ফারজানা কাজী

সমাজ কর্মী

ধর্মের ভণ্ডামির আরেক নাম 'রমজানের পবিত্রতা'

রোজার দিন এলে বাবার কাছ থেকে একটি ঘটনা শুনি প্রায়ই। একাত্তর সালে রমজান মাসে পাকিস্তানিদের দোসর রাজাকারেরা লাঠি হাতে রাস্তায় নেমে রাস্তার পাশের খাবারের দোকানগুলো খুলে রাখার জন্যে দোকানদারদের ধরে পেটাচ্ছে। আর যারা খাবার খচ্ছিলো, তাদেরও। একজন মার খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে অসহায়ের মতো বলছে ‘বাবারা আমরা হিন্দু, গরীব-খেটে খাওয়া মানুষ। আমাদেরকে কেনো মারছো? না খেলে আমরা কাজ করবো কিভাবে?’ রাজাকারেরা বলছে ‘না, খেতে পারবি না। হয় মুসলমান হয়ে যা, নইলে দেশ ছেড়ে চলে যা। রমজান মাসে খাওয়া চলবে না।’

পরবর্তীতে এই চিত্র দেখা না গেলেও বিগত কয়েক বছর ধরে প্রায় একই কাহিনী ঘটে যাচ্ছে। রোজা এলেই রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষা নিয়ে নানা আয়োজন করতে দেখা যাচ্ছে। কোনো খাবারের দোকান বা হোটেল খোলা রাখা যাবে না। এমন কি রাস্তার পাশের চায়ের দোকানগুলোও বন্ধ থাকবে। তারপর হয়তো দোকানদারেরা নিজের পেটে চালানোর কারণেই কিছু খাবারের দোকান খোলে, তাও পর্দা দিয়ে ঘেরা থাকে।

বুঝলাম এটি ৯০% মুসলমানের দেশ। এ দেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। কিন্তু তাই বলে এদেশে কি অন্য ১০% ধর্মের মানুষ বসবাস করছে না? তাদের প্রতিদিনের চাহিদা পূরণের কথা চিন্তা না করে রমজানের পবিত্রতা রক্ষার কথা বলে অধিকাংশ খাবারের দোকান বন্ধ রাখা হচ্ছে। এসবের কী মানে? অমুসলিমদের খেতে না দেওয়ার অধিকার এদের দিলো কে? আবার যে দোকানগুলো খোলা রাখা আছে সেখানেও পর্দা টানিয়ে আড়াল করে তারপর খাবার খেতে হয়। খাবার খাওয়া কেনো লজ্জার বিষয় হবে যে পর্দা টানিয়ে রাখতে হবে? কেউ রোজা রাখবে কি রাখবে না সেটি নিতান্ত তার ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু এই রমজানে খাবার খেতে গেলে খেতে হয় চোরের মতো লুকিয়ে, পর্দার আড়ালে। এবং এটি এখন একটি সামাজিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন আর পাকিস্তানি যুগ নেই। কিন্তু পাকিস্তানীদের বীজ রয়ে গেছে। ওদের দোসর রাজাকারদের বংশধরেরা রয়ে গেছে।

রমজান মাসে সুদ-ঘুষ খেলে পবিত্রতা নষ্ট হয় না, ধর্ষণ করে খুন করলে, বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করলে, নানাবিধ জঘন্য কাজ করলে পবিত্রতা নষ্ট হয় না। ইয়াবা খেলে, মাদক নিলে পবিত্রতা নষ্ট হয় না, রোজার মাসে নির্লজ্জ লোভে জিনিসপত্রের দাম দুই গুণ, তিন গুণ বাড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত টাকা লুটে নিলে রমজানের পবিত্রতা নষ্ট হয় না, রোজাদারদের খাবারে ভেজাল দিয়ে স্থায়ী ক্ষতি করলেও রমজানের পবিত্রতা নষ্ট হয় না, কিন্তু রমজানের পবিত্রতা নষ্ট হয় খাবারের দোকান, রাস্তার পাশে চায়ের দোকান খোলা রাখলে! আশ্চর্য! ধর্মের এই ভণ্ডামির নাম রমজানের পবিত্রতা!

সকালে অফিসগামী সাধারণ মধ্যবিত্ত, ভার্সিটির শিক্ষার্থী, নিম্নবিত্ত, শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশাচালকেরা, যাদের সারাদিন প্রবল পরিশ্রম করতে হয় বলে তারা অনেকেই রোজা রাখতে পারেন না, অসুস্থতা বা নানা কারণে অনেকে রোজা রাখতে পারেন না। অসংখ্য ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ আছেন, এরা কোথায় খাবেন? এই যে সমাজের উগ্র ধর্মান্ধ এই মানুষগুলো “রমজানের পবিত্রতা” রক্ষার নামে খাবারের দোকান, হোটেল বন্ধ রাখার কথা বলছেন, এরা কি একবারো ভেবে দেখেছেন যে এই বিশাল জনগোষ্ঠী যারা রোজা রাখতে পারবেন না, তারা কোথায় খাবেন? নাকি মনে করেছেন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও মুসলমান হয়ে গিয়ে রোজা রাখা শুরু করে দেবেন? হ্যাঁ, তারা এটাই চাচ্ছেন। এবং চাচ্ছেন এই অমুসলিমরা খুব তাড়াতাড়ি দেশ ছেড়ে চলে যাক। কতো বড় নির্লজ্জ হলে মানুষ এ ধরণের বাড়াবাড়ি করতে পারে?

ক্ষুধার্তের কষ্ট বোঝার জন্যে রোজা রাখার প্রচলন করেছে ধর্ম। কিন্তু যারা জানেন দিনের নির্দিষ্ট একটি সময়ে টেবিল ভর্তি খাবারের নিশ্চয়তা তাদের জন্যে রয়েছে, তারা কি করে বুঝবেন দিনের পর দিন না খেয়ে থাকা ক্ষুধার্তের যন্ত্রণা?

যে মানুষটি এই গরমে উত্তপ্ত রাজপথে রিকশা চালায়, যে মানুষটি মাটি কাটে, ইট ভাঙ্গে, দিনমজুর হিসেবে খাটে, তারা কিভাবে রোজা রাখবেন? এই কাজগুলো পবিত্রতা রক্ষাওয়ালারা করে দেখেছেন কখনো? উনারা তো রোজা রেখে সারাদিন ঘুমিয়েও কাটিয়ে দিতে পারেন, কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষগুলো কি করবেন? খাবেন কি? যিনি অসুস্থ কিংবা সারাদিন পরিশ্রম করা মানু্ষ, অমুসলিম- এদের খাবার অধিকার থাকবে না? এ কেমন পবিত্রতা রক্ষা? নাকি কাউকে খেতে দেখলে রোজাদারেরা লোভ সামলাতে পারেন না? তাই পবিত্রতা রক্ষার নামে সমস্ত খাবার দোকান, হোটেল বন্ধ করে দিতে চায়? পবিত্রতা রক্ষার নামে মানুষকে খেতে না দেওয়ার অধিকার এদের দিয়েছে কে? অন্যের মুখের খাবার কেড়ে নেওয়ার নাম কি রমজানের পবিত্রতা? রোজার মাস আসলে নতুন করে চেনা যায় শান্তির ধর্মকে! এদের কথা শুনলে মনে হয় মুসলমানেরা পৃথিবীর বুকে একমাত্র শান্তি প্রিয় প্রাণী। কিন্তু মুমিনদের কার্যকলাপ ও আচরণের উপর দৃষ্টিপাত করলে খুব সহজে বোঝা যায় তারা কতটা শান্তি প্রিয় আর কতখানি ধর্মনিরপেক্ষ!

ধর্ম পালনের অধিকার যেমন একজন মানুষের আছে, তেমনি ধর্মহীন হয়েও পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকারও একজন মানুষের আছে। কিন্তু মুসলমানেরা সেটি কখনো মানতে রাজি না। তারা চায় তাদের দেখানো বিধিবিধান সবাই মেনে চলুক। এক কথায় নিজেদের নিয়ম-কানুনগুলো অনেকটা জোর করে অন্যেদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা। তারা যা চাইবে তাই করতে হবে। তা না হলে কঠিন শাস্তি, নির্যাতিত হতে হবে মুমিনদের হাতে! এগুলো বাড়াবাড়ি রকমের অসভ্যতা। এদের বিবেকবোধ, মনুষ্যত্ব সবই ধর্ম গিলে খেয়েছে। এদেশে সত্যি বলতে কেউই স্বাধীন নয়। তবে মনে হয় এদেশে শুধুমাত্র ধর্মান্ধরাই স্বাধীন। আর আমাদের প্রশাসন তো শুধু ধর্মান্ধদের জন্যে!

যাদের অন্যের খাওয়ার দৃশ্য দেখে রোজা ভেঙে যাওয়ার ভয় তাদের রোজা থাকার দরকার কি? পূণ্য অর্জনের জন্যে রোজা রাখবে, কিন্তু অন্যের খাওয়ার দৃশ্য সহ্য হবে না! বাহাত্তর হূর পাওয়ার লোভে রোজা রাখবে, কিন্তু অমুসলিমদের খেতে দিবে না! কী আজব! নিজেদের ক্ষুর্ধাত শরীর-মনকে শান্ত করার জন্যে অন্যদের খাওয়া দাওয়া বন্ধে উঠে পড়ে লাগা এক বিচিত্র অসুখ মুসলমানের!

25350 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।