ফারজানা কাজী

সমাজ কর্মী

আমি কেন হিন্দুপ্রেমী?

কাল রাতে হঠাৎ এক বড় ভাই ইনবক্স করে বললেন- ‘তুমি কি হিন্দুপ্রেমী?’ মেসেজটি পেয়ে একটু চমকালাম। আমি আবার কবে হিন্দুপ্রেমী হলাম! কখনো তো ধর্ম দিয়ে মানুষ যচাই করি নাই। হিন্দু বা মুসলমান কোনো মানুষেরই পরিচয় হতে পারে না। মানুষ বিচারের মাপকাঠি ধর্ম নয় কখনোই। আমি মানুষের মানবিক দিকটিই দেখি, ধর্ম তো নয়!খুব ছোটো বেলায় আমরা যেখানে থাকতাম, ঠিক তার পাশেই অনেকগুলো হিন্দু পরিবারের বসবাস ছিলো। তখনো আমি বুঝে উঠতে পারিনি হিন্দু-মুসলমান কি। আমি ওখানেই ওই পরিবারগুলোর কাছেই বড় হয়েছি। আমার মা চাকুরি করতেন, তাই আমাকে পাশের বাড়ি রেখে নিশ্চিন্তে অফিস করতেন। ওখানে অনেকগুলো মেয়ে ছিলো, ভীষণ আদর করতো আমায়। একটি মেয়ের নাম ছিলো হুবলি, ডাক নাম বুলু। আমাকে কোলে কোলে রাখতো সবসময়। তার বড় বোন প্রাথমিক শিক্ষক, কানন দিদি। উনার কাছেই আমার হাতেখড়ি হয়েছিলো। আদর করে পড়াতেন। একটু বড় হবার পরে আর একজন শিক্ষকের কাছে পড়তাম, তিনি অঞ্জলী দি। খুব মজা করে পড়াতেন, কতো গল্প যে হতো! বন্ধুর মতো আমাদের পরিবারে মিশে গিয়েছিলন। এখনো আমার মায়ের সাথে কোথাও দেখা হলে জানতে চান আমি কেমন আছি!

দুর্গাপুজোতে আমার দিন কাটতো উন্মাদনায়। রোজ নতুন কাপড় পড়ে ঠাকুর দেখা চাইই চাই। আমি দু্র্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতীকে দেখে মুগ্ধ হতাম। কী ভীষণ ভালোলাগা ছিলো সেটি বলে বোঝানো সম্ভব না। এখনো ঠাকুর দেখা আমার ভালোলাগার বিষয়।

তারপরে একটা সময় আমরা ওই এলাকা ছেড়ে নিজেদের বাড়ি চলে এলাম। তখনো দেখেছি আমাদের বাড়ি নাড়ু-মোয়া নিয়ে বেড়াতে এসেছে দিদিরা। যোগাযোগটা অনেকদিন ছিলো। পরে শুনেছি সেই হুবলিদিরা বাড়ি বেঁচে দিয়েছে। দিতে বাধ্য হয়েছে। তাদের পরিবারের অনেকেই ইন্ডিয়া চলে গেছে।

আমি হাই স্কুলে যাওয়ার পর থেকেই আমার প্রাণের বন্ধু ছিলো বাসন্তী আর সরস্বতী। সর্বক্ষণ ওদের সাথে থাকতাম আমি। সবখানে একসাথে যেতাম। স্কুলের সরস্বতী পুজো, আহা! কী মিষ্টি ছিলো দিনগুলো!

তখন থেকে একটি প্রশ্নের সম্মুখীন প্রায়ই হতাম, তা হলো- ‘তুমি হিন্দু না মুসলমান?’ আমার আজব লাগতো এই প্রশ্নে। তখন আমি রীতিমতো হুজরাইন রেখে কোরআন পড়ি, নামাজ পড়ি। তবু এই প্রশ্নে আমি ঘাবড়াই। বাবাকে এসে বললাম একদিন, বাবা বললেন ‘ফের কেউ এই কথা জিজ্ঞেস করলে তুমি বলবা আমি মানুষ, মানবিকতা ধর্ম আমার’। আমি বাবার কথায় সুখী, আমার নিজেরও প্রশ্ন ছিলো- আমি কি? আমার উত্তর পেয়েছিলাম আমি এবং সবাইকে দেওয়ার মতো উত্তরও পেয়ে গেছিলাম। সেটি এখন শুধু বলিই না, মানিও।

তো কলেজে ওঠার পর আমি বাসন্তীকে হারায়ে ফেলি। সরস্বতীর বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো আগেই। আমি কি কারণে যেন ঢাকা এসেছিলাম। বাড়ি ফিরে গিয়ে শুনি ওরা ভারত চলে গেছে। আমাকে প্রায়ই বলতো চলে যাবে, চলেই গেলো। আজও বাসন্তীকে মিস করি আমি, স্বপ্নে দেখি। সেই সময়ে অভিমান হয়েছিলো খুব। আজ বুঝি, বাসন্তীরা চলে যায় না, যেতে বাধ্য হয়!

তারপরে বহু বহু বন্ধুকেই চলে যেতে দেখেছি। তবুও এখনো কারো চলে যাওয়া সহ্য হয় না, কেমন হৃদয় টাটায়। আমার মাকেও অনেকবার দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখেছি তাঁর বান্ধবীদের চলে যাওয়া মনে করে।

এই যে প্রাণের টান, এখানে তো ধর্ম আসে নি! এসেছে হৃদয়। এটি আত্মীক সম্পর্ক। এখানে ধর্ম টেনে আনার মতো অশ্লীল আর কী হতে পারে?

এই মানুষগুলো কেনো চলে যায়? কেনো যেতে বাধ্য করা হয়। উদ্দেশ্য একটাই। হিন্দুর ঘরবাড়ি, জায়গা-জমি দখল। হিন্দু খারাপ, কিন্তু হিন্দুর সম্পত্তি ভালো। বেশির ভাগ মুসলমান ফ্যামিলিতে হিন্দু বিদ্বেষ প্রকট। এরা জন্ম থেকেই বিদ্বেষ নিয়ে আসে। এদের শেখানো হয় হিন্দু কাফের, মালাউন। ঘৃণার বস্তু। তাই হিন্দু খেদাও, হিন্দু বাড়িঘর দখল করো। হিন্দু মেয়ে গণিমাতের মাল, ধর্ষণ করো। জোর করে ধর্মান্তরিত করো।

আমি ইসলামের সমালোচনা করি, তাই আমি হিন্দুপ্রেমী। আমি তো হিন্দু ধর্মেরও সমালোচনা করেছি। পৃথিবীতে কোনো ধর্মেরই প্রেমী আমি নই। কোনো ধর্মই নারীকে মানুষ হিসেবে দেখে নি, তাই ধর্মের প্রতি ঘৃণাই আসে আমার, প্রেম নয়।

মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক ধর্ম দিয়ে কি হয়? ধর্ম দিয়ে কি মানুষ চেনা যায়? হৃদয়ের ধর্ম থাকে কি কোনো? আমি একটি ধর্মই মানি, সেটি মানবতা। কেনো মানুষের মাঝে ধর্ম আসবে? মানুষে মানুষে ধর্ম হওয়া উচিৎ ভালোবাসাবাসি। আর কিছু নয়।

4524 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।