ভেবেছিলাম, দুহাজার পনেরো বুঝি সাদাসিধে ভাবেই কাটবে। টরন্টো শহর ছেড়ে খুব দূরে কোথাও হয়তো যাব না। গেলেও বড় জোর কানাডার মাঝেই ঘুরে বেড়াব। নিদেনপক্ষে এ-শহরের বাইরের খানিকটা হাওয়া গায়ে লাগাতে চলে যেতে পারি মন্ট্রিয়ল কিংবা ক্যালগেরি। কিন্তু তাতো হল না। পায়ের নিচের শর্ষে সময় মতো জানান দিয়ে গেল। বললো- ‘চল মন এবার পুবের দেশে যাই, এবার ভব-দেশে ধাই!
গরমেই বেরিয়ে পড়লাম। শুরু হল ছোটাছুটি, আর তাই কেবল ছুটতেই থাকলাম। যদিও আমার কাছে উড়োজাহাজের ভ্রমণ সব সময়ই বোরিং, একঘেয়ে ক্লান্তিকর। এতে না দেখা যায় বাইরের পৃথিবী, না পাওয়া যায় উষ্ণতা। এই বাহনে চড়ে কেবল দীর্ঘতর পথ অতিক্রমের অপেক্ষায় বসে থাকি। এক-একটি ক্লান্তিকর বিমানযাত্রার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে প্রতিবার বলি, যাক বাঁচা গেল! দেশের সঙ্গে দূরত্বটি যদি সরাসরি ধরি তাহলে প্রায় সাড়ে বারো হাজার কিলোমিটার। যেহেতু ট্রানজিট ইত্যাদির কারণে, সেই দূরত্বের সঙ্গে যোগ হয় বাড়তি আরও হাজার তিনেক কিলোমিটার এবং সময়। কিন্তু কী আর করা, এই উড়ো-বাহনটি ছাড়া এতসব দীর্ঘ পথ, সমুদ্র পারি দেবার আর তো কোনো উপায় নেই।
ঢাকা, কলকাতা, দিল্লী, মিউনিখ, জুরিখ। ছুটতে ছুটতে দম নেবার ফুসরৎ পর্যন্ত পাই না যেন। এক এক জায়গায় এক এক টাইম টেবিল। আমার ঘুমের দফারফারও একসময় বারোটা বেজে যেতে বাধ্য হয় এবং হয়ে যায়ও। উত্তর আমেরিকায় যখন রাত, এশিয়ায় তখন সকাল। আর মাঝখানে ইউরোপ মাঝামাঝি সময় ধরে কখনো দিন দিচ্ছে, নয়তো রাত। তারই মাঝে কখনো জাগছি, কখনো ঘুমাচ্ছি, কখনো বা ঝিমুচ্ছি। এ সবকিছু মিলিয়ে দৌড়চ্ছি। এলোমেলো ঘুম, কখনো উড়োজাহাজের জানালা খুললে ক্লান্ত চোখের উপর রোদ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জানালার বাইরে আকাশ ভরে রোদ ঝলমল করছে। আরে রোদ কেন! এখন তো অন্ধকার থাকার কথা! হিসাব করে কূল পাই না। আবার ঠিক তেমনই, যখন আলো আছে ভেবে, মহাশূন্যের উড়ো উড়ো মেঘ দেখব বলে বাইরে উঁকি দিয়েছি, তখনই হয়তো আঁধারের ডুবুরি সাঁতার। কখন যে সবকিছু পালটে পালটে যাচ্ছে। এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে ঢুকে যাচ্ছি, মিলাতে পারি না।
পৃথিবী তার গোলগাল অবয়ব থেকে ঠিকঠাক আলো-আঁধারের আমদানি করে যাচ্ছে, আমিই কেবল মিল-অমিলের খেলায় এলো-ঝেলো করে ফেলছি দিন ও রাত্রি। যদিও আমার হাতের ঘড়ি কখনো হয়তো জানান দিচ্ছে- আরে এখন তো টরন্টোতে গভীর রাত! আবার কখনো বা জানিয়ে যাচ্ছে, ঘড়ির কাঁটা বদলে স্থানীয় সময় মিলিয়ে নাও গো বাপু। হয়তো খুঁজছি রোদ ভরা আকাশ! যাই হোক, এক সময় মহাকাশের এসব কারসাজি নিয়ে চিন্তা-ভাবনার সুইচ অফ করে চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকি যাত্রা সমাপ্তির।
এবারের এই উড়ালের বিশেষ একটি কারণও রয়েছে। যে জন্যে ছুটে যাচ্ছি উত্তর গোলার্ধ থেকে পূর্ব গোলার্ধ পর্যন্ত। গরমকালে সাধারণত পুবে যাওয়া হয় না। উত্তরের দেশে থাকতে থাকতে এখন পুবের গরমটা সয়ে নিতে যেন বেশ সাধ্য-সাধনা করতে হয়। তেমনই কলকাতা এবং বাংলাদেশের বইমেলাও শুরু হয় জানুয়ারি ফেব্রুয়ারিতে। কাজেই নানা কারণে গরম মৌসুমে ও-মুখো হওয়া হয়নি প্রায় তেরো বছর। কিন্তু একটা ঘটনা তো ঘটতেই যাচ্ছে, আর তারই জন্যে যেতে হবে এই সময়ে। তা হলো- জুন মাসের কুড়ি তারিখে কলকাতার একেবারে আনকোরা নতুন প্রকাশনা ‘বাহান্ন প্রকাশ’ থেকে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে আমার গদ্যবই ‘কফি শপ’। হ্যাঁ সেই ‘কফি শপ’ যাকে আমি ‘বাংলা লাইভ’-এর ব্লগে নিয়মিত লিখে গেছি দুহাজার তেরো থেকে। সেখান থেকে নির্বাচিত লেখা নিয়ে প্রকাশিত হবে আমার তৃতীয় গদ্য সংকলন। কেবল আমার একার বলছি কেন, আরও চারজন নারী লেখকের চারখানা গদ্য গ্রন্থ প্রকাশ করতে যাচ্ছে বাহান্ন প্রকাশ। আর এই লেখকেরাও ছড়িয়ে আছেন সারা বিশ্বময়। আমি আছি টরন্টোতে। লন্ডনে থাকেন কবি শামীম আজাদ, তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘প্রিয়ংবদা’, ঢাকাবাসী বাবলী হকের উপন্যাস ‘আম্বিয়াদাদি ও তার বিড়ালেরা’ এবং কলকাতার মেয়ে মৈত্রী রায় মৌলিকের কিশোর উপন্যাস ‘উসামাসিনটার দেশে’। দারুণ উত্তেজনা বোধ করছি। বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা চারজন নারী লেখককে যোগাযোগ করে, তাঁদের কাছ থেকে একসঙ্গে এতগুলো গদ্যের বই আদায় করে নেয়া কি চাট্টিখানি ব্যাপার! কিন্তু এই অসাধ্য সংযোগ এবং ঘটনাটি ঘটালেন কলকাতার বই প্রকাশনা জগতের নতুন প্রকাশক সুদেষ্ণা মজুমদার। যিনি নিজেও একজন লেখক এবং বিখ্যাত সাহিত্য ম্যাগাজিন কৌরবের অন্যতম সম্পাদক। কিন্তু প্রকাশক হিসেবে তাঁর এই বুৎপত্তি আমাদের সকলকে ‘হ্যাঁ’ বলিয়ে নিয়েছে। আমরা কথা দিলাম বইপ্রকাশের আয়োজন উপলক্ষে কলকাতায় উপস্থিত থাকব সময় মতো।
যদিও এই কথা দেয়া বাস্তবে রূপ দিতে হলে লম্বা প্রসেসের ব্যাপার, তাও আমরা যাব বাহান্ন’র ডাকে- এটাই চূড়ান্ত। বাহান্ন প্রকাশের কর্ণধার সুদেষ্ণা মজুমদার তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি প্রকাশনার ভিত তৈরি করতে চলেছেন। সেই প্রকাশনার প্রথম আত্মপ্রকাশের আয়োজন। সে এক বিশাল যজ্ঞ বলেই মনে হচ্ছে। কারণ, টরন্টো, লন্ডন, ঢাকা আর কলকাতার সঙ্গে দুরালাপ, মানে ফোনে কথাবার্তা তো তারই ইঙ্গিত দেয়। কলকাতা শহরের হাজারো প্রকাশনার মাঝে একটি নতুন প্রকাশনার আত্মপ্রকাশ। এ যেমন নতুন খবর, তার চেয়ে আরও অনেক বেশি করে একে দুঃসাহসের খবর বললেই বোধহয় বেশি মানায়। আমরা চারজন তাঁর নির্বাচিত লেখক। প্রথম আত্মপ্রকাশ। কাজেই না গেলেই নয়। সুতরাং ঢাকা, লন্ডন, টরন্টো লেগে গেল টিকেট সংগ্রহ, ভিসা লাগানোর মতো হ্যাপার কাজে। এদিকে মৈত্রী রায় মৌলিক কলকাতার মেয়ে হলেও, পেশাগত কারণে বর্তমানে ত্রিপুরায় অবস্থান করছেন। কাজেই তাঁকেও আসতে হচ্ছে নানা আয়োজন সামলে। এদিকে সমানে পাশাপাশি চলছে লেখার সংশোধনী, বাক্যের বুজরুকি নিয়ে বচসা, অবশেষে এক-বিন্দুতে এসে সম্মত হওয়ার স্বস্তি। আর এ সব কিছুই চলছে ইমেইল, অনলাইন এবং ফোনে।
কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে এলেও, কয়েকটি দিন বাংলাদেশে আত্মীয়-পরিজন এবং বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কাটিয়ে না এসে পারা যায় না। এত কাছে যাব, আর নিজের বাড়িতে যাব না, তা কি হয়? আর এদিকে মনে মনে বারবার চেয়েছি, কত কাল হয়ে গেছে বাংলাদেশের বৃষ্টি দেখিনি। এবার তা নিশ্চয়ই দেখে আসব। প্রকৃতি আমাকে নিরাশ করেনি। উজার করে দিলো তার জল-ধারা। বিদ্যুতের চমক আর মেঘের গর্জন মিলিয়ে আকুল চোখে বৃষ্টি দেখে গেছি। বৃষ্টি দেখতে দেখতে ভুলেই গেলাম যে, এসব থেকে এখন কত দূরে চলে গেছি! ভীষণ চেনা এই বৃষ্টিকে দেখে অনেক আনন্দ পেলাম, যখন, অবিন্যস্ত ভাবে গড়ে ওঠা উঁচু উঁচু দালান-কোঠার এই শহরে, চৌদ্দতল অ্যাপার্টমেন্টের তিনতলা বারান্দা দাঁড়িয়ে, উলটো দিকের টিনের বাড়ির ছাদে অঝর ধারার বৃষ্টি পড়ার ঝমঝম শব্দকে স্পষ্ট দেখলাম, অনুভব করলাম! যার জন্যে তেরো বছর অপেক্ষা করে আছি- বর্ষায় বাংলাদেশের বৃষ্টি দেখব! এবার সে সাধ পূরণ হল। বঞ্চিত না হওয়ার এই শিহরন ভরে নিলাম বুকের দেরাজে।
নির্ধারিত দিনে, যথা সময়ে উড়াল দিলাম কলকাতার উদ্দেশ্যে। জুনের মাঝামাঝি দুপুরবেলা যাত্রা করে নানাবিধ জ্যাম পেরিয়ে, ঢাকা এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম বিকেল পৌনে পাঁচটা নাগাদ। বাংলাদেশ বিমানে করে কলকাতা যাচ্ছি। রিপোর্টিং টাইম শুরু হবে বিকেল পাঁচটা ত্রিশ মিনিটে। ভিতরে ঢুকে লাইনে দাঁড়াতেই জানলাম, এই বছরের বাজেটে ভ্রমণ-ট্যাক্স আরোপ করা হয়েছে। সুতরাং যাও আবার ট্যাক্স দিতে। দৌড় লাগালাম, না জানি কত বড়ো লাইন! গিয়ে দেখলাম, তেমন বড়ো কোনো লাইন নয়। ট্রাভেল ট্যাক্সের রিসিট নিয়ে আবারো বোর্ডিং পাস নেবার জন্য লাইনে এসে দাঁড়ালাম। এখানেও বিশেষ সময় লাগল না। দূর-যাত্রার সব নিয়ম কায়দা-কানুন পেরিয়ে এয়ারপোর্টের যাত্রী অপেক্ষা লাউঞ্জে বসে আছি। ভেতরে ভেতরে মন বিষণ্ণ লাগছে, সদ্য সকলকে ছেড়ে অন্য গন্তব্যে যাত্রা শুরু করেছি। বোন-ভাই-বন্ধু-আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ঘুরে ঘুরে মনে পড়ছে। আবার কবে তাদের সঙ্গে দেখা হবে কে জানে।
লাউঞ্জে বসে অপেক্ষা করা মানে, এক ভূমি থেকে অন্য আরেক ভূমিতে প্রবেশের উৎকণ্ঠা। নানান নিয়ম-কানুনের বেড়াজাল ডিঙিয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে যাবার জন্য উদগ্রীব অপেক্ষা। বারবার মনে হচ্ছিল, কেন এই পাসপোর্ট পাসপোর্ট খেলা, কেন এই একটি মাত্র পৃথিবী জুড়ে এত কাঁটাতারের বেড়া! আর সে বেড়াগুলো টপকে যেতে কত না নিষ্ঠুর নিয়মের বেড়াজাল, হাজারো কঠিন নিয়ম-কানুন। মানুষে মানুষে বিভেদের দেয়াল দৃশ্য-অদৃশ্য নানা কায়দায় বারবার মনে করিয়ে দেয়- সম্পূর্ণ পৃথিবী আমার নয়, আমি খণ্ডিত! আমি বিভক্ত! আমি অপমানিত! মানুষ হিসাব এই একটি মাত্র পৃথিবীকে আমি পুরোপুরি আমার ভাবতে চাইলেও, আমাকে তা ভাবতে দেয়া হয় না! এই অপমান আমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলে। কতিপয় মানুষের ক্ষমতা এবং স্বেচ্ছাচার পুরো পৃথিবীকে খণ্ড-বিখণ্ড করে দিয়েছে, লণ্ড ভণ্ড করে দিয়েছে চারদিক! তাই এত হানাহানি, এত রক্তক্ষয়, মানুষে মানুষে এত বিচ্ছেদ!
এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করতে করতে দেখলাম, মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে যাওয়া অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষের বহর। কেউ যাচ্ছেন দুবাই, কেউ কাতার, কেউ আবুধাবি। তাঁদের ভেতরে কিছু নারী শ্রমিকেরও দেখা পেলাম। আমার পাশেই তাঁদের কেউ কেউ বসে আছেন। একজন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে যাচ্ছি কিনা? না বলাতে আবারো জানতে চাইলেন- তাহলে কোথায়? বললাম, কলকাতা। এবার আমি নিজেই তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা মধ্যপ্রাচ্যে কী করতে যাচ্ছেন? প্রথমে সংকোচ পেলেও আমার আন্তরিকতায় সহজভাবেই জানাল, ওসব দেশে তাঁরা গৃহ-পরিচারিকার কাজ করেন। ভেতরে ভেতরে চমকে গেলাম! আর কোনো প্রশ্ন করতে সাহসে কুলাল না। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আপনাতেই। কারণ, কিছু দিন আগে অনলাইনে একটি ভিডিও দেখেছিলাম- বাংলাদেশি একজন গৃহ-পরিচারিকার উপরে আরবীয় গৃহকর্তার বর্বর অত্যাচারের বাস্তব চিত্র। সকালবেলা ব্রেকফাস্টের টেবিলে গৃহ-পরিচারিকাটি কী ভুল করেছে কে জানে। তারই শাস্তি-সরূপ সারা ঘরময় নারী-পুরুষ, ছোটো-বড়ো সকলের সামনে আরবদেশীয় মনিবটি তার বাংলাদেশি গৃহ-পরিচারিকাকে চাবুক নিয়ে তাড়া করে ফিরছে। মেয়েটি দৌড়ে দৌড়ে নিজেকে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। নাগালের মধ্যে পেলেই সপাং সপাং চাবুক পড়ছে মেয়েটির গায়ে। আর নির্বিকার দৃষ্টিতে সেই দৃশ্য ঘরের সকলে দেখছে এবং সকালের খাবার খেয়ে যাচ্ছে। যেন এটা এমন কোনো বিষয়ই নয়, নিত্যদিনের মামুলি কিছু। ঘরের অন্যান্য সদস্যদের নির্বাক অভিব্যক্তি অসভ্য যুগের অতীতকে মনে করিয়ে দিলো। কেউ কোনো প্রতিবাদ করছে না। যদিও তাদেরই একজন মোবাইলে এই অমানবিক চিত্রটি রেকর্ড করেছে। তারপরও কাউকেই দেখিনি সেসময় নির্যাতিতাকে রক্ষা করার সামান্যতম চেষ্টা করতে। আর বাংলাদেশের অসহায় মেয়েটি পুরো সময় ধরে ছোটাছুটি করেও, মনিবের চাবুকের আঘাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি।
এয়ারপোর্টে নানা চিত্র-বিচিত্রতার মাঝে মন ভার নিয়ে বসে থেকেও কেটে গেল ডিপার্চার টাইমটুকু। এবার কলকাতা থেকেই কানাডা ফিরে যাব। প্লেনের জানালা দিয়ে ঢাকা শহরকে দেখার চেষ্টা করতেই, এখনো কেন যে চোখের জলে ঝাপসা হয়ে যায় সব ছবি, বুঝি না! নিজে নিজে মনকে বলি, ও মন তুই কবে সাবালক হবি!
ঘণ্টাখানেক পর পৌঁছে গেলাম কলকাতার মাটিতে, ‘বাহান্ন প্রকাশ’-এর দেশে। যে জন্যে এত দূর ছুটে আসা। যদিও কলকাতার সঙ্গে আমার পরিচয় সেই বোধ হওয়া থেকেই। কারণ, আমার মা তাঁর ছেলেবেলার অনেকটা সময় এখানে ছিলেন। পার্টিশনের আগে চাকুরী উপলক্ষে নানাজান কলকাতাবাসী ছিলেন। মা তখন এই এত্তটুকুন। কাজেই তাঁর জীবনের শুরু থেকেই ‘কলকাতা’ শহরটির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন, কিংবা কলকাতা শহরটি জড়িয়ে আছে তাঁর সঙ্গে। মায়ের মুখে শুনে শুনে এই শহর, দেখার আগেই আমার কাছে আপন হয়েছিল। তারপর তো আজ সেখানে নিজেরই কত কত আপনজন। আর বোহেমিয়ান জীবনের প্রথম হাতেখড়ি দিয়েছি তো এখানে এসে এসেই।
কলকাতা পৌঁছে বাহান্ন প্রকাশের কাজের সঙ্গে ভিড়ে গেলাম। সুদেষ্ণা মজুমদারের সঙ্গে ছুটছি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দ্বারভাঙা হল’, কলেজ স্ট্রিট, সরবতের দোকান প্যারামাউন্ট, কফি হাউজ, আরও কত না জায়গায়। পথে পড়লেই ঢুকে পড়ছি রাস বিহারী অ্যাভিনিউর সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট ‘বানানা লিফ’-এ। যাকে আমি বাংলা করে ‘কলা পাতা’ বলে ডাকি। এত দৌড়ঝাঁপে আমি হাঁপিয়ে গেলেও, কর্ণধার সুদেষ্ণা এক্কেবারে না। সবকিছু একহাতে সামাল দিয়ে যাচ্ছে। ওর প্রাণশক্তি দেখে অবাক হতে হয়। ইতোমধ্যে শহরে এসে পৌঁছে গেলেন সাহিত্যিক বাবলী হক। কী ভীষণ আনন্দ। এবার শামীম আজাদের অপেক্ষা। নির্ধারিত তারিখে তিনিও চলে এলেন। কলকাতার নিউ মার্কেট লাগোয়া লিন্ডসে স্ট্রিটের স্যাফাইয়ার স্যুইটে তখন আনন্দের বন্যা বইতে শুরু করেছে। ফুর্তি ও উল্লাস নিয়ে হাসাহাসি করতে করতে বললাম- এখানকার বোর্ডারেরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে জেনে গেছে, সত্যি সত্যি বুঝি তিন মহাদেশ থেকে তিনজন ঝাঁসির রানীর আগমন ঘটেছে!
২০ জুন, অনুষ্ঠানের দিনও চলে এলো। একটু বৃষ্টি হচ্ছে। তাতে কী, আমাদের যেতে হবে সব কিছু ভেঙে অনেক নতুন প্রত্যাশার মাঝে। মনে মনে অপেক্ষায় আছি, ওখানে গেলে দেখা হবে বেশ কিছু বন্ধুর সঙ্গে। যারা জানেন অনেক দূর থেকে আমরা তাঁদের শহরে এসেছি, একটি পরম মাহেন্দ্রক্ষণকে স্বাগত জানাতে। আর বাংলাদেশের মহান ভাষা আন্দোলনকে স্মরণ করে যে প্রকাশনার জন্ম হল, সেই বাহান্ন প্রকাশকে সম্মান জানাতে।
বলতে গেলে সময় মতোই অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল, হেরিটেজ স্ট্যাটাস পাওয়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙা হলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসের ‘দ্বারভাঙা ভবন’-এর জন্ম ১৯১২-তে। কাঠের রেলিং দেয়া শ্বেতপাথরে সুদীর্ঘ সিঁড়ি ভেঙে দোতালায় উঠে গেলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় ভাইস-চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আবক্ষ মূর্তি। ব্রিটিশ আমলে গড়া উঁচু ছাদ ও লোহার স্ট্রাকচার নিজেই বলে দিচ্ছে এই হলের বিশেষত্ব। আস্তে আস্তে হলঘর ভরে যেতে শুরু করল। এখানে চারপাশের দেয়াল জুড়ে গুণীজনদের বিশাল বিশাল সব তেলরং ছবি। আমরা যেখানে বসেছিলাম, সেই দেয়ালে মাথার উপর পর পর সাজানো রয়েছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পেইন্টিং। বনেদি আমেজ আর হেরিটেজের ঘ্রাণ নিয়ে অনুষ্ঠান গৃহটি ভরে উঠল সুধী জনের উষ্ণ-আন্তরিক উপস্থিতিতে।
শুরুতেই ফুল দিয়ে স্বাগত জানানো হল। এবার মূল অনুষ্ঠান- বইয়ের মোড়ক উন্মোচন। কবি চৈতালী চট্টোপাধ্যায় উদ্বোধন করলেন শামীম আজাদের ‘প্রিয়ংবদা’। কবি বারীন ঘোষাল বাবলী হকের ‘আম্বিয়াদাদি ও তার বিড়ালেরা’। প্রাবন্ধিক জয়া মিত্র করলেন মৈত্রী রায় মৌলিকের ‘উসামাসিনটার দেশে’ এবং আমার ‘কফি শপ’ উদ্বোধন করলেন কবি শর্মী পাণ্ডে। একে একে প্রতিটি বই সম্পর্কে বললেন উদ্বোধকরা। বক্তব্য রাখলেন দে'জ পাবলিকেশনের অন্যতম সুধাংশু দে, কবি শুভঙ্কর দাস। লেখকদের কথা শুনলেন উপস্থিত দর্শক ও শ্রোতারা। প্রশ্ন করলেন, জানতে চাইলেন অনেক কিছু। বাংলাদেশ থেকে আগত কবি শাহেদ কায়েস উপস্থিত সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর দিলেন। পুরো অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন গল্পকার শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য। দর্শক ও শ্রোতার আসনে অনেক গুণীজনকে পেলাম। সেই সঙ্গে দেখা হল অনেকগুলো প্রিয়মুখ ও আপনজনের সঙ্গে। যাদের অনেকের সঙ্গেই এ পর্যন্ত চাক্ষুষ দেখা হয়নি, ফেসবুকেই আলাপ। তাদের সঙ্গে সামনা সামনি দেখা হওয়ায় ভীষণ আনন্দ বোধ করলাম। বাংলাদেশ থেকেও অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন প্রিয় কজন শুভাকাঙ্ক্ষী। আবার এমন অনেকেই আসেননি যাঁদেরকে আশা করেছিলাম, অথবা যারা আসবেন বলে কথা দিয়েছিলেন।
শেষ হল অনুষ্ঠান। আপ্যায়ন, পরিচিতদের সঙ্গে উষ্ণতা বিনিময়, বই বিক্রি, অটোগ্রাফ আর ফটো তোলার পর্ব পেরিয়ে, দল বেঁধে কফি হাউজের দিকে পা বাড়ালাম। কলেজ স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে কত না মজার মজার কথা, হাসি, গল্প, কাহিনী। একটি সফল অনুষ্ঠানের তৃপ্তি নিয়ে তখন সকলেই উত্তেজিত, আনন্দিত। বাহান্ন প্রকাশ-এর প্রথম বই প্রকাশ অনুষ্ঠান আমাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল এক অন্য পৃথিবীতে। আমরা যারা দূরদেশ থেকে এসেছি, তারা যেন ভুলেই গেলাম, আবারো আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে যার যার গন্তব্যে, বহুদূরে। মন শুধু অনুভব করছে- যেন এভাবেই চিরকাল পাশাপাশি হাঁটব, আড্ডা দেবো, গান গাইব, ভালোবাসব। এছাড়া যেন আর কিছু করার জন্য জন্মাইনি আমরা। দল বেঁধে ঢুকে পড়লাম মান্না দে’র সেই কফি হাউজের আড্ডার সন্ধানে। তবে সেদিনের সেই আড্ডাটি সত্যি সত্যি ফিরে এলো সঘন মেঘের তুমুল বর্ষা হয়ে।