে মোটেও রাজী নয়, সহজ সত্যে সবটুকু হিসাব শেষ করে দেয়-তুমি বয়সে আমার অনেক বড়। আমি ভুল করতেই পারি, সে দায় আমার নয়, সে দায় তোমার। তুমি এগিয়ে না এলে আমি নিশ্চই এগুতে পারতাম না। আমাকে এই নোংরা পথে তুমিই টেনে নামিয়েছ, সিডিউস করেছো। অবশ্য সে সব নিয়ে আজ আর আমি তোমাকে অভিযুক্ত করতে চাই না।
তোমাকে আমি হারাতে চাই না সৌমেন। এই কষ্টটুকু নিশ্চয়ই আমার প্রাপ্য নয়।
জীবনে অনেক তো কষ্ট পেয়েছো, এ সামান্য কষ্ট তুমি নিশ্চই সামলে উঠবে। ভীষণ কষ্ট পাওয়ার যে অভিনয়টা তুমি করে যাচ্ছো, সেটা আসলে ভণ্ডামি ছাড়া কিছু নয়। রোজ তো কত অভিনয় করো, অভিনয় তোমার কাছে নতুন কিছু নয়। এত কষ্ট পাওয়ার মতো তো কিছু ঘটেনি।
আমি আসলে তোমার মতো অভিনয় জানি না। আমি কোনো ভণ্ডামি করতেও রাজি নই। পুষ্পিতাকে নিয়ে আমি নতুন করে সব শুরু করতে চাই, বাঁচতে চাই। প্লিজ আমাকে একটু বাঁচতে দাও। এসব আমি আর নিতে পারছি না। তারপরেও আমার জন্য যদি কিছু কষ্ট পেয়ে থাকো, তার জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাই।
আমি তোমাকে ছাড়া কি করে বাঁচব সোমু? তুমি আমার বেঁচে থাকার, শেষ অক্সিজেনটুকু।
অক্সিজেন ছাড়াই অনেককাল তো বেঁচে রইলে, আর কত বাঁচতে চাও? এখন আর তোমার নিজের বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখা উচিৎ নয়, তোমার সন্তানরাই তোমার সব। তাদের ভালো মন্দই তোমার জীবন। প্লিজ আমার সাথে আর যোগাযোগের কোনো চেষ্টা করো না।
মারিয়াম নীরবে ‘মুখ-বই’ থেকে বেরিয়ে আসেন। কত সহজ সব কিছুর দায় থেকে বেরিয়ে আসা। সত্যিকারের পৃথিবীটা যদি এমন হতো, চাইলেই লগ আউট করে যে সব সম্পর্ক আমরা চাই না, সে সব সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা যেতো!
লিভিং রুমের সব ভারী পর্দাগুলো টেনে দিয়ে ঘরটাকে অন্ধকার করে, রশিদ খাঁ’র রাগ ‘শ্যাম কল্যাণ’ চালিয়ে দেন মারিয়াম। রশিদ খাঁ গেয়ে ওঠেন-“পায়েল বাজে মোর”----সঙ্গীত তার ভেতরে অনুরণন তোলে। তিনি মোহিত হন। সামান্য নেশাতুরও।
দুলতে দুলতে তিনি তার অপূর্ব কারূকাজ খচিত কাঠের কালো বাক্স থেকে, বহুদিনের অব্যবহৃত রূপালী রঙ এর পার্কার কলমটি বের করেন। সাথে জাপান থেকে আনানো দামী কাগজ। আজ তিনি লিখবেনই। যে কোনো মূল্যে লিখবেন। আসলে কি লিখবেন তিনি? কিছু তো একটা লিখতে চান অবশ্যই। তিনি লিখেই চলেন-কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘর ভরে ওঠে মুঠো মুঠো শিউলিফুলে। দলা পাকানো কাগজের টুকরোগুলোকে তার শিউলিফুল বলেই তার ভ্রম হয়, না না ওগুলো আসলে বৃত্ত যে বৃত্তগুলো জোড়া লেগে লেগে তৈরি হয়, দাসত্বের শেকল, নিরাপত্তার শেকল, নির্ভরতার শেকল, মরা বিপ্লবের শেকল, কিন্তু কিছুতেই লেখা আর এগোয় না।
মোমেনার মা আবার উদ্ধার কর্তা হিসেবে এগিয়ে আসে, ‘আফা ভাত খাইতেন না? টেবলে ভাত দিছি’।
ডিম ভর্তি ইলিশের নরম পেটি থেকে মিহি কাঁটা ছাড়াতে ছাড়াতে নিজের জীবন বদলে ফেলতে চাওয়া বিপ্লবী মারিয়াম নানা ভাবনায় ডুবে থাকেন। আসলেই কি কেউ কিছু ভাঙ্গতে চায়? আদতে মানুষ কিছুই ভাঙ্গতে চায় না। এই যে রহমান, তিনি কখনই তার প্রথা ভাঙ্গতে চান নি, ভাঙ্গতে চান নি প্রভুত্বের অহংকার। সৌমেন, যে তার বিপ্লবের সহযাত্রী সেও ভাঙ্গতে চায় না তার আজন্মের সংষ্কার!! এই তিনি ভাঙ্গতে চেয়েছিলেন,তার দাসত্বের শেকল, পারলেন কোথায়? তিনি থেকে যান, নিরাপদ বলয়ে। যাই করেন না কেনো তিনি সেই তো আবার তার আপসের বাণিজ্য শেষে ঘরে ফেরা। সবাই সবার মতো করে আপস করে নিচ্ছে। তবু কেনো সব ভেঙ্গে পড়ছে? সব কিছু ভেঙ্গে পড়তে চাইছে। চারিদিকে কেনো তবে কেবলই ভাঙ্গনের শব্দ। সব ধরে রেখেও মানুষ কেনো এত অতৃপ্ত? এত অস্থির? এত প্রেমহীন, এত মমতাহীন। কিসের অভাব মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়? সবাই কিছু না কিছু খুঁজছে। কি খোঁজে সবাই রোজ?
খাওয়া শেষ করে, ভাত ঘুমের আয়োজন করেন তিনি। সাজানো বেড রুমে, নরম কাঁথায় নিজেকে আবৃত করে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন এবং ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেন। তিনি রাস্তার ধারে সেই শিউলিতলায় তার কারুকার্যখচিত কাঠের বাক্সটি নিয়ে বসে আছেন। তার মাথায় দারুণ একটি লেখা ঘুরছে। তিনি কিছু একটা লিখে সবাইকে চমকে দিতে চাইছেন। চারিদিকে উৎসুক জনতা তাকে ঘিরে আছে-যেন তারা কিছু একটা দেখতে চায়, জানতে চায়। তিনি ধীরে ধীরে তার জাদুর বাক্সটি খুলতেই রূপালী পার্কার কলমের বদলে নীল ডোরা কাটা রূপালী রঙ এর সাপ ফোঁস করে মাথা বের করে দেয়। যেন তার বুকের ভেতরে থাকা বেদনাগুলো, জমে থাকা অসহায়ত্ব গুলো হঠাৎ মাথা তুলে বেরিয়ে আসতে চায়। সাপটি কি জাতের তিনি ঠিক চিনতে পারেন না। মাঝখান থেকে চারপাশের উত্তেজিত জনতার টুকরো টুকরো কথা তার কানে ভেসে আসে। কেউ বলে ওটা পুরুষ, ওর লিঙ্গ কর্তন করা হয়েছে। না না তা কি করে হয়, ওটা নারী, স্বাধীন। পরাধীনতার কোনো শেকল নেই ওর গায়ে, যে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত। কেউ বলে, এ নিশ্চই বিপ্লব, কী তীব্র ফনা! না না ও হলো-বেদনা। কী গাঢ় নীল ডোরা ওর গায়ে। মারিয়াম জাত সাপুড়েদের মতো হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সাপটিকে উত্তেজিত করে তোলেন। তিনি সাপটির কাছে শক্তিমান সাপুড়ে। জগতে এ এক অদ্ভূত খেলা, যখন ক্ষমতা যার হাতে, শুধু সর্বহারারাই নয় এমনকি ঈশ্বরেরাও সেখানে বারবার পরাজিত হয়, সব ঈশ্বরেরাই আপস করে ঘুমিয়ে থাকে ক্ষমতাবানদের পকেটে। মারিয়াম বুঝতে পারছেন, খেলার এ পর্যায়ে তিনি অসীম ক্ষমতাবান, তাই নিয়মানুযায়ী সাপটিকে তিনি কিনে নেবার জন্য ক্রূর খেলায় নামেন। তিনি সরাসরি সাপের চোখের দিকে তাকান, সে চোখ প্রেমিক ঈশ্বরের মতো। বড্ড মানবিক। সাপটি কিছুক্ষণ তার হাতের ইশারায় দুলতে থাকে, তারপর এক সময় বশ মানে। মারিয়াম হাত বাড়াতেই পরম নির্ভরতায় সাপটি প্রথমে তার হাত পেঁচিয়ে ওঠে এবং শূন্যে ঝুলতে থাকে। বশ মানানোর পর, তিনি সাপটির নাম জিজ্ঞাসা করেন। সাপটি কোমল গলায় বলে, তার অনেকগুলো নাম আছে। বেশির ভাগ লোকে তাকে প্রেম বলে ডাকে, কেউ কেউ বলে, বিশ্বাস। কেউ ডাকে নির্ভরতা। সম্পর্ক বলেও ডাকে তাকে অনেকেই। মারিয়াম বুঝতে পারেন, এতদিন ধরে যে প্রেম খুঁজছিলেন, যা খুঁজছিলেন- সেটা তিনি পেয়ে গেছেন। স্বপ্নের মধ্যেই তিনি বিজয় উল্লাস করেন। কিন্তু খুব ক্ষমতাবনেরাও যে জিতে যেতে যেতে কোন খেলায় কখনো কখনো ভুল চাল চালে- মারিয়াম আবার সেটাই নতুন করে প্রমাণ করলেন। যদিও সাপকে অথবা প্রেমিক ঈশ্বরকে ঠিক বিশ্বাস করতে নেই, ভরসা করতে নেই তবুও তিনি বিশ্বাস করে ফেললেন। এ খেলায় হেরে যাবার জন্য একটা ভুল চালই যথেষ্ঠ। তার বিশ্বাস যখন গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়, তখনই খেলার মোড় ঘুরে যায়, এতক্ষণ ক্ষমতার যে দণ্ডটি তার হাতে ছিলো, সেটি চলে যায়, পরম মমতায় তার বাহু পেঁচিয়ে থাকা সাপটির দখলে। এবার তিনি হয়ে ওঠেন প্রলেতারিয়েত ঈশ্বর, বড্ড মানবিক। ভীষণ দূর্বল। তার চোখে বিশ্বাস আর নির্ভরতার অনুনয় ঝরে পড়ে। সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকেন, ঠিক সেই সুযোগেই সাপটি ভয়ংকর ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে এবং তাকে ছোঁবল মারে। তীব্র বেদনায় তিনি প্রথমে নীল হন, তারপর শিউলি তলায় লুটিয়ে পড়েন। নিজের মৃত্যু দৃশ্যটি তিনি বেশ স্পষ্টভাবে দেখতে পান। তার রক্তাক্ত হৃদপিণ্ড দেখে, চারপাশের মানুষজন আহাজারি করতে থাকে। অথচ কেউ তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে না। এক এক করে সবাই কেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সবাই দলছুট। কেউ কারো দিকে ফিরে তাকায় না। কেউ তার জন অপেক্ষা করে না, সবাই হাসাহাসি করতে করতে খেলার রীতি অনুসারে ফিরে যায়। তিনি চিৎকার করে জানতে চান, ভয়ানক ক্ষমতাধর প্রেম, ভালোবাসা এবং বন্ধুত্ব কি অশুভ কোনো শক্তি। বিশ্বাস, নির্ভরতা কি কেবলই মৃত্যু ডেকে আনে? তবে কি সত্যিই অশুভ শক্তির কাছে মানবিক ঈশ্বরেরা বরাবরই মৃত? তবে ঈশ্বরে প্রেম বা প্রেমিক ঈশ্বর কি মিথ্যা? রোজ এভাবে কত প্রশ্ন জমে জমে হিমালয় হয়, কত বিপ্লব থেমে যায়, কত স্বপ্ন মরে যায়, আপসের পাহাড়ের নীচে পড়ে থাকে, ভাঙ্গা হৃদয়ের হাড়-কঙ্কাল, কেউ কি তা জানে?
অন্তত মারিয়াম জানেন না। তিনি স্বপ্নের মধ্যেই কিছু একটা লিখতে চান, শ্রেণি-বৈষম্যহীন মিলনের গল্প, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ শেকল ভাঙ্গার গল্প, কিছুতেই আর সেটি গল্প হয়ে ওঠে না।