১
হঠাৎ সব ছেড়েছুড়ে মধ্যবয়সে এসে তিনি ঠিক করলেন, লেখালেখি দিয়ে নয়, বাস্তবেই তিনি নিজের দাসত্বকে ভাঙ্গবেন। তিনি জড়িয়ে পড়লেন এক অসম সম্পর্কে। বয়সে নবীন, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী এক তরুণের সঙ্গে তার হৃদ্যতা গড়ে উঠলো। জীবনটাকে চেখে দেখবার তার ভেতরে প্রবল বাসনা তৈরি হলো। আসলে নিজের জন্য বাঁচার মতো বাঁচার জন্য কোনো বয়সের দরকার হয় না, শুরুটাই আসল। তিনি একটা চমক দিয়ে জীবনের দ্বিতীয় ইনিংসটা শুরু করতে চাইলেন!
স্বল্প খ্যাত লেখিকা মারিয়ামের জীবনের দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুটা হলো, ইকবাল রোডের ‘দ্যা ক্যাফে’ রেস্টরেন্ট থেকে। “তুমি তো যোশ লিখ, বস”। অথবা আহা! এত ঢং করে তেল-গ্যাস খাওয়ার কি আছে, লিখলেই তো পারো” এমন কথার বদলে সৌমেন যখন বললো, “লিখছ না কেনো তুমি?”
তরুণের কাছে থেকে একটা মামুলি কিন্তু ম্যাচিওর প্রশ্নে তিনি চমকে উঠলেন। লেখালেখি তিনি প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন, বহু দিন ধরে কিছুই লিখতে পারছেন না- অবশ্য তিনি না লিখলে, উপকার বৈ ক্ষতি কিছু নেই। তবুও ভেতর থেকেই প্রশ্নটা উঠে এলো, সত্যিই তো লিখছেন না কেনো তিনি, কিন্তু সেটিকে প্রকাশ না করে, পাল্টা প্রশ্ন করলেন আসলে কি হবে লিখে? ছটফটে পাগলাটে একটা উত্তর আশা করেছিলেন, কিন্তু তাকে বোল্ড করে দিয়ে, সৌমেন বেশ ধীর স্থির গলায় ব্যাখ্যা করল-
ধরো, তোমার লেখাই হয়তো বদলে দিতে পারে, মানুষের প্যাটার্ণ অব ইমোশনকে। তোমার পুরোনো লেখাগুলোতে তারই আভাস পাই। শুধু শুধু না লিখে এভাবে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয়! সেদিন কফির কাপে চামচ ডুবিয়ে চিনির পরিমাণ ঠিক করতে করতে মারিয়াম রহমান ভাবলেন, এভাবে অনেকদিন তাকে কেউ এই কথাগুলো বলেনি কিম্বা কেউ আদতেই বলেছিলো কিনা সেটা তিনি মনে করতে পারেন না।
ধুর! এই বয়সে আবার এসব নতুন করে হয় নাকি? তুমি আমার বয়স জানো?
কি আশ্চর্য! তুমি কি শরৎ কিম্বা রবীন্দ্রনাথের নায়িকা নাকি? শুধু সংসারের জন্যই খেটে মরবে! আর বয়স ফয়স এসব কিছু নয়, সে তো সংখ্যামাত্র, তোমার মুখে এসব মানায় না। নিজেকে আর কতদিন ভিড়ের মানুষ করে রাখবে? সময় এসেছে সামনে আসবার। নিজের যা ভালো লাগে, সেভাবে বাঁচতে শিখলেই তুমি লিখতে পারবে। নিজের মতো করে বাঁচো।
সৌমেনের কথার তীরে তিনি বারবার বিদ্ধ হলেও, ভেতরে ভেতরে তিনি চমৎকৃত এবং উদ্বেলিত হলেন। তার মানে, তার ভেতরটা এখনো ঠিক মরে যায়নি। তিনি বেঁচে আছেন। তিনি হয়তো একটু চেষ্টা করলেই, লেখালেখিতে ফিরতে পারবেন। এরপরই তিনি একটু একটু করে সিদ্ধান্ত নিলেন, বাঁচার মতো করে বাঁচবেন। কিন্তু দ্বিধা কী এত সহজে দূর হয়?
দ্বিধা ভরে বললেন, আমাকে দিয়ে আর কিছুই হবে না-এখন আমার একমাত্র কাজ সন্তানদের ভালোভাবে মানুষ করা। আমার কি এসব বাহুল্য চলে?
তোমার জন্ম, তোমার বেঁচে থাকার স্বার্থকতা কি মা হবার জন্যই? মা হওয়ার বাইরে কি মানুষের আর কোনো পরিচয় থাকতে নেই। অসহিষ্ণু সৌমেন ক্ষেপে উঠলো। তোমাদের নিজেদের বাধার পাহাড় নিজেরা না ভাঙ্গলে, কে কবে এসে ভেঙ্গে দেবে বলো তো! রাগ করে কফির কাপ ফেলে ধুম ধাম উঠে পড়লো সে। এতক্ষণে তার বিশ্বাস হলো, তিনি যার সাথে কথা বলছেন, সে প্রকৃতই বয়সে অনেক নবীন, টগবগে প্রাণশক্তিতে ভরপুর।
এই তরুণই তার জীবনের পুরোনো স্বাদগুলো বদলে দিতে থাকে, তার চিন্তা চেতনায় বড় ধরণের বদল নিয়ে আসে। নতুন একটা জীবন পাবার আশায় মারিয়াম সৌমেনের বন্ধুত্বের কাছে হেরে যেতে থাকেন। শুরু হয় এক অসম বন্ধুত্বের।
যদিও তিনি যে সমাজে বসবাস করেন, সেখানে মান-সম্মান, ধর্ম-অধর্ম, চরিত্র-নৈতিকতা সবই কাঁচের গ্লাসের মতো ভীষণ ঠুনকো। সামান্য আঘাত এলেই যেখানে সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে সেরকম একটা পথ ধরে এরকম বন্ধুত্ব সত্যিই হয়তো বড় বিপদজ্জনক অথবা বেমানান।
২
মারিয়াম রহমানের সাথে সৌমেনের পরিচয়টা মূলতঃ ফেইসবুকের মাধ্যমেই ঘটে। ইদানীং তার সময়টা ভালোই কেটে যাচ্ছে। মারিয়াম রহমান নামে খোঁজ করলেই, নীল শাড়িতে উদাস সমুদ্রের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে, এমন একটা ছবি ভেসে ওঠে কম্পিউটারের স্ক্রীনে। একটু বোকা সোকা নরম ধরণের মাঝ বয়সী মহিলা, যাকে এ যুগের বলে মনেই হয় না। তার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় একজন বাংলার শিক্ষিকা, একজন লেখিকা এ ধরণের অদ্ভূত বোকা বোকা কথা বলে তার পুরোটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। সৌমেন খুব যৌক্তিক মানুষ। সব কিছু নিক্তিতে মেপে দেখে নেয়, যুক্তি ছাড়া এক পাও চলে না। এত টুকুন বয়সেই অনেক ঠেকে শিখেছে বলেই সব ব্যাপারেই সতর্ক। মারিয়ামের ক্ষেত্রেও তার ব্যাত্যয় ঘটেনি। ধরার চেষ্টায় আছে, মহিলা আসলেই বোকা না অতি ধূর্ত। সত্যি সত্যিই সে দুঃখি, নিঃসঙ্গ নাকি সাধারণ আট-দশটা মাঝ বয়সী মহিলার মতো অল্পবয়সীদের সিডিউস করার তালে আছে-সেটা তাকে জানতেই হবে। মারিয়াম একসময় লেখালেখি করতেন! সে সব লেখার দু’একখানা পড়েছে সৌমেন।
দিন কড়া সমালোচনা করেছে সে। ‘ধুর! তোমার লেখাগুলো বড্ড আদুরে বেড়ালের মতো। অনেকটা কবিতা টাইপ, বাস্তবতার ছোঁওয়া নেই। ন্যাকা ন্যাকা। আর সেই তো লেখায় ঘুরে-ফিরে কেবলই নারীর আপসকামীতা। মিনমিনে নারী চরিত্র। নারী পুড়ছে, কাঁদছে, বেদনায় ভেঙ্গে পড়ছে। শুধু আপস আর আপস। এরা সকলেই আসলে ভিকটিম, পদানত, পরাস্ত। তোমার লেখায় শুধু আছে পুরুষ তন্ত্রের জয়-জয়াকার। বেঁচে থাকার যে অন্য মানে আছে, সেটি তোমার লেখাতে একেবারেই নেই। তোমার চরিত্রগুলোর নিজের মতো করে বাঁচার কোনো চেষ্টাই নেই। এগুলো আমার কাছে শস্তা মনে হয়, নারীর এমন দাসবৃত্তি মোটেও আমার পছন্দ নয়’।
কাউকে খুশি করার জন্য ‘সখি গো ধরো ধরো’ টাইপের কথা তার পোষায় না, সে পরিষ্কার করে কথা বলতে; স্পষ্ট মতামত দিতে পছন্দ করে। তাতে অবশ্য মারিয়ামের বিশেষ কিছু এসে গেছে বলে মনে হচ্ছে না, সে মোটামুটি তার কার্যক্রমে মুগ্ধ। সৌমেন যেটাই করে সেটাই তার পছন্দের।
এভাবেই একটু একটু করে দুজনের মধ্যে নানা বিষয়ে এক ধরণের বোঝাপড়া তৈরি হতে থাকে।সৌমেন তাকে যখন শাহাদুজ্জামান, আহমদ মোস্তফা কামাল কিম্বা ওয়াসি রহমানের লেখা নিয়ে কথা বলে, ঠিক তখন মারিয়াম বিভূতিভূষণ, কমল মজুমদার, তারাশঙ্কর এঁদের লেখা নিয়ে তর্ক জুড়ে দেন। মান্নাদের কথা বলতে যখন তিনি অজ্ঞান, ও তাকে অরিজিৎ কিম্বা কৌশিকির গানের খবর দেয়, গীটারে চিরকুট কিম্বা জলের গানের সুর তোলে। মিল নেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তবুও নতুন পুরাতন মিলেই ধীরে ধীরে মারিয়ামের সাথে সৌমেনের এক বেনামী সখত্যা গড়ে উঠতে থাকে। আসলে কি করবে সে? মারিয়ামের সাথে কথা বলে ও যতটা মজা পায়, ইদানীং ততটা ভালো আর কারো সাথে লাগছে না। হোক না সে বয়সে অনেক বড়!
একজন শিক্ষিত রুচিশীল মানুষ, যার ভেতরটায় সে এক ধরণের স্ফূরণ দেখতে পায় অথচ মানুষটা কোথায় যেন ফুরিয়ে গেছে-এরকম ফুরিয়ে যাওয়া একজন মানুষককে নিয়ে, তার মনস্তত্ত নিয়ে সৌমেনের সময় কাটাতে বেশ ভালোই লাগছে। কোনো জীবন্মৃত অথবা বিপন্ন মানুষকে ভালোবেসে তার জীবন ফিরিয়ে দেয়া, তাকে জীবনের পথে ফিরিয়ে আনা, সৌমেনের প্রিয় নেশা এবং সেস বুঝতে পারছে এই অদ্ভূত নেশাটা মারিয়ামের কাছেও ক্রমশঃই প্রিয় হয়ে উঠছে।
৩
রহমান মন দিয়ে খবরের কাগজ দেখছেন, তাকে এ মুহূর্তে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। চিন্তিত মুখেই তিনি লিভিং রুমের পর্দা সরিয়ে দেখলেন, জানালায় দাঁড়িয়ে রাস্তার ওপারের শিউলি গাছটার দিকে মারিয়াম অদ্ভূত ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে আছে। গভীরভাবে কিছু ভাবছে মনে হয়! শিউলি গাছটায় প্রচুর ফুল ফুটেছে এবার। হাল্কা শীতের নরম রোদে মারিয়ামের দাঁড়িয়ে থাকাটাকেও কোমল দেখাচ্ছে। তিনি কিছু না বলে, ডায়নিং এ এসে চা খেতে খেতে কাগজ থেকে মুখ না তুলেই মোমেনার মা’কে বললেন, “বুঝলে, পেঁয়াজের কেজি ৮০ টাকা”
এর উওর অবশ্য মোমেনার মা’র কাছে থেকে কিছু পাওয়া গেল না। তবে কয়েক লাইন পড়তেই বুঝতে পারলেন, ঘটনা কি! ভারতে অতি বৃষ্টি হচ্ছে, পেঁয়াজের ফলন কম হতে পারে। অন্যদিকে বাজারে গুজব রোহিঙ্গারা বেশি পেঁয়াজ খায়, অতএব পেঁয়াজের চাহিদা বেশি এই সুযোগে দেশী ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ স্টক করে রেখে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি বাম রাজনীতি করা মানুষ। রাজনীতিটা অনেকটা সাইকেল চালানো শেখার মত, একবার শিখলে যেমন কেউ ভোলে না ঠিক তেমনি রহমান এখন প্রকাশ্যে রাজনীতি করা ছেড়ে দিলেও, ভুলে তো আর যান নি। সেটা তার রক্তে রয়ে গেছে। শুধু দেশ নয় বিশ্বে রাজনীতির মাঠে কার কী রাজনৈতিক চাল, তিনি সেটা নিমেষেই বুঝে ফেলেন। তার এই গভীর পর্যবেক্ষণ সাধারণতঃ ভুল হয় না। ছাত্র জীবনের রাজনীতির প্রভাব অবশ্য তার পরবর্তী জীবনে পড়তে দেন নি কারণ জীবনে টাকা রোজগার আর প্রতিষ্ঠা পাওয়া ছাড়া যে পুরুষ মানুষের কোনো দাম নেই সেটা তিনি জীবনের শুরুতেই শিখে নিয়েছেন। মাসকাবারে মোটা মানি ব্যাগ থেকে কড়কড়ে টাকার গন্ধ না ছড়ালে যে সংসারটা টিকিয়ে রাখা বেশ চ্যালেঞ্জিং, সেটার জন্য আলাদা করে গবেষণা করার দরকার হয় না।
জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে, সফল হতে তিনি তেমন বড় কোনো ভুল করেন নি। সব কিছু তার হিসাবের মধ্যেই আছে। তার সব হিসেবের মধ্যে শুধু একটা্ই ভুল করেছেন, মারিয়াম নামের এই মহিলাকে বিয়ে করে। তিনি একজন সংসারী মেয়ে চেয়েছিলেন। এ মেয়েটা আর যাই হোক সংসারী নয়, বরাবরের উদাসীন। মারিয়ামের সংসারের প্রতি ঔদাসীন্য নিয়ে অবশ্য আজকাল নতুন করে কিছু ভাবেন না তিনি। বিষয়-আশয় নিয়ে কোনোদিনই তার স্ত্রীর মাথা-ব্যাথা নেই। বাড়িতে থাকলে, যার দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে হয় বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে, নয় লেখালেখি করে কিম্বা সেলফোন নিয়ে। যত্তসব আজেবাজে কাজ, কোনো মানে হয়! কেনো যে মারিয়ামকে বিয়েটা করেছিলেন, তার সঠিক উত্তর আজও তার জানা নেই।
মাঝে মধ্যে তিনি মারিয়ামকে প্রশ্ন করেন, তিনিও যদি জীবনের শুরুতে এরকম কবি কবি চেহারা বানিয়ে ঝোলা নিয়ে ঘুরতেন, আর সংসারের কোন দায়-দায়িত্ব মাথায় না নিতেন তবে মারিয়াম অথবা অন্য কোনো মেয়ে তাকে বিয়ে করত কিনা! এরকম প্রশ্ন করলে, মারিয়াম খুব বোকা বোকা মুখে তাকিয়ে থাকেন।
এ সংসারের জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব রহমানকেই করতে হয়। তরকারীতে তেল কতটুকু হবে, কোন বেলায় মোমেনার মা একটু খানি মাছ আর ঝোল পরের বেলার জন্য বাঁচিয়ে রাখবে -এসবও তার নজর এড়িয়ে গেলে চলে না।
তিনি যত ব্যাস্তই থাকুন না কেনো, কাজ শেষ হলেই এক ছুটে বাড়ি চলে আসেন। বাজার-ঘাট থেকে ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার ভার সব তার ওপর।
অনেক চেষ্টা করেছেন, মারিয়ামকে সংসারী করে তুলতে কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে কিছুতেই সফল হন নি। মারিয়ামের হাতে টাকা দিলেই সে অপচয় করবেই। যেখানে ১২ টাকা হালি কলা একটু ঝোলাঝুলি করলেই ১০ টাকায় পাওয়া যায়, সেখানে সে নিশ্চিতভাবে ১৫ টাকা খরচ করে এক হালি কলা কিনে, হাসিমুখে এসে বলবে-‘খুব শস্তায় কলা পেয়ে গেলাম আজ! সংসারে সাশ্রয় বলে একটা শব্দ আছে সেটা মারিয়ামের ডিকশনারীতে নেই। তাই মারিয়াম যে সামান্য চাকরিটা করেন, তার ব্যাঙ্ক একাউন্টের হিসাবটা রহমান সাহেবের দায়িত্বেই থাকে। কলেজে যাতায়াত খরচসহ মারিয়ামের যখন যা সামান্য প্রয়োজন হয়, তার সবটুকু রহমানই দেন। মারিয়ামের হাতে বেতনের টাকা দিলে নিশ্চিত ভাবে সে এক দিনেই সব উড়িয়ে দেবে। নিজের কিছু আছে কিনা সেদিকে খেয়াল নেই, কেউ কিছু চাইলে বিবেচনাহীনভাবে সব কিছু দিয়ে দেবে। আরে সংসার তো আর কবিতার খাতা নয়!!! কোনভাবেই কোনো দিক থেকে রহমান তাকে ভরসা করে উঠতে পারেন নি।
‘এই শুনেছ, আমুদে রহমান হৈ চৈ করে মারিয়ামকে নাস্তার টেবিলে ডাকেন।
মারিয়াম খুব চিন্তিত মুখে এসে বসে। কি হয়েছে, কিছু বলছো?
ভাবছি, কিছু পেঁয়াজ বেশি করে কিনে রাখতে হবে। কেনো? হঠাৎ পেঁয়াজ কিনবে কেনো? মারিয়াম আকাশ থেকে পড়লেন।
“এসব তুমি বুঝবে না। বাজার তো আর তোমাকে করতে হয় না, তুমি আছ তোমার জগৎ নিয়ে”। তার চেয়ে বরং তোমাকে একটা কৌতুক শোনাই- সকাল সকাল একটা কৌতুক মনে পড়ে গেলো। এক লোক টাকার বিনিময়ে একজন সুন্দরি বউ পেলো অর্থাৎ লোকটি জীবনে এক ধরণের বাণিজ্য করলো। তার অনেক টাকা, সেজন্য অর্থনীতির ভাষায়, লোকটি একজন এপ্রিসিয়েশন এসেট কারণ তার আয় রোজগার ভালো এবং প্রতিবছর তা বাড়ছে।
অন্যদিকে বউটি হলো একজন ডেপ্রিসিয়েশন এসেট, তার সৌন্দর্য দেখে লোকটি তাকে কিনেছিলো কিন্তু প্রতিবছরই বউয়ের রূপ-যৌবন কমছে। প্রত্যেক ট্রেডিং এরই একটা পজিশন থাকে, ট্রেড ভ্যালু কমে গেলে, সাধারণতঃ তা বিক্রি করে দেয়া হয়। তাহলে বিয়েটা যদি একটা ট্রেডিং পজিশন হয়, লোকটি ভেবে দেখলো, দিন দিন তার বউয়ের ট্রেড ভ্যালু কমছে- তো সে ভাবলো, আহা! যদি বউ বিক্রী করা যেত কতই না ভালো হতো!
নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হেসে ওঠেন।
খোঁচাটা মেনে নিতেই হয়।
এ সংসারের সামন্তবাদি খবরদারিতে স্বামী প্রভু, তিনিই অর্থনৈতিক নিয়ন্তা। আর যৌথ রান্নাঘরের প্রভু মোমেনার মা। মারিয়াম হলেন, এ সংসারে প্রলেতারিয়েত। শ্রেণি বৈষম্যের দারুণ শিকার অথবা যার বর্তমানে কোনো ট্রেড ভ্যালু নেই। রহমান সাহেবের অনেক কথাই তবু তিনি হজম করে নিতে শিখে গেছেন, কখনও কথার পিঠে কথাও বলে থাকেন কিন্তু মোমেনার মা’কে কিছু বলার সাহস অন্তত তিনি রাখেন না। সংসারের যৌথ রান্না ঘরে আর যাই হোক, মোমেনার মায়ের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার উপায় তার কোনো ভাবেই নেই। রহমান বা মোমেনার মা যার বিপক্ষেই যান না কেনো, সংঘাত অনিবার্য। আর তাছাড়া এসব দেখার সময়ও তার নেই- তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়, টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে। তাই তিনি নিজেকে এই সংসারে একজন পাকা চরিত্রাভিনেত্রী বলে মনে করেন। রহমানের সামনে হাসি-খুশি স্ত্রীর চরিত্রে, মোমেনার মা’র সঙ্গে সন্ধি করে চলার অভিনয়, সন্তানদের কোনো কিছুর আঁচ পেতে না দিয়ে সুখি এবং আদর্শ মায়ের অভিনয়, সহকর্মীদের সাথে আদর্শ মানুষের অভিনয়, সমাজে চূড়ান্ত সুখি দাম্পত্যের অভিনয়। সংসারে রোজ সব চরিত্রগুলোকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলার চর্চা করা ছাড়া প্রকৃতই তার বিশেষ কাজ নেই।
রহমানের বাজারে যাবার খবর পাবার পর পরই মোমেনার মা হাজির হয়, আফা, আমার জন্য একটা ফেয়ার এণ্ড লাভলি ভিটামিন ক্রিম আনতেন। দেখেন, মুখে কিরাম কালো দাগ পড়ছে। একটা বেলী ফুলের ঘেরানি তেল লাগবে। দেখেন, চুলের কি অবস্থা! তার সাথে যুক্ত হয়, রোজকার তেল, চিনি, আটা, নুনের হিসাব, মেয়ের শীতের সোয়েটার, ছেলের স্কুলের খাতা, রঙ পেন্সিল এরকম হাজারটা বায় না
রহমানের কপালে গিঁট পড়ে। সংসারটা আসলেই একটা ব্ল্যাক হোল। প্রতিদিন দিন এত কিছু কেনেন কিন্তু কিছুই দৃশ্যমান নয়। রোজ বাজারের লিস্ট একই রকম লম্বা থাকে। তার চিড়বিরানো রাগটা গিয়ে পড়ে মারিয়ামের উপর। বেশ শক্ত করেই বলেন- সারাক্ষণ তো বাড়িতেই বসে থাকো। বাজার-ঘাটগুলো করে নিয়ে আসলেই পারো!! তোমার কাজের লোকের বায়না মেটানো তো আমার কাজ নয়। নিজে কিছু কাজ করলেই তো এই মোমেনার মা’কে হাতির মতো পালতে হয় না। বাধা বেতন ছাড়াও মোমেনার মা’র মাসিক খরচ কত তুমি জানো?
অথচ মারিয়াম সামান্য যা আয় করেন, তার সবই তুলে দেন রহমানের হাতে। বেশ তো কিছু টাকা দাও, বাজারের পাশাপাশি আজ দুপুরে বাইরে খেয়ে আসব। অনেক দিন রেস্টরেন্টে খাই না। খুব বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে। একা একা আজ কিছু ক্ষণ ঘুরতে চাই।
রহমান বিরক্তি নিয়ে উঠে পড়েন- ঢাকা শহরে বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে, কোথায় একা একা ঘুরবে? ফালতু চিন্তা-ভাবনা। থাক তোমাকে বাজারে যেতে হবে না। তার চেয়ে বাজারের লিস্টগুলো টেক্সট করে দাও। আমি আসার সময় বাজার করে আনব।
জগতের সকল সংঘাত এড়িয়ে চলা মারিয়াম আর ব্যাস্ত রহমান সাহেবের এইসব মামুলি কথাবার্তাই তাদের রোজকার প্রেম সঙ্গীত।
সম্পর্কের ফাঁক আর বিচ্ছিন্নতাটুকু ভরিয়ে তুলতে, দুজনের মধ্যে যোগাযোগের সেতু স্থাপন করতে সংসারে বড্ড দরকারী এসব জরুরি টেক্সট। সারাদিনে রহমান সাহেবের সাথে এই তার গভীর আলাপন। টেক্সট করতে গিয়ে, মারিয়াম উদ্ধার করলেন-মোট দুইশো চুয়াত্তরটা টেক্সট জমেছে। প্রত্যেকটিতেই সেই একই কথা, একই সুর-‘তেল, ডিম, চিনি অথবা মাছ-শাক এনো’
৪
আজকাল প্রায় কলেজ শেষে বাড়ি ফেরার আগের সংক্ষিপ্ত সময়টুকুতে সৌমেনের সংগে দেখা হলে, চুপচাপ মারিয়ামের মুখেও কথার খই ফুটতে থাকে। এটা ওটা নিয়ে দুজনের তর্ক আড্ডা চলতেই থাকে। একটা সম্পর্কের পরিণতি না জেনেই তার মধ্যকার ‘আমি’ হয়ে ওঠাটা তিনি কিছুতেই ঠেকাতে পারছেন না। নিজের মতো করে একটু বাঁচতে চাওয়া। সময় কাটানো। মনের মধ্যে আকুলি-বিকুলি করা সব ভাবনা শেয়ার করা এসব তার জীবনে কখনো ছিলই না। তার জীবনের ঘুড়িটা এতকাল ধরে বাঁধা আছে, স্বামী-সন্তানদের ইচ্ছে সুতোয়।
কিন্তু কেনো তিনি এরকম একটা জীবন কাটাবেন, কেনো তার ইচ্ছের কোনো দাম থাকবে না, কেনো তিনি একটু শক্ত হতে শিখছেন না, সবার ইচ্ছাই শুধু তার ইচ্ছা হবে কেনো, সৌমেন যখন এসব নিয়ে কথা শুরু করে, মারিয়াম তখন অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক ধরণের মাদকতা অনুভব করেন। প্রত্যেকটা ব্যাপারে কী তীব্র অনুভব ছেলেটার। তার জন্য কী নিবিড় বেদনা বোধ। অস্থির। এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতে পারে না। কখনও এ চেয়ার থেকে ও চেয়ারে, কখনো অদ্ভূত ভঙ্গিমায় দেয়ালে ঠেস দিয়ে মোহনীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, কখনো বসে, দুলে দুলে কথা বলছে। প্রাণ শক্তিতে ভরপুর। সুযোগ পেলেই মারিয়াম, তার গালে আঙুল ছুঁইয়ে দেন অথবা চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে চুল এলোমেলো করে দেন।
ছুঁয়ে দিলেই ছেলেটা ছটফট করে ওঠে, যেন বিছুটি পাতা লেগেছে গায়ে। খুব মজা পান তিনি এসবে এবং তিনি সেটা খুব তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেন। প্রাণ শক্তিতে ভরপুর ছেলেটার প্রাণ শক্তি যেন ছলকে ছলকে তার গায়েও পড়ে।
কিছু করতে না পেরে খুব রাগী রাগী ভঙ্গিতে বলতো, ‘দেখ, আমাকে এভাবে ছুঁয়ো না। আমি পছন্দ করি না’।
কেনো বন্ধুকে কি ছোঁওয়া বারণ? হাসতে হাসতে বলেন। তু্মি আমার ভীষণ প্রাণের বন্ধু। তোমার সঙ্গে খুঁনসুটি করবো না তো কার সঙ্গে করবো? দীর্ঘদিনের অভ্যাস, গ্লানি, দৈনন্দিন জীবন-যাপনের শ্লাঘায় যে শরীর কথাই বলে না, সে শরির নিয়ে আসলে মারিয়াম ততটা চিন্তিত নন। সৌমেনের সঙ্গ উপভোগ করেন, ওকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পছন্দ করেন। ওর মুখে নরম ভালোবাসার কথা শুনতে পছন্দ করেন কিন্তু পাশাপাশি ইদানীং এটাও বুঝতে পারেন যে উল্টোদিকে কপট রাগের আড়ালে ধীরে ধীরে সৌমেনের হেরে যাওয়াটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সৌমেনের চোখে তিনি নিবিড় করে পাওয়ার তৃষ্ণা দেখেন। প্রত্যক্ষ করেন তার দ্বান্দ্বিক অবস্থান। কারণ ভালোবাসাহীন স্পর্শটা সে দিতে বা নিতে চায় না। বিবেক তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। আবার এ বয়সেই তো বুনো আবেগ থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। এটাকে মারিয়াম খুব সহজভাবেই নিয়েছেন। যদিও সৌমেনের সংযম এবং নৈতিকতা দেখে, তিনি আশ্চর্য হচ্ছেন তারপরেও তিনি ঠিক করেছেন- সৌমেন যদি তার খুব কাছেও আসতে চায়, আপত্তি নেই তার। পাপ-পূণ্য, ন্যায়-অন্যায় বোধ তারও আছে, তারপরেও তিনি বিশ্বাস করেন, গাঢ় বন্ধুত্বের টানে খুব কাছে এসে সামান্য নিবিড় হওয়াতে কোনো পাপ নেই। সেরকম কোনো ট্যাবু সৌমেনেরও যে আছে, সেটাও তার মনে হয়নি।
যৌনতা যতটা না শরীরের তার চেয়ে ওটা অনেক বেশি মনের তৃষ্ণা। দু’টো মনের নিবিড় আগ্রহের স্পর্শ সবসময়ই সুখের। যখন কোনো স্পর্শে প্রাণ থাকে না, মন থাকে না তখন সেটা অসুখ। সেই অসুখে থাকে গভীর ক্ষত, থাকে বেদনা, তৈরি হয় গ্লানি।
সমবয়সীদের চেয়ে চিন্তা-চেতনা নানা ভাবনায় এগিয়ে থাকা, ছেলেটা নিশ্চয়ই তার মনের তৃষ্ণাটুকু মিটে গেলে আন্তরিক বন্ধুত্বের উষ্ণতাটুকু বুঝতে পারবে। আসলে মারিয়ামের কাছে বন্ধুত্ব মানে নির্ভরতা। এ বয়সে শারীরিক নির্ভরতার চেয়ে মানসিক নির্ভরতাটাই তার কাছে জরুরি। কিন্তু অল্প বয়সী একজন উদ্দাম তরুণের কাছে তার বিশুদ্ধ আবেগের অংশ হিসেবে শরীরি চাওয়াটুকু খুব তী্ব্র হবে, সেটাও নিখাদ। সেটাই কাম্য। সৌমেন মারিয়ামকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়, সে স্পর্শ করলে-মারিয়ামের ঘুমন্ত শরীর গান গাইবেই কিন্তু আজকের তরুণ, সৌমেন তার বন্ধুত্ব আর প্রেমকে এক কাতারে নিতে নারাজ। শুধু বন্ধুত্বে সবটুকু নিবিড় করে পাওয়ার আবদার সে করতে পারছে না অথচ ভেতরে ভেতরে ভাঙ্গছে! সৌমেনকে ভাঙ্গতে দেবেন না, তার আবদারটুকু মেটাবেন বলেই মারিয়াম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
( দ্বিতীয় পর্ব দেখুন এখানে )