ইসলামে বলা হয় ইসলামপূর্ব আরবে নারীর অবস্থা শোচনীয় ছিলো। ইসলাম উদ্ধার করে তাদের। সব ধর্ম ব্যবস্থাই তার পূর্বের ধর্মের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে। ঐতিহাসিক ভাবে সাধারণত সেটি সত্যি হয় না।
আরব নারীদের ইতিহাসে জানা যায়- ইসলামপূর্ব আরবে অনেক বেশি স্বাধীনতা ও অধিকার ছিলো নারীর। তারা অবরোধে থাকতো না, তারা সব ধরণের সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতো। তাদের প্রাধান্যও ছিলো সমাজে।
ইসলামপূর্ব আরবে কিংবা মোহাম্মদ যখন সবে তাঁর ধর্ম প্রচার শুরু করছেন তখনও আমরা বরং স্বাধীন ও স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবদানের জন্য স্বীকৃত নারী দেখতে পাই। একটি হাদীস থেকে জানা যায়- আরবে এক স্বাধীন নারী ছিলো, যে ছিলো দাসদের মলিক। তাঁর সাথে মোহাম্মদকে কথা বলতে হয়েছিল তাঁর কাঠের তৈরি মিম্বর (মঞ্চ বা পাটাতন) বানাবার প্রয়োজনে।
হাদিসে আছে: ১০৯১। “(সা:) রাজিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করিয়াছেন- একজন মোহাজের নারীর একটি ছুতার মিস্ত্রী ক্রীতদাস ছিল। হযরত নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লাম তাহার নিকট খবর পাঠাইলেন যে, তোমার ক্রীতদাসকে বল, আমার জন্য একটি মিম্বর তৈরী করিতে। সেই স্ত্রীলোকটি তাহার ক্রীতদাসকে উহা বানাইবার আদেশ করিল। সে ঝাউগাছ কাটিয়া আনিল এবং উহার কাষ্ঠ দ্বারা মিম্বর তৈরী করিল। মিম্বর প্রস্তুত হইলে পর স্ত্রীলোকটি হযরত নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লামের নিকট সংবাদ পাঠাইল যে মিম্বর প্রস্তুত হইয়াছে। তিনি উহা পাঠাইয়া দিবার জন্য আদেশ করিলেন, কতেক জন লোক উহা আনিল। অতঃপর হযরত নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লাম নিজ হস্তে উহাকে বর্তমান স্থানে বসাইয়াছিলেন।” (বোখারী শরীফ)”
প্রাক্-ইসলাম ও ইসলামের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে নারীকে আরবী সাহিত্যে বিশেষ করে কাব্যে অবদান রাখতে দেখা যায়। মহিলা কবিদের মধ্যে খনসা ছিলেন অসাধারণ (মৃতু: ২৪ হি.)। তার প্রকৃত নাম তুমাযের বিনতে আমর।
সম্পত্তির অধিকারী ও একজন স্বাধীন ব্যবসায়ী হিসাবে খাদিজার নাম আমরা জানি। প্রথম বয়সে মোহাম্মদ তার কর্মচারী ছিলেন। যিনি ৪/৫টি বিয়ে করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি বয়সে ছোটো মোহাম্মদকে বিয়ে করেন।
সম্পত্তির অধিকারী ও ব্যবসায়ী আসমা বিনতে মুখাররিবাহ্ নামে মক্কায় আরো একজন স্বাধীন নারীর নাম জানা যায়।
মক্কাকে কেন্দ্র করে তৎকালীন আরবে স্বকীয় ক্ষেত্রে অবদান রাখা স্বাধীন নারীদের যে উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় ইসলামের প্রচারের সাথে সাথে পরবর্তীকালে তা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। নারীরা সামাজিক প্রক্রিয়ার অংশগ্রহণ থেকে নির্বাসিত হয়ে ঘরের মধ্যে অবরোধে চলে যায়।
প্রকৃতপক্ষে প্রাক্-ইসলাম যে যুগকে আইয়ামে জাহেলিয়াত বা অন্ধকার যুগ বলা হয়, বাস্তব চিত্র ছিলো ঠিক তার বিপরীত। কিছু গোত্রে সেসময় কন্যাশিশু জীবন্ত কবর দেবার প্রথা থাকলেও আরবের সব গোত্রে নারীর অবস্থান নীচে ছিলো না। সেই সময় আরবের কিছু অঞ্চলে বিশেষভাবে মদীনায় মাতৃতান্ত্রিকতার প্রভাব দেখা যায়।
এ বিষয়ে মোহাম্মদের জীবনী রচয়িতা মন্টগোমারি ওয়াট তার Muhammad at Medina10 গ্রন্থে লিখেছেন: “যখন আমাদের তথ্যের উৎস সমূহ লিখিত হয়েছিল, সেই সময়ে পিতৃতান্ত্রিক ধারণা প্রবল হলেও মাতৃতান্ত্রিক সংগঠনের অনেক কিছুই লিখিত হয়েছে। তুলনামূলকভাবে মক্কার চেয়ে মদীনায় মেয়েদের বংশধারা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বনু হুদেইলাহ এবং বনু মঘালাহ্ এর মত কিছু গোষ্ঠী, মেয়েদের নাম গ্রহণ করত; এবং আনসার হয়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত হবার পূর্বে, আওস ও খাযরাজ উভয়কেই বনু কায়লাহ্ নামে পূর্ববর্তী বংশের সাধারণ একজন নারীর নামে ডাকা হত। ব্যক্তিও তাদের মায়ের নামে পরিচিত হত।
একটি কৌতুহলোদ্দীপক বিষয় হলো যে, কা’ব বিন আল-আশরাফ, তার ইহুদী মায়ের গোষ্ঠী আন-নাদির এর অন্তর্ভুক্ত হিসাবে পরিচিত ছিল, যদিও তার পিতা ছিল বেদুইন আরব গোত্রের।”
কিছু কিছু গোত্রে তখনও সেই সময়ে ক্ষয়িষ্ণু মাতৃতান্ত্রিকতার প্রভাব থাকায় গোত্রের সদস্যরা নারীর নামে পরিচিত হতো।
শিশুকন্যা হত্যার জন্য আরবরা খুব নিন্দিত ইতিহাসে। কিন্তু সবাই কন্যাশিশু হত্যা করতো না। সব কন্যাশিশুকে হত্যা করা হতো না। তাহলে তো জাতিটিই বিলুপ্ত হয়ে যেতো। এক পুরুষের চার স্ত্রী কেনো একটি স্ত্রীও জুটতো না। পুরুষকে পুরুষই বিয়ে করতে হতো! শিশুকন্যা হত্যা শুধু আরব রীতিই ছিলো না, পৃথিবীর বহু দেশে এমনকি ভারতেও ছিলো। এখনো তো ভারতের কিছু অঞ্চলে কন্যাশিশুর ভ্রুণ হত্যা চলে ব্যাপক হারে।
ইসলামের আগে এবং প্রথম পর্যায়ে নারীর যে অধিকার ও স্বাধীনতা ছিলো, যেটুকু সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা ছিলো ইসলাম সেটুকু কেড়ে নিয়ে পুরুষের কেবলমাত্র যৌনযন্ত্র হিসাবে বিবেচনা করে তাকে এক অন্ধকার জগতে নিয়ে গেছে।