ফাহমিদা জামান ফ্লোরা

শিক্ষার্থী (ডিপার্টমেন্ট অফ ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) এবং নারীবাদী লেখক।

বাংলাদেশী বউয়েরা এবং আমি

যে নারী তার বাচ্চা জন্ম দেয়ার ১ দিন আগ পর্যন্ত আগামী দেড় মাসের বাজার করে, সেই সব মাছ-মাংস-সবজি ধুয়ে মুছে ফ্রিজে রাখে, রান্না করে, গেস্ট খাওয়ায়, ডেলিভারির দিন তার বর নাই পাশে, সেই সব নারীর সিংগেল মাদার হওয়া উচিৎ। এই যে বাজার করাটা কিংবা টাকা কামানোটা শুধুমাত্র স্বামীর দায়িত্ব তা আমি কইতেছি না, কিন্তু বাচ্চা পেটেওয়ালা বউদের দায়িত্ব বাজার করা না, রাইন্দা গেস্ট গিলানো না! এই বউয়েরা যখন এই স্বামীর প্রশংসায় পদ্মা-মেঘনা-যমুনা এক কইরা ফেলে তারে উপাধি দেয় '"মাই কেয়ারফুল হাজব্যান্ড", তখন আমার মনে হয় আমি নিশ্চয়ই নারী না, আমি নিশ্চয়ই বাঙালী নারী না, আমি নিশ্চয়ই হোমো সেপিয়েন্স না, আমি নিশ্চয়ই কিছুই না, আমার নিশ্চয়ই কোনো অস্তিত্ব নাই, আমি নিশ্চয়ই এককোষী অ্যামিবাও না।

আমারে প্রায়শই নিজেরে লাগে প্রচন্ড নিষ্ঠুর, রুড, মায়ামমতাহীন এক নারী, যার জীবনে নিজের ইগো, ইগো আর আত্মসম্মান ছাড়া কিছুই নাই, কিছুই নাই, কেউ নাই। আজ আমি কয়েকটা ঘটনার কথা বইলাই ফেলি-

১. ক্লাস নাইনে উইঠা আমি প্রথম প্রেম করছি আমার বাসার ইংলিশ শিক্ষকের সাথে। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মতো প্রেম, উথাল-পাথাল প্রেম। আমার বাপ-মা বুঝায়ে, শুনায়ে, বাড়ি থাইকা বাইর হয়ে যাইতে কয়ে, কিছু মানসিক স্ট্রেস দিয়াও আমারে ফিরাইতে পারে নাই এই প্রেম থেকে। তারা মোটামুটি সবই করছিলো আমারে এই প্রেম থাইকা উইথড্রো করাইতে। পারে নাই আর কী! পরবর্তীতে খুব জঘন্যভাবে স্বেচ্ছায় তারে ছাইড়া আসি কারণ শুধুমাত্র আমার মনে হইছিলো, সে আমারে সম্মান করে নাই। ভালোবাসাবাসি বহু পরের বিষয়। 


২. এসএসসি পরীক্ষার ওই সময় একটা প্রেম করছিলাম এক ক্লাসমেটের সংগে। বেচারা ব্রাইট স্টুডেন্ট, দেখতেও আকর্ষণীয়, শুনতেও। ওই সময় মাইয়ারা লাইন দিয়া তার পিছনে ঘোরে, চিঠি পর্যন্ত দেয়! ওদিকে সেই পোলার দুনিয়াজুড়ে আমি ছাড়া কেউ ছিলো না, নট ইভেন তার বাপ-মা। আমি তারে কয়েকমাসের মাথায় ছাইড়া আসলাম তার একদিনের একটা কথায় মনে হইছিলো, আমার আত্মসম্মান নাই তাহলে?


৩. বিশ্ববিদ্যালয় উইঠা এক প্রেম হইলো এক মাষ্টারের সংগে। সে পুরাটাই আগা-গোড়া সেক্সি আর সেক্সি। আমার কোনোদিন কোনো প্রেমের জন্য এতো ইফোর্ট দেওয়া লাগে নাই তার ক্ষেত্রে যা দিলাম আমি। বাপ্রে! ১১ মাস অপেক্ষা করছি আমি! যদিও একদিন কইয়া দিতে চাইছিলাম, আই ওয়ানা ফাক ইউ। আমার এক বন্ধু আমারে টাইনা নিয়ে আসছিলো। কইতে দেয় নাই।  এই ব্যক্তির মাথাও যেমন সেক্সি তার, পা দুইটাও! হঠাৎ কইরা যখন আমার ওই সময়কার প্রেমিক মইরা যায়, আমি বইসা বইসা বিড়ি খাই আর চোখ দিয়ে দুএক ফোটা জল ঝরে তখন সে আইসা কয়, ফ্লোরা, "মেবি অ্যাম ইন লাভ উইথ ইউ। ২০১৮ এর অগাস্ট থেকে আপনাকে জানি আমি। আপনি আমাকে জানেন আরো পরের থেকে। আমি এতোটাই ব্লাইন্ড হয়ে ছিলাম আমি আপনাকে প্রশ্ন করতে পারি নাই যখন আমার দায়িত্বই ছিলো আপনাকে জিজ্ঞাসা করা। ইউ জাস্ট ডিডেন্ট নোটিশ মি।" আমি কইলাম, হাউ ফুল ইউ আর! ওকে, লেটস হ্যাভ সেক্স। আড়াই মাস বনানী-নিকেতন-নারিন্দা কইরা প্রেমের ইতি টানছি। এইবারও সেইম কাহিনী। আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে৷ ছাইড়া দিছি। 


৪. ফেব্রুয়ারির লাস্ট থাইকা জুনের মাঝখান পর্যন্ত টানা এক বিদ্যাশবাসীর লগে রেগুলার ঘন্টায় ঘন্টায় ভিডিওকলে কথাবার্তা চললো আমার। প্রথমদিন সম্ভবত আমরা চারঘন্টা কথা বইলা ফেলি। পাশ থাইকা নুমা কয়দিন আমারে দেইখা কয়, "ফ্লোরা ইউ আর গান। মেয়ে হয়ে গেছিস তুই। ন্যাও ইটস ইউর টার্ম। তুমি ব্রেক হবা আর আমরা দেখবো তোমারে। তুমি রাত জাইগা ফোনে আলাপ করতেছো! তোমারে কেউ কল দিলে দুই মিনিট হইলে কও, ইটস ওকে। রাখেন।" এনিওয়ে এইবার কী হইছে? কিছু একটা হইছেই ফলে আমাদের আর কথাবার্তা হয় না। ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনা নাই আনলেস আমি হাই টাই থাকা অবস্থা ছাড়া। 

এই হইলাম আমি। এইগুলা বাদে, আমার অন্য সম্পর্ক, প্রেম বা অন্যকিছু এম্নেই ভাঙছে কিংবা ভাইঙাও খোঁড়ায়ে খোঁড়ায়ে চলে ব্রহ্মপুত্রের ন্যায়। এবং আমিও ধইরা নিছি, আমার কোনোদিন বিয়ে টিকবে না, প্রেম টিকবে না, আমার কোনো সম্পর্ক টিকবে না কারণ আমি ঠিক 'বাঙালী বউ ম্যাটরিয়াল' হয়ে উঠতে পারি নাই। পারি নাই আর কী! "পতি স্বর্গ, পতি ধর্ম, পতিহি পরমং তপঃ" এইটা মাইনা নিয়া পতির জুতার বাড়ি, ঝাড়ুর বাড়িসমেত সকল প্রকার শারীরিক, মানসিক নির্যাতন, অপমান, ইগনোরেন্স হাহাহিহি করে সহ্য করার মতো বাঙালী নারী হয়ে ওঠা খুব একটা গর্বের বিষয়ও না। আমার কথা কইলে, আমার প্রেমিকরা যতক্ষণ আমার সংগে ছিলো তারা আমারে আকাশে উঠায়ে রাখছে, পা মাটিতে ছোঁওয়াইতে দেয় নাই। যেদিন কোনো সম্পর্কে বসত করার পরও এক মুহুর্তের জন্যও আমার পা মাটিতে পড়ছে, পরমুহূর্তেই ছাইড়া আসছি তারে। 

আমি সব ছাড়তেই পারি কারণ আমি স্মৃতি, সামাজিকতা, চলতি মানসম্মান, প্রতিযোগিতা এইসব নিয়া ডিল করি না, এগুলোর সংগে বসত করি না। আমি জাস্ট ছাইড়াই আসি। ছাইড়া আসার আনন্দ যে কতো বিশাল আনন্দ সেইটা উপভোগ করতে পারি বইলাই একলা বাসায় সারাদিন ইন্ট্রাপার্সোনাল কমিউনিকেশন কইরাও ক্লান্ত হয়ে পড়ি না আমি, দিনের পর দিন কোনো মানুষের সাথে না কথা বইলাও একাকীত্ব অনুভব হয় না আমার। উল্টা বুয়া কাজ করতে আসলে ঘড়ির দিকে তাকায়া বইসা থাকি আর ভাবি, আপনি চইলা যান না ক্যান? অনেক কাজ হইছে। 

ধইরা রাইখা রাইখা আর কতোদিন বাঁচবে হে বাঙালি বধু? তোমাদের চোখের জলে ভাইসা যায় শাওয়ারের তল! ছাইড়াই দাও! ধইরা রাইখা লাভ কী? এই জান্নাত আর মানসম্মান আর বাচ্চাকাচ্চা দিয়ে কী হইবো যদি ভিতরটা হাহাকার করতেই থাকে! মনে রাইখো দুনিয়ায় কেউ তোমার না, কিচ্ছু তোমার না! তোমার বর তোমার না, তোমার বাচ্চা তোমার না, তোমার ঘর তোমার না। শুধু তুমিই তোমার। এই তোমার "তুমি" রে নিয়া চইলা যাও, ভাইগা যাও! খোলা শাওয়ার নিচে দাঁড়াইয়া হাইসা ওঠো মধ্যরাতে কিংবা চইলা যাও অন্য দুনিয়ায়!

২৯ জুন, ২০২০।
নারিন্দা, পুরান ঢাকা।

3658 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।