আমার জীবনটাকে অনেকে রূপকথার গল্প মনে করে। আশেপাশের অনেকেই ভাবে আমি স্বপ্ন থেকে উঠেই গোছানো জীবনের চাবিটা হাতে পেয়েছি। ছোট থাকতে গায়ের রংয়ের জন্য অনেক কথা শুনেছি। আমার নিজের পরিবারের লোকেরাই আমাকে আমার গায়ের রং এর জন্য তাচ্ছিল্য করতো। এজন্য নিজেকে সবসময়ই কালো এবং কুৎসিত মনে হতো। সবসময় তুলনামূলক কথাবার্তা চলতো। সে সময়ই আমাকে মনে করানো হতো আমাকে বিয়ে দিতে গেলে বাপের অনেক টাকা খরচ হবে বা আমাকে কখনো দেখতে আসলে যেনো আমার বোনকে সামনে না আসতে দেওয়া হয় তাহলে আমার বদলে ওকেই পছন্দ করবে! আমি নিজেকে ওই সময় লুকিয়ে রাখতাম।
কেউ জানতো না আমি ওই বয়সে কত কি চিন্তা করতে পারতাম। বিপরীত লিঙ্গের কেউ আমার কাছে আকর্ষণের ছিলো না। এসএসসি পার হয়েই বিয়ে। হ্যাঁ যদি বলা হয় তবে আমারও সংসার নিয়ে সুখ সুখ ধারণাই ছিলো। ১৬ বছরের শরীরটা যখন ডাস্টবিনে পরিনত হলো তখন আমার পুরুষ এবং সংসার নিয়ে সব ধারনা নর্দমায় পড়লো।
পড়াশোনা হতো না যদি না নিজে একটা চাকরী আর কয়েকটা টিউশনি জোগাড় করতাম। আমার শরীরে কুলাতো না। রাস্তায় মনে হতো বসে পড়ি। সংসারের সমস্ত কাজ, সকালে স্কুল তারপর একটানা চারটা টিউশনি, বাসায় কোচিং, আবার কাজ। আমার জীবনটা এমনই একঘেয়ে ছিলো।
কোনো বন্ধু ছিলো না। কেউ ছিলো না যাকে বলতে পারতাম নিজের কথা। মস্তিষ্কটা একভাবে সেট হয়ে গিয়েছিলো। আমি জানতাম না জীবন কী, এর কোনো রং আছে কিনা। মাঝে মাঝে গোসল করতে গেলে তার আগের রাতের বিকৃতমনা পুরুষের কিছু ছাপ শরীরে পেতাম। খুব কাঁদতাম। এক সময় আর কান্নাও আসতো না। গলার কাছে দলা পাকিয়ে বমি আসতো খালি। চরম নির্দিধায় ওড়নায় গালের দাগ ঢেকে স্কুলে চলে যেতাম। কোনো দাওয়াত, কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে আমি যেতাম না। যন্ত্র মানব হয়ে গিয়েছিলাম।
একসময়
আমার শরীর ক্রমাগত খারাপ হলো। ডাক্তার বললো থাইরয়েড অনেক বেশি। সে সময় লোকটা বলেছিলো বাচ্চাকে বাঁচান। আমার কিছু মনে হয় নি। ডেলিভারির একদিন আগেও স্কুল, টিউশনি সব করেছি। দুই ডিসেম্বর ইবু হলো। আমার প্রেশার অনেক বেশি ছিলো। নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। ইবুকে সামনে নার্স নিয়ে আসলে বললাম প্লিজ সরান। এসিটা বাড়ান।
ধীরে ধীরে ইবু আমার সবটা হয়ে উঠলো। ও ঘুমিয়ে পড়লে আমি অনেক গল্প করতাম ওর সাথে। মনে হতো ও আমার একমাত্র বন্ধু। ওর ৪৫ দিন বয়স থেকেই আবার স্কুল শুরু করলাম। মনটা ছটফট করতো ওর কাছে যাবার জন্য ওর ঘ্রান পাবার জন্য। কি মিষ্টি ও।
সবাই বলতো মা তো কালো ও তার বাবার মতো হয়েছে। আমি মনে মনে বলতাম ইশ বললেই হলো। ও শুধু আমার, আমার মতন ও বা আমি ওর মতন। ইবু উপুড় হলো, বসলো, হাটতেও
এক রাতে এক জোড়া নোংরা পুরাতন হাত আমার শরীর স্পর্শ করতে চাইলে আমি না বলেছিলাম। সেদিন অনেক মারও খেয়েছিলাম। ইবুর জন্য চুপ ছিলাম ওর ঘুমটা ভেঙ্গে যায় যদি। তবে পরেরদিন ঠিকই জবাব দিয়েছিলাম প্রথমবারের মতন। আমার মাকে ডেকে আনা হয়েছিলো। আমার কত সাহস দশ বছর পর মুখ খুলেছি! আমার মায়ের সাথে আমাকে বের করে দেওয়া হলো, ইবুকে আটকে রাখা হলো।
ওইদিন প্রথম বারের মতন থানায় গেলাম। ইবুকে নিয়ে আাসা হলো। কিন্তু আমি জানতাম না এই মুক্তি এত যন্ত্রণার ছিলো। আমার মাকে নানান কথা শুনতে হতো। মেয়েকে কি বসিয়ে রাখবে, ওকে কে বিয়ে করবে বাচ্চাসহ। আমি সে সময় ঘুমাতাম না। মনে হতো আমার ছেলেকে নিয়ে মাঝ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। তখন আব্বুর আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিলো।
ডিভোর্স হয়ে গেলো। বসে থাকলাম না, তাদের কথা চললোই। শুরু করলাম অর্গানাইজেশন। লে
একসময় চাকরী, টাকা সব হলো। কিন্তু আমি হাঁপিয়ে উঠলাম। এখন আর কেউ কথা শোনায় না। ইবুকে আঁকড়ে বাঁচার জন্যই ওর সাথে থাকলাম। অনেক হুমকি আসতো ছেলের জন্য। লড়াইটা চলতেই থাকলো। এখনো চলছে।
তবুও কিছু মানুষের চোখে আমি নেহাৎ ডিভোর্সী, আমার জীবনটা রূপকথার মতো গোছানো। আমার জীবনটা গুছিয়েছি আমি। কাউকে ছাড়াই আমি স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলাম। আমার জীবনে কেউ কোনো বাড়তি পালক যোগ করে নি। হ্যাঁ পাশে থেকেছে তবে যুদ্ধটা আমার ছিলো একদম আমার নিজের। অথচ মানুষ কী নির্দ্ধিধায় আমাকে বিচার করে, আমার চরিত্র কে বিচার করে!