শাহনাজ ঈভা

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে নারীবাদী ঈভা লেখালেখির পাশাপাশি বর্তমানে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেল-এ প্রোগ্রাম অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন।

যারা স্বেচ্ছায় অবরোধবাসিনী

বাংলাদেশের বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কোনো রকমে একখানা চাকরী যোগাড় করতে পারলেই যেন প্রাণটা বাঁচে। আমার এক বন্ধু চাকরী নামক বিষয়টিকে 'সোনার' নয় বরং 'হীরার হরিণ' বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তবে আমার এই লেখনী চাকরীর 'অভাব' কে তুলে ধরা নয়, শিক্ষিত মেয়ে/নারীদের আত্নসম্মানবোধের 'অভাব' কে তুলে ধরা; যারা অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেয়ে যান আর নিজেকে সম্মানের আসনে আসীন রাখেন। অথচ এটি যে প্রকৃতপক্ষে তাদের আত্নসম্মানবোধহীনতা সেটা তারা বুঝতে নারাজ।

এদেশে চাকরীতে সীমিত আসন থাকায় সকলে চাকরী পাবে তা আশা করা বাস্তবসম্মত নয়। তাই ছেলে/পুরুষরা চাকরী না পেলেও আয়-রোজগারের অন্য কোনো উপায় খুঁজতে বাধ্য হয় সমাজ/পরিবারের চাপে। কারণ সমাজ তাদেরকে দায়িত্বশীল দেখতেই পছন্দ করে (তাদের এ দায়িত্ব অনেক ক্ষেত্রে টাকার অংক দিয়েও হিসাব করা হয়)। তাছাড়া বিয়ে করতে/বউ পালতে হলেও টাকার প্রয়োজন (পুরুষদের বিয়ে করা অবশ্যম্ভাবী, কারণ কোনো পুরুষ বিয়ে করতে না চাইলে সমাজ আবার তাকে নপুংসক উপাধি দিতে পারে)। তবে মেয়েদেরকে বিয়ে 'দেয়া' হয় যাতে বোঝাটাকে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া যায় (তাই তাদেরকে-ও বিয়ে দেয়া অবশ্যকর্তব্য)। আমার বিপত্তি সেখানেই যেখানে মেয়েটিও নিজেকে 'বোঝা' প্রমাণ করে ছাড়ে। তবে সে যে আসলেই একটা 'বোঝা' তা সে হয়তো মনে করে না। তথাপি সে সমাজের সামনে নিজেকে একটা বোঝা, অকর্মণ্য হিসাবে তুলে ধরে। একটু চিন্তা করলেই আশা করি বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

কোনো শিক্ষিত মেয়ে যদি চাকরী, ব্যবসা বা উপার্জন করতে না চায় সেটা একান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তার শিক্ষাটাকে সে যদি কাজে লাগাতে পারে বা কমপক্ষে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে তাহলে আমার কাছে সে যথেষ্ট সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হবে। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে এগিয়ে যেতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন পারিবারিক সহযোগিতা এবং শিক্ষার। সমাজ যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক সেহেতু এই সমাজে নিজেকে তুলে ধরতে হলে শিক্ষাই হতে পারে একমাত্র একটি অস্ত্র। এবং এজন্য নারীর শিক্ষাটাকে কাজে লাগানোর চেষ্টাকে আমি সাধুবাদ জানাই। পুরুষ/ছেলেদেরকে সমাজ/পরিবার জন্মলগ্ন থেকেই সুযোগ-সুবিধা ও সহযোগিতা দিয়ে আসছে বলে তাদেরকে কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে হয় না সাধারণত। এ কারণে আমি মনে করি, নারীর অগ্রগতির জন্য পারিবারিক সহযোগিতা বৃদ্ধির আশু প্রয়োজন।

যাই হোক, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত নয় এমন মেয়ে/নারী বিবাহিত কিংবা অবিবাহিত অবস্থায় সংসার বা পরিবার সামলে নেন, ভাই-বোন, সন্তানকে উপযুক্ত মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার প্রয়াস চালান এবং যদিও তাঁর এই প্রয়াস সকলের অগোচরেই থেকে যায় তবুও তিনি একজন সফল নারী। আমি এখানে তথাকথিত সর্বংসহা অবলা নারীর কথা বলছি না, বলছি ওই নারীর কথা যিনি পরিবারের সদস্যদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি উৎসাহ, উদ্দীপনা এবং সাহস জুগিয়ে যান নিরন্তর। যদিও বর্তমান সময়ে নারীরা তথাকথিত শিক্ষিত হচ্ছেন, তবুও এরূপ শিক্ষিত নারী খুঁজে পাওয়া কঠিন। কারণ আধুনিকতার ছোঁয়ায় শিক্ষিত গৃহিণী পাওয়া যায় ভূরি ভূরি যারা পরিবারকে এগিয়ে নেয়ার চেয়ে নিজের সাজ-সজ্জা আর বিলাসিতাকে এগিয়ে নিতেই তৎপর। তারা এ যুগের শিক্ষিত অবরোধবাসিনী যে অবরোধে তারা স্বেচ্ছায় বন্দী হয়েছেন। তারা নিজের পরিচয় গড়তে পারেননি বলে বরের (স্বামী শব্দটিতে আমার ঘোর আপত্তি আছে) পরিচয়ে পরিচিত হতে পেরে গর্বিত বোধ করেন। অর্থাৎ তারা 'মিসেস অমুক’ পদবীতে যার পর নাই খুশি থাকেন। কেউ মিসেস ডিসি, কেউ মিসেস এসপি, কেউ মিসেস অমুক নেতা, মিসেস অমুক এডভোকেট ইত্যকার পদবীর অহংবোধে ভুগতে থাকেন। তারা বরের পদবীকে নিজের পদবী ভেবে সর্বদাই সর্বত্র দাপিয়ে বেড়ান। মজার বিষয় হলো, বাংলাদেশে মিসেস ডিসি’রা পদাধিকার বলেই অনেক সভা সমিতির, সংগঠনের প্রধান হয়ে যান। এক্ষেত্রে উনার নিজের কোন যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক, শুধু মিসেস হতে পারাটা-ই প্রধান যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়।

আমার এক ব্যাচমেটের বর সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ব্যাচমেটকে ক'দিন পর পর ফেসবুকে রঙ-বেরঙ এর ছবি আপলোড দিতে দেখি, যেখানে তার বরের চেয়ে তার ছবিই বেশী থাকে আর তার অভিব্যক্তিতে অহংকার আর গর্বের ছাপও স্পষ্ট। বরের পরিচয়ে সে নিজের পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে অনেক আগেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একজন ভাল নৃত্যশিল্পী হিসাবে সে পরিচিত ছিলো। আর এখন অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছে, আর তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার পাশাপাশি অহমিকায় ভুগছে। তার এই মিথ্যে অহম এবং আত্নসম্মানবোধহীনতা দেখে আমার নিজেরই লজ্জা লাগে এই ভেবে যে এমন একটা অপদার্থ আমার ব্যাচমেট ছিলো! আশ্চর্য হয়ে যাই, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা কি শিখলাম যদি আমাদের ভেতরে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধই জেগে না উঠলো! এই ধরণের মিসেসরা তাদের অজান্তে সমাজের কাছে প্রমাণ করেন যে চাকরী বা ব্যবসা করার যোগ্যতা বা আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করার মুরদ তাদের নেই বলে বরের ঘাড়ে ভর করে নিজেদেরকে জানান দিতে চান। এতে যে তাদের দুর্বলতা আরও বেশী প্রকাশিত হয় সেটা বুঝতে পারেন না।

এ ধরণের আত্মসম্মানবোধহীন 'মিসেস'দেরকে অন্যের দ্বারা পরিবেষ্টিত খোলস থেকে বের হয়ে আগে নিজেদের সম্মান করা শিখতে হবে। শিক্ষিত হবার পরও এই ধরণের নারীরা যদি নিজেদেরকে সম্মান করতে না পারেন, তাহলে যে সকল নারী শিক্ষার আলো পায়নি ঐসব নারীদের দোষ কোথায় বা যারা বাধ্য হয়ে অন্যের নিয়ন্ত্রণে থেকে অবরোধবাসিনী হয়ে আছে তাদের ভুল কোথায়? তথাকথিত এসব মিসেস মার্কা শিক্ষিত রমণীদের (এরা রমনের উপাদান ছাড়া কিছু নয়) চেয়ে গৃহপরিচারিকাদের আত্নসম্মানবোধ বরং অনেক বেশী। গৃহপরিচারিকারা স্বাধীন, আত্মপরিচয়ে পরিচিত, সংসার এগিয়ে নিতে রয়েছে তাদের অনেক অবদান। এমনকি আগের যুগে যারা কম শিক্ষিত বা শিক্ষার আলো দেখার সুযোগ যাদের হয়নি (আমাদের নানী/দাদীরা) তারাও পরিবারকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আর আজকালকার এসব মিসেসরা কেবল ননীর ডিস্কো পুতুল হয়ে সাজঘর নামক অন্দরমহলে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করছেন। বিউটি পার্লার নামক নারীকে পণ্য করে তোলার দোকানগুলো বোধ করি তাদের জন্যই গড়ে উঠেছে। আফসোস হয়, তারা যে পরের ধনে পোদ্দারি করছেন সে জ্ঞানটুকুও তাদের হয়নি!  

আমরা যতই নারী স্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা বলে চিৎকার করি না কেনো, যতদিন পর্যন্ত নারী তাঁর নিজের পরিচয়ে পরিচিত হবার তাগিদ অনুভব না করবে, ততদিন আমাদের চিৎকার কোনো কাজে আসবে না। আর এই অনুভবটা আমাদের উপরতলার তথাকথিত মিসেস অমুক’রা যত দ্রুত অনুভব করবেন, তত দ্রুত আমরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ভাঙার একটা ধাপ অতিক্রম করতে পারব। 

 

19766 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।