মাত্র তেরো বছর বয়সে দেশ ছেড়ে বিদেশ গিয়েছিলেন আজর নাফিসি। সেই যাওয়াটা ছিলো পড়াশোনা করার উদ্দেশ্যে। প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা কেমন, সেটা তাঁর চেয়ে বেশি কারো বোঝার কথা না। ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড এবং আমেরিকায় পড়াশোনা করেন তিনি। আমেরিকা থেকে পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরে এসেছিলেন। দেশে ফিরে আসার পরে দেশের স্বাদ তিনি পান নি। আরেক প্রবাস জীবন তাঁর শুরু হয় নিজের দেশেই।
যে ইরানের স্মৃতিকে তিনি তেরো বছর বয়সে দু'চোখের তারায় ভরে নিয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন, ফিরে এসে দেখেন সেই সব স্মৃতিকে সমূলে পালটে দিচ্ছে বিপ্লবী গার্ডেরা। যে সব রাস্তা তিনি চিনতেন, সেগুলো পালটে দিয়েছে তারা নামসহ। যে মুভি থিয়েটারে তিনি সিনেমা দেখতে যেতেন, সেগুলোকে পুড়িয়ে ভস্ম করে দিয়েছে ইসলামি জোশে। যে সমস্ত অনুভূতিগুলোকে তিনি তাঁর নিজস্ব সত্ত্বা হিসাবে বিবেচনা করতেন, তার সবই এখন পড়ে গিয়েছে চ্যালেঞ্জের মুখে। যা কিছু পরিচিত ছিলো অন্তরাত্মার সাথে, তার সবকিছুকেই ছিনিয়ে নিয়েছে তারা। নিজ দেশে এখন পরবাসী তিনি, অচেনা এক দেশে অচেনা মানুষদের মাঝে বসবাস।
আজর দেশে ফিরে এসেছিলেন ১৯৭৯ সালে। এই বছরই তাঁর দেশে ইসলামি বিপ্লব সংগঠিত হয়। যে সেক্যুলার ইরান ছেড়ে তিনি বিদেশে গিয়েছিলেন, এক বিপ্লবের মাধ্যমে সেই সেক্যুলার ইরানের মৃত্যু ঘটে যায়। আর সেই মৃত্যু ঘটে তাঁর নিজের চোখের সামনেই।
তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পেশায় যোগ দেন তিনি। কিন্তু, বেশিদিন এখানে শিক্ষকতা করার সুযোগ তিনি পান না। পড়ানোর সময় ক্লাসরুমে নেকাব পরতে অস্বীকৃতি জানানোতে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে বহিষ্কার করে। এর পরে লেখালেখির জীবনে চলে যান তিনি। ১৯৮৭ সালে নিজের সাথেই আপোষ করে আল্লামেহ তাবেতাই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। তবে, এখানেও আসলে তিনি টিকে থাকতে পারেন না। এক পর্যায়ে নিজেই সরে আসেন শিক্ষকতা থেকে। এটা ১৯৯৫ সাল।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকতা থেকে সরে এলেও ভিন্ন আরেক ধরনের শিক্ষকতার দিকে এগিয়ে যান তিনি। তাঁর সাতজন ছাত্রীকে তিনি নিজের বাসাতেই পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। এরা প্রতি বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর বাসায় আসতো। তিনি তাঁদেরকে ইংরেজি সাহিত্য পড়াতেন। পড়াতেন জেন অস্টিন, এফ, স্কট ফিজজেরাল্ড, হেনরি জেমসের বই। একই সাথে পড়াতেন ভ্লাদিমির নবোকভের লোলিতা। শুধু পড়ানোই নয়, এর মাধ্যমে ছাত্রীদের মনোজগতকে উন্মোচন করতেন তিনি। এই কাজটা করা হতো সন্তর্পণে। মোল্লাতান্ত্রিক ইরানে এই সমস্ত সাহিত্য নিষিদ্ধ সাহিত্য ছিলো। এগুলো পড়ানো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ছিলো, বিপদ ঘটতে পারতো যে কোনো সময়ে। শুধু তাঁর একার নয়, ঐ সাতজন ছাত্রীরও বিপদ ঘটতে পারতো এই গোপন পাঠদানের কথা ফাঁস হয়ে গেলে।
যে সাতজনকে তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন গোপন পাঠদানে অংশ নিতে, তারা এসেছিলো ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ এবং পটভূমিকা থেকে। কেউ এসেছিলো রক্ষণশীল পরিবার থেকে, কেউ এসেছিলো প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ পরিবার থেকে, কারো কারো ইসলামি শাসনের সময়ে নানা অপরাধে জেলে সময় কাটানোরও অভিজ্ঞতা ছিলো। শুরুতে তারা নিজেরাও সংকোচবোধ করতো, অস্বস্তির মধ্যে ছিলো তারা। সেই অস্বস্তির অন্যতম একটা কারণ ছিলো ওই সমাজে নিজস্ব ভাবনা প্রকাশ করার স্বাধীনতা ছিলো না মেয়েদের। ফলে, আজর নাফিসি যখন তাদেরকে মন খুলে তাদের নিজেদের কথা বলতে বলতেন, তারা অস্বস্তিতে ভুগতো। এ'রকম প্রশ্ন তাদেরকে কেউ করতে পারে, সেটা তাদের ধারণারও বাইরে ছিলো। ইসলামিক বিপ্লবের পরে তারা জানে মেয়েদের মুখ খুলতে নেই, প্রতিবাদ করতে নেই, নিজস্ব ভাবনা প্রকাশ করার স্বাধীনতা নেই। এগুলো করা মানেই নিজেদেরকে ভয়ংকর বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া।
কিন্তু, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ছাত্রীদের দ্বিধা-সংকোচ এবং অস্বস্তি কেটে যায়। মনের উপরে চেপে থাকা পাথরকে অপসারণ করে বুকের জমিনের সবুজ ঘাসকে সূর্যের আলোয় নিয়ে আসে তারা। নিজেরদের মনের ভাবনাগুলোকে অকপটে প্রকাশ করতে থাকে তারা। যে মোল্লাতন্ত্রের ভয়ে সারাক্ষণ তটস্থ থাকে তারা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না, যে কোনো ধরনের শৈল্পিক প্রকাশকেই যেখানে মনে করা হয় ইসলাম অবমাননা হিসাবে, সেখানে নাফিসির লিভিং রুমকে তারা মুক্তশালা বিবেচনা করে সমস্ত কিছুকে প্রকাশ করতে থাকে নির্ভয়ে। এখানে অন্তত হানা দিতে আসছে না কোনো মোরাল পুলিশ। যে বই তারা পড়ছে, যে বইয়ের আলোচনা চলছে, সেগুলোর সাথে নিজেদের জীবনকে মিলিয়ে বিশ্লেষণ করা শুরু করে তারা। আর এর মাধ্যমে তাদের জীবন, ইরানের মোল্লাতন্ত্র এবং সাহিত্য, সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। নাফিসি তাদের সাহিত্যের মাধ্যমে ইসলামিক স্বৈরতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা বোঝাতে থাকেন, বোঝাতে থাকেন কীভাবে এই স্বৈরতন্ত্র নারী স্বাধীনতাকে পদদলিত করে চলেছে।
এই পড়ানোর সময়েই একদিন নাফিসির এক ছাত্রী সানাজ অদৃশ্য হয়ে যায়। নিয়মিত পাঠসভায় অংশ নেওয়া সানাজ অনুপস্থিত থাকে এক সপ্তাহ। পরের সপ্তাহে অবশ্য ফিরে আসে সানাজ। ফিরে এসে বর্ণনা করে তার ভয়ংকর অভিজ্ঞতাকে।
পাঁচজন বন্ধুকে নিয়ে এক বন্ধুর প্রেমিকের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো সানাজ। ক্যাস্পিয়ান সাগরের পারে যখন তারা আনন্দময় সময় কাটাচ্ছিলো, রেভোলুশনারি গার্ডের লোকেরা সানাজকে ধরে নিয়ে যায়। আটচল্লিশ ঘণ্টা আটকে রাখে তারা তাকে। ভার্জিনিটি টেস্ট দিতে হয় তাকে। তাতেও মুক্তি মেলে না। তার পিঠে পঁচিশ ঘা বেত্রাঘাত করে তারপর মুক্তি দেওয়া হয়।
শুধু সানাজ একাই নয়, নাফিসির আরও দুই ছাত্রী নাসরিন এবং মাহতাবও ইরানের ইসলামিক শাসকদের অ-পছন্দের দলকে সমর্থন দেবার অপরাধে জেল খেটেছে।
আজর নাফিসি এই নিয়মিত সাপ্তাহিক পাঠদান চালিয়ে গিয়েছিলেন দুই বছর ধরে। ১৯৯৭ সালে তিনি স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। ২০০৩ সালে তিনি ওই সময়ের ঘটনাকে তুলে আনেন তাঁর বিখ্যাত বই 'রিডিং লোলিতা ইন তেহরান' বইতে। এই বইটা নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার লিস্টে একশো সতেরো সপ্তাহ ছিলো। ইংরেজি সাহিত্যের সুপণ্ডিত হবার কারণে এই বইয়ের ভাষা অসম্ভব সমৃদ্ধশালী এবং কাব্যিক। ধর্মীয় মৌলবাদের বিষবাষ্পে ভরপুর এক সমাজের চিত্রায়ন তিনি করেছেন সুরেলা ভাষায়।
ধর্মীয় মৌলবাদ যেখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে, সেখানে নারীর কোনো অধিকার থাকে না, থাকে না কোনো আশা কিংবা আকাঙ্ক্ষা। এই ধরনের সমাজ চেষ্টা করে নারীকে অবরুদ্ধ করে রাখতে, অদৃশ্য করে রাখতে। তার সমস্ত ক্ষমতাকে হরণ করে, পায়ে বেড়ী পরিয়ে তাকে ক্ষমতাহীন করা হয়। নাফিসি এর প্রতিবাদ হিসাবে তাঁর বইতে নারীর উপস্থিতিকে দৃশ্যমান করেছেন, নারীকে শক্তিশালী ভূমিকা দিয়েছেন। এই বই যেমন মোল্লাতান্ত্রিক সমাজে নারীর দুর্দশাকে চিত্রিত করেছে, একই সাথে এটাও বলার চেষ্টা করেছে যে যখন কেউ সাহিত্যকে পাঠ হিসাবে নেয় জটিল সমাজকে বোঝার জন্য, তখন তাদের নিজেদের কাছেই নিজেদের অজানা দিক উঠে আসে, ভিন্ন এক ধরনের চেতনা জাগ্রত হয়, যে চেতনা তাকে অন্ধকার সমাজের সাথে লড়াইয়ে শক্তি যোগায়।
‘রিডিং লোলিতা ইন তেহরান'-ও তেমনই একটা বই। পৃথিবীর সব দেশে, যেখানেই ধর্মীয় মৌলবাদ দেখা দিয়েছে কিংবা শিকড় গেড়ে বসছে, সেখানেই নারীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য বই এটা। কারণ, ধর্মীয় মৌলবাদের প্রথম পৈশাচিক আঘাতটাই গ্রহণ করতে হয় নারীদের। বাংলাদেশের মেয়েদের জন্যও এই বই পাঠ উপকার বয়ে আনবে। কারণ, আমাদের দেশটাও মৌলবাদীদের থাবার নীচে চলে যাচ্ছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে।