অবিবাহিত নারীর যৌনতা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে নিষিদ্ধ। পশ্চিমা সমাজের কোনো কোনো জায়গায় এটি সম্ভব হলেও পূর্বাঞ্চলে অবিবাহিত নারীর যৌনতা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এখানে কেনো বিবাহিত নারীর বিয়ে বহির্ভূত যৌনতা আইনত অপরাধ হলেও সমাজ তা সহ্য করে নেয়, কিন্তু অবিবাহিত নারীর যৌনতা আরো ভয়ানক অপরাধ বলে গণ্য হয়। যৌনতা চাইলে নারীকে বিয়ে করতেই হবে। বিয়েতে নারী পায় যৌনতার বৈধতা। কিন্তু যৌনতার ক্ষেত্রে কেনো বৈধ-অবৈধতার প্রশ্ন আসবে? যৌনতা একটি জৈবিক চাহিদা। সমস্ত প্রাণীর যেমন ক্ষুধা পায়, তেমনি যৌনতাও পায়।বাংলাদেশে নারীর বিয়ে এবং সংসার অনিবার্য পরিণতি- তা গরীব, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবী সব শ্রেণির জন্যেই। এখানে নারীর বিয়ে অত্যন্ত দরকার, কারণ সমাজ অবিবাহিত নারীর যৌনতার অধিকার দেয় না। মাতৃত্ব তো নয়ই। কিন্তু শুধুমাত্র বিয়ের মাধ্যমেই নারী পায় যৌনতার অধিকার এবং মাতৃত্বই থাকে তাদের লক্ষ্য- যা এদেশের নারীদের পিছনে টেনে রাখছে।
পুরুষের কিন্তু পিতৃত্বের জন্যে চাপ নেই। পুরুষের বিয়ে নিয়েও পিতৃতন্ত্রের মাথা ব্যথা নেই। সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা আছে কি নেই, সেই চিন্তাও নেই। কোনো নারীর জরায়ুতে কোনো পুরুষ বীজ বুনে দিয়ে এলো, সে পুরুষ বিবাহিত না অবিবাহিত- সেসব নিয়ে পিতৃতন্ত্র মাথা ঘামায় না। সমস্ত দায় নারীর। নারীকে বিয়ে করতেই হবে, সন্তান জন্ম দিতেই হবে। নারী কী চায় বা না চায়, তার মূল্য নেই।
পিতৃতন্ত্র নারীকে দুটি ভূমিকা দিয়েছে: গৃহিনী এবং জননী। এই দুই ভূমিকা নিখুঁত ভাবে পালন করতে পারলেই সার্থক নারীজন্ম। পরিবার, সমাজ, ধর্ম নারীর এই দুই ভূমিকার জয়গান গায়, কারণ এ ব্যাপার দুটি নারীর স্বাধীনতার পরিপন্থী। এগুলো পেরোতে না পারলে নারী বন্দী হয়ে থাকবে পুরুষতন্ত্রের খাঁচায়। গৃহিনী ও মায়ের ভূমিকা নারীকে সভ্যতা থেকে অনেকখানি বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।
পুরুষতন্ত্র মায়ের জয়গান গায়। মা হবেন এমন- যিনি সবকিছু নীরবে সহ্য করবেন, তার অপার দুঃখ থাকবে, দারুণ যন্ত্রণা ভোগ করবেন, স্বামী-সন্তানের জন্য সমস্ত জীবন বিলিয়ে দিবেন। তার নিজের কোনো সুখ-শান্তি, চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকবে না। মোট কথা চিরদুঃখী, জনমদুঃখী মা। পিতৃতন্ত্র এই দুঃখের মূর্তিমতি মায়ের মহিমাকীর্তন করে। কিন্তু নারীকেই কেনো দুঃখের জীবন বেছে নিতে হবে? পিতৃতন্ত্রের বলী হতে হবে কেনো নারীকে? কেনো সভ্যতার বাইরে গিয়ে দুঃখে-কষ্টে বসবাস করতে হবে নারীকে?
পুরুষতন্ত্র নারীকে সেই শিশুবেলা থেকে শিখিয়েছে বিয়ে এবং সন্তান ছাড়া তার আর কিছু নেই, মাতৃত্বেই নারী জীবনের স্বার্থকতা, মাতৃত্বেই নারী মহান। ‘নারীরা মায়ের জাত’ ‘মাতৃত্বেই নারীর স্বার্থকতা’ এই কথাগুলো মূলত পুরুষতন্ত্রের রাজনীতির একটি অংশ।
নারী জীবন স্বার্থক করে যে মহান মা জন্ম দেন সন্তান, সেই মা তার নয় মাস গর্ভে ধারণ করা সন্তানের অভিভাবকত্বের অধিকার কতোটুকু পান? কিংবা আদৌ পান কি? মাতৃত্বেই যদি নারীর জীবন স্বার্থক হয়, পূর্ণতা পায়, মহিমান্বিত হয়, তবে মায়ের একার পরিচয়ে কেনো সন্তানের পরিচয় তৈরি হয় না?
ধর্ম বলে নারীর শরীর অশুচি, রক্তক্ষরণ অপবিত্র। নৈতিক ও শারীরিক পতনের উৎস, নরকের দরজা নারী। অন্যদিকে মা হিসেবে নারী কতো মহান, কতো পবিত্র! সেই একই নারীর শরীর বেয়ে জন্মানো পুত্রসন্তানের কতো জন্যে কতো আকাঙ্ক্ষা! সে সন্তান জন্মদানেই নারীর একমাত্র সার্থকতা!
নারীর একমাত্র মূল্য তাদের প্রজননের ভুমিকায়। কিন্তু সেখানে তাদের ক্ষেত্র হিসাবে দেখা হয়, ফসল হলো বপনকারীর নিজের। দীর্ঘ শতাব্দী ধরে সমাজ ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবে নারীর পায়ের তলা থেকে তার আত্মসম্মানের শেষ অবলম্বনটুকু সরিয়ে নিয়েছে, তাকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করেছে এবং গৃহে তাকে বন্দি করেছে মাতৃত্বের দোহাই দিয়ে।
মা সন্তানের জন্ম দিলেও সন্তানের পারিবারিক ইতিহাস লেখা হয় পিতার পরিবার দিয়েই। কেননা, মানুষের বংশগতির ইতিহাস পিতার রক্তেই প্রবাহিত হয়, মা কেবল গর্ভে ধারণ করেন মাত্র।
ইতিহাসে তার স্থান নেই। যে কারণে আমরা ‘পূর্বপুরুষ’ শব্দের সঙ্গে পরিচিত, কিন্তু ‘পূর্বনারী’ বলে কিছু হয় না। নৃবিজ্ঞানে ‘পূর্বনারী’র ধারণা পাওয়া যায়। আদিম মানুষের ইতিহাস জানতে বৈজ্ঞানিকভাবে মানুষের আদিমাতার খোঁজ পাবার কথা শুনেছি। কিন্তু তাতে মানুষের সামাজিক ইতিহাসে তেমন কোনো হেরফের হয় না। মজার ব্যাপার হলো− যেহেতু ‘পূর্বপুরুষ’ সদা পুরুষবাচক, ‘পূর্বপুরুষ’-এর মতো ‘উত্তরাধিকার’ শব্দেরও স্ত্রীবাচক হয় না। উত্তরাধিকার সবসময়ই পুরুষ। এমনকি নারীর ক্ষেত্রেও।
ফ্রয়েড ভেবেছেন যে, নারীর জীবনের সবচেয়ে বড়ো অপ্রাপ্তি হচ্ছে একটি শিশ্নের অভাব এবং সেই অভাব পূরণ হয় কেবল পুত্রসন্তান জন্মদানের মধ্য দিয়ে। মা হওয়াই যথেষ্ট নয়, বরং পুত্রসন্তানের মা হলেই কেবল নারীর জীবনে পূর্ণতা আসতে পারে। নারীর উত্তরাধিকারও হতে পারে কেবল পুরুষই।
কন্যাসন্তান ও পুত্রসন্তান গর্ভে ধারণ করতে একই কষ্ট পেতে হয়। তবু এই সমাজে পুত্রসন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়। নারীর মাতৃত্বের মহিমা সমাজে পুরুষের দেওয়া বৈধতার ওপর নির্ভরশীল। পুরুষাধিপত্যবাদী সবরকম ধারণা যুগে যুগে ধর্মের নামে চাপিয়ে দেওয়া হয়। ফ্রয়েডের আবির্ভাবের পর তা করা হয় বিজ্ঞানের নামে।
নারীর জন্য শোচনীয় ট্রাজেডি হচ্ছে ইতিহাসব্যাপী তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে আকাঙ্ক্ষা ও উচ্চাভিলাষের অধিকার থেকে; নারী আটকা পড়েছে প্রধানত তার প্রজনন ভূমিকায়। তবে সেটি বিবাহিত প্রজনন।
উনিশ শতকের দিকে কোনো অবিবাহিত মেয়ে প্রেম করলে বা নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করলে সে হতো কূলটা, কূলত্যাগিনী। কোনো বিধবা প্রণয়ে জড়ালে সেও কূলত্যাগিনী, বেবুশ্যে। যে পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহকেরা বিধবার সম্পত্তি আর শরীরের জন্যে লালায়িত ছিলো, তারাই বিধবার প্রেমকে স্বীকার করতো না। বর্তমান সমাজ সেই সময়ের চেয়ে খুব অগ্রসর হয়েছে, এমনটি বলা যায় না। এখনো বাড়ির মেয়েটির প্রেমকে ভালো চোখে দেখা হয় না। তার যৌনতার প্রশ্নে পরিবার আঁৎককে উঠে, সমাজ চোখ রাঙায়। আর অবিবাহিত মেয়ে মা হতে চাইলে তো পরিবার শুদ্ধ আগুনে ঝাঁপ দেবে! তার চেয়ে বেশি সম্ভাবনা মেয়েটিকে খুন করে ফেলা হবে।
নারীর যৌনতাকে কেবল মাত্র বিয়েতেই সম্মতি দেওয়া হয়। কিন্তু বিয়েতে নারীর যৌনতা পূর্ণতা পায় না, সে হয় যৌনতার উপকরণ। বিয়ে ছাড়া নারীর যৌনতাকে কিছুতেই স্বীকার করে না সমাজ। এই সমাজ অবিবাহিত নারী এবং শিশুকে ধর্ষণ করা মেনে নিতে পারে, কিন্তু অবিবাহিত নারীর যৌনতা? তা মোটেও নয়। আর একজন অবিবাহিত নারীর মা হতে চাওয়া তো চিন্তারও বাইরে!
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ‘একক মাতৃত্ব’ নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে দীর্ঘদিন কাজ করছেন বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসক শিউলি মুখোপাধ্যায়। বিভিন্ন নারীকে তিনি মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণের সুযোগও করে দিয়েছেন। কিছুদিন আগে তিনিও মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করলেন। তার হাসপাতালের স্পার্ম ব্যাঙ্ক থেকে শুক্রাণু নিয়ে প্রবেশ করানো হয় শিউলির শরীরে। অবিবাহিত হয়েও এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন তিনি। কিন্তু কেনো তিনি তার পুরুষসঙ্গী দ্বারা সন্তানের জন্ম দিতে পারলেন না? অবিবাহিত বলে নয় কি? একজন চিকিৎসক হয়েও, স্বাধীন, রোজগেরে হয়েও তিনি সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করতে পারলেন না!
পুরুষতন্ত্রের অভ্যাস মাতৃত্বের জয়গান করা। কিন্তু এই পুরুষতন্ত্র শুধুমাত্র বিবাহিত মাতৃত্বে বিশ্বাস করে, অন্যথা নয়। অবিবাহিত নারীর মাতৃত্ব স্বীকার করে না পুরুষতন্ত্র। বিয়ে ছাড়া নারীর মাতৃত্ব লজ্জার, অপমানের, কলঙ্কের। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাছে এটি স্বীকৃত নয়। আবার বিবাহিত নারীর সন্তান না হলে কিংবা সন্তান না চাইলে তাকেও সমাজ হেয় করে। তাকে বলা হয় 'সন্তান ছাড়া নারী জীবনের কোনো মূল্যই নেই, মাতৃত্বেই নারীর পূর্ণতা' ইত্যাদি। পরিবার চায় যে কোনো উপায়ে বিবাহিত নারীর সন্তান হতে হবে। তার জন্যে ডাক্তার, বদ্যি, কবিরাজ, ঝাড়ফুঁক কোনো কিছুরই অন্ত হয় না। যে করেই হোক জন্ম দিতে হবেই সন্তান। তাও আবার পুত্রসন্তান। না হলে নারী জীবন অসম্পূর্ণ। নারীটি সন্তান চায় কী না সেটি জানতে চায় না কেউ। সন্তানহীন বিবাহিত নারীকে বাঁজা মেয়েমানুষ বলে গালি দেওয়া হয়। সন্তান ছাড়া বিবাহিত নারী অসম্পূর্ণ।
অপর দিকে কোনো অবিবাহিত মেয়ে, যার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আছে, যিনি কাউকে লালন-পালনে সক্ষম; তিনি মা হতে চাইলেও মাতৃত্বের জয়গান গাওয়া এই সমাজই তা হতে দেয় না। বাধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবার ও সমাজ। কিন্তু মাতৃত্ব বিবাহিত নারীর গৌরব হলে অবিবাহিত নারী কলঙ্ক হবে কেনো?