ফারজানা কাজী

সমাজ কর্মী

জলের উপর পানি না পানির উপর জল

পথেঘাটে চলাচলে বা যানবাহনে যাতায়াতে আমরা যে অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুনি রোজ তাতে কেউ কখনও চমকে উঠি না। কিন্তু 'পানি'কে জল বললে বাঙালি মুসলমান মাত্রই আঁৎকে উঠি। যেমন রাস্তার পাশে বাঙালি পুরুষের বাথরুম সারা দেখেও আমাদের কোনো বিকার নেই। কিন্তু কোনো ছেলেমেয়ে হাত ধরে হাঁটলে অনুভূতিতে লেগে যায়। ধর্ষণের খবরে বা ধর্ষণ দেখলেও কিছু বলি না। কিন্তু কোনো ছেলেমেয়েকে প্রকাশ্যে চুমু খেতে দেখলে ধর্ম বা সংস্কৃতি দু'টোই উচ্ছন্নে যায়। যাই হোক, বলছিলাম 'জল' ও 'পানি' নিয়ে। বাংলাদেশী মুসলমানদের ধারণা জল হিন্দুর ভাষা, আর পানি মুসলমানের। উর্দুতে জলকে পানি বলে তাই ‘পানি’ পবিত্র শব্দ। মুসলমান কখনও পানিকে জল বলতে পারবেন না। পরিস্থিতি এখন এমন অনেকেই প্রকাশ‍্যে “জল” শব্দটি ব‍্যবহার করতে লজ্জা পায়। কিন্তু অধিকাংশই জানেন না জল শব্দটি শুধুমাত্র বাঙালি হিন্দুরা ব্যবহার করেন, অন্যরা নয়।

জল ও পানি দুটো শব্দই সংস্কৃত থেকে এসেছে। কিন্তু ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার রচিত গবেষণা গ্রন্থ “বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত” তে উল্লেখ করেন যে সংস্কৃত ভাষার চেয়ে পালি ভাষা প্রাচীন এবং পালি ভাষার অনেক শব্দ সংস্কৃত ভাষায় ঠাঁই পেয়েছে। পালি ভাষায় আমরা ‘পানীয়’ শব্দের অস্তিত্ব পাই। একই সাথে সংস্কৃত ভাষায় ‘জলম’ আর ‘পানীয়’ দুটি শব্দেরই অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তাই এখান থেকে প্রমাণিত যে পানীয় পালি ভাষার শব্দ এবং জলম সংস্কৃত ভাষার শব্দ।

উত্তর ভারতে জলকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। জল আর পানি এই দুটি শব্দই ভারতে সর্বাধিক প্রচলিত। এছাড়াও দক্ষিণ ভারতে ‘নীর’ শব্দটি জল হিসেবে বহুল প্রচলিত। হিন্দী ভাষায় ‘জল’ ও ‘পানি’ এই দুটি শব্দই ব্যবহৃত হয়। তবে ‘পানি’ হিন্দী ভাষাতে বেশি ব্যবহৃত। পানি বলতে হিন্দী ভাষায় সাধারণ পানিকেই বোঝানো হয়।

কিন্তু বাংলা ভাষায় এই দুটি শব্দ এসে একটু বদলে গেলো। পশ্চিম বাঙালীরা পবিত্র হোক বা সাধারণ কারণে হোক তারা সেটাকে জলই বলছেন। আর পূর্ব বাঙালীরা সেটাকেই আবার পানি বলতে শুরু করলেন। পূর্ব বাংলার মুসলিমরা জলকে পানি বলেন। অনেকেই দাবি করেন যে মুসলিমদের শাসনে এসে বাংলার মুসলিমদের মধ্যে পানি শব্দের প্রচলন হয়। কিন্তু সেসময় ভারতের হিন্দু হিন্দীভাষীরাও জলকে পানি বলতেন (এখনও বলেন)। প্রাচীন ভারতে বাংলাতেও ‘পানি’র প্রচলন ছিলো।। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদে শব্দটি পাই আমরা।

হিন্দী এবং উর্দু দুই ভাষাতেই জলকে পানি বলে। উর্দু ভাষা আর হিন্দী ভাষার মধ্যে পার্থক্য কি? পার্থক্য হচ্ছে লেখার পদ্ধতি আর শব্দসমূহ। হিন্দী ভাষা সংস্কৃত প্রভাবিত আর অন্যদিকে উর্দু ফারসি আর আরবী প্রভাবিত। উর্দু জন্ম নেয়ার বহু আগেই হিন্দীতে পানি ব্যবহৃত হতো। উর্দু ভাষা কিভাবে তৈরি হলো সেটা আগে স্পষ্ট করা দরকার। মুঘল আমলে দিল্লীতে অনেক বিদেশী সেনা থাকতেন যাদের মাতৃভাষা ফারসি। তারা স্থানীয়দের সাথে যোগাযোগ করার জন্য ফারসি, আরবী আর হিন্দী মিশ্রিত এক জগাখিচুড়ী ভাষায় কথা বলতেন। পরে সরকারি প্রয়োজনে এই ভাষাটি পুরো ভারতে ছড়িয়ে যায় ও বহু মানুষ এই ভাষা শিখে নেন। পরে হিন্দী ভাষাটিই আরবী অক্ষর দিয়ে লেখার প্রচলন হয় এবং এটিই উর্দু নামে প্রকাশ পায়। উর্দু হচ্ছে তুর্কি শব্দ যার অর্থ সৈন্য। তারা পানি শব্দটি হিন্দী থেকেই ধার করেন।

জল বা পানি (অন্যান্য নাম: বারি, সলিল) হলো একটি অজৈব, স্বচ্ছ, স্বাদহীন, গন্ধহীন এবং প্রায় বর্ণহীন এক রাসায়নিক পদার্থ, যা পৃথিবীর বারি জল বা মণ্ডলের (hydrosphere) ও যে কোনো জীব-কোষ বা উদ্ভিদ-কোষের একটি প্রধান উপাদান। যদিও পানি কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদকে কোনো রকমের শক্তির বা জৈব পরিপোষকের যোগান দেয় না, তবু এখনও পর্যন্ত আমরা যা জানি, তাতে সমস্ত ধরনের প্রাণের বেঁচে থাকার জন্য জল অপরিহার্য। এই জন্য মহাকাশ বিজ্ঞানীরা বহির্বিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব খোঁজার আগে প্রথমে সেখানে জলের অস্তিত্ব খোঁজেন। কারণ, এখনও মোটামুটিভাবে মনে করা হয় যে, জল যদি না থাকে, তাহলে সেখানে প্রাণ থাকতে পারে না।

জল বা পানির রাসায়নিক সংকেত হল H2O। অর্থাৎ জল বা পানির একেকটি অণু একটি অক্সিজেন পরমাণু এবং দু'টি হাইড্রোজেন পরমাণুর সমযোজী বন্ধনে গঠিত। এই H2O যৌগটির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো - অপেক্ষাকৃত অল্প তাপমাত্রার পরিসরের মধ্যে এর তিনটি বিভিন্ন অবস্থা— কঠিন, তরল ও বায়বীয় পরিলক্ষিত হয়।

কেবল ভাষায় নয়, হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির এই টানাপোড়নে আমরা বঞ্চিত হয়েছি ঔষধি গাছ তুলসী থেকে। সর্দ্দি, কাশি, ঠাণ্ডা লাগার প্রতিষেধক হিসেবে, ওষুধ হিসাবে এই গাছের রস, পাতা এবং বীজ ব্যবহার করা হয়। তারপরেও কোনো মুসলমান বাড়ির আঙিনায় কোনদিন একটি তুলসী গাছ লাগাতে পারেন না। শ্রদ্ধাঞ্জলি তৈরিতে আর সব ফুল থাকলেও রক্তজবার ব্যবহার নিষিদ্ধ কারণ কালীপূজায় রক্তজবা ব্যবহার করা হয়। এখানেই শেষ নয়- সংস্কৃতির এই টানাপোড়নে বাঙালি তার জাতীয় পোশাকের মধ্যে পাঞ্জাবি ধরে রাখতে পারলেও ধূতি খুলে লুঙ্গি পরতে বাধ্য হয়েছেন। হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির টানাপোড়নে আমরা পহেলা বৈশাখ পালনে স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করতে পারি না।

ধর্ম ও সংস্কৃতি যখন পরস্পরকে লালন করে তখন তাকে আমরা ধর্মীয় সংস্কৃতি বলি। কোনো বিশেষ ধর্ম পালনে যে সকল সংস্কৃতি জড়িত তা ঐ ধর্মের ধারক-বাহক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, তবে সে সকল সংস্কৃতি পালন করলেই ঐ ধর্ম পালন হয়ে যায় না। টুপি পরা ইসলামী সংস্কৃতি, অন্য ধর্মের কেউ টুপি মাথায় দিলেই সে মুসলমান হয়ে গেছে এমন ভাবার কোনো যৌক্তিকতা নেই; তেমনিভাবে ‘নমস্কার’ শব্দের অর্থ ‘অভিবাদন’, কোন মুসলমান ‘নমস্কার’ বললে সে হিন্দু হয়ে যাবে এ তত্ত্ব গ্রহণযোগ্য নয়। ভাষা সংস্কৃতি প্রকাশের বাহন, ধর্মের পরিচায়ক নয়। ভাষার ধর্মান্তকরণ আমাদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রকট করেছে যা আজ নগ্নভাবে প্রকাশ হয়ে পড়েছে।

কারো যদি জল বলতে বা শুনতে অসুবিধা হয়, তবে পানিতেও অসুবিধা হওয়ার কথা। আপনারা এখন থেকে ‘ময়া’ বলুন। ময়া জলের আরবী প্রতিশব্দ।

1726 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।