শাহনাজ ঈভা

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে নারীবাদী ঈভা লেখালেখির পাশাপাশি বর্তমানে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেল-এ প্রোগ্রাম অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন।

নারীই কি নারীর শত্রু

'নারীরাই নারীদের শত্রু' কথাটা প্রায়ই শুনি। আর তা পুরুষদের চেয়ে নারীরাই বেশী উচ্চারণ করেন। শিক্ষিত নারীরা তো বটেই, দুঃখটা তখনই হয় যখন দেখি অন্তত সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, জেন্ডার স্টাডিজ ইত্যাদি বিষয়ে যারা উচ্চশিক্ষা লাভ করেছেন তারাও একথা বলেন। কথাটি একারণে বলছি যে সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রী হিসাবে আমি যদি উপরোক্ত 'উক্তি'র ব্যাখ্যা এবং কারণ জানতে পারি তাহলে উক্ত বিষয়গুলো নিয়ে যারা পড়াশোনা করেছেন তারা কেন জানেন না? কেন না, হয় তারা না বুঝে পড়াশোনা করেছেন, নতুবা কী পড়েছেন তা উপলব্ধি করতে পারেননি।

সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, জেন্ডার স্টাডিজ বা তৎসম্পর্কিত বিষয়গুলোর বিশাল পরিসরে feminism বা 'নারীবাদ' সম্পর্কে পড়ানো হয়। আর নারীবাদে স্বাভাবিকভাবেই নারী ও পুরুষের সংজ্ঞা ও পার্থক্য দেখানো হয় প্রথমেই। সকলে যেখানে এক্ষেত্রে তাদেরকে আলাদা করতে দৈহিক বা লৈঙ্গিক ভিন্নতাকে নির্দেশ করে সেখানে নারীবাদে তাদের পার্থক্য করা হয় মূলত: সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে। আর তাই দৈহিক ভিন্নতা এখানে গৌণ। অর্থাৎ একজন মানুষ কিভাবে সমাজের দ্বারা এবং সমাজের মাধ্যমে নারী বা পুরুষ হয়ে ওঠে তা ব্যাখ্যা করে নারীবাদ।

সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষ আজীবন সব কিছু সমাজ থেকে শিখে শিখে বেড়ে ওঠে। তবে নারী আর পুরুষদের এই সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া ভিন্ন হয় কেবল তাদের লৈঙ্গিক পার্থক্যের কারণে। আর একে বলা হয় 'sex role socialization' বা 'লিঙ্গ ভিত্তিক সামাজিকীকরণ'। এক্ষেত্রে দেখানো হয় ছোটবেলা থেকেই কীভাবে একটি মেয়ে শিশু ধীরে ধীরে একজন নারী এবং একটি ছেলে শিশু ধীরে ধীরে একজন পুরুষে পরিণত হয়। আর কীভাবে এই লৈঙ্গিক বা দৈহিক ভিন্নতা তাদের মধ্যে সামাজিক ও মানসিক বৈষম্য তৈরি করে।

তা ব্যাখ্যা করার জন্য বিভিন্ন সময় তৎসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গবেষণা চালানো হয়েছে। যদিও এই গবেষণাগুলোর অধিকাংশ পশ্চিমা দেশগুলোতে করা হয়েছে তবু তা আমাদের উপমহাদেশের জন্যও প্রযোজ্য হবে (দু'একটা বিষয় বাদে)। যেমন :- পশ্চিমে পুত্র শিশু জন্ম গ্রহণ করলে তাকে নীল তোয়ালে আর কন্যা জন্ম নিলে তাকে গোলাপি তোয়ালে দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয় (এটি বাংলাদেশে প্রযোজ্য না-ও হতে পারে)। তবে আরও কিছু উদাহরণ দেয়া যেতে পারে যা প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য উভয় জায়গাতে বিদ্যমান। যেমন:- পুত্রটি যখন একটু বড় হয় তখন তার হাতে খেলনা গাড়ি, বন্দুক, উড়োজাহাজ, বল, ব্যাট, বাইসাইকেল ইত্যাদি অর্থাৎ বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি সম্পর্কীয় জিনিস তুলে দেয়া হয়। পক্ষান্তরে, কন্যাটিকে দেয়া হয় পুতুল, হাড়ি-পাতিল, চুলা, সাজসজ্জার খেলনা যার সাথে বুদ্ধি সম্বন্ধীয় কিছু অবলোকন করা যায় না। ছেলেটি আরেকটু বড় হলে কোন কাজ করতে তাকে উৎসাহ, সাহস ইত্যাদি যুগানো হয়। আবার, সে যদি কোন কারণে কান্না করে বা ভীত হয় তাহলে তার ভাগ্যে জোটে ভৎসনা। অপরদিকে মেয়েটির ক্ষেত্রে উলটো ব্যাপার ঘটে। তাকে ভয় পেতে, গৃহস্থালি কাজ করতে উৎসাহ প্রদান করা হয়। ছেলেটি সশব্দে হাসতে পারে আর মেয়েটি আরেকটু বড় হলে জোরে হাসা তো দূর, 'পরপুরুষের' সামনে যাওয়াই তার নিষেধ। আর এভাবে একটি ছেলে শিশু হয়ে ওঠে 'পুরুষ ' আর মেয়ে শিশু 'অবরোধবাসিনী নারী ' বা কেবলই 'নারী'। আর তাই সাহস, বুদ্ধি, জ্ঞান, বিজ্ঞান, বীরত্ব, ক্ষমতা, শক্তি, স্বাধীনতা ইত্যাদি শুধুমাত্র পুরুষদের সম্পত্তি; তাই তারা 'প্রভু'। অন্যদিকে ভয়, লজ্জা, মায়া, মমতা, পরনির্ভরশীলতা, দুর্বলতা পরাধীনতা ইত্যকার ব্যাপার নারীদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয় বলেই তারা প্রজা।

যদি এসব সমাজ সৃষ্ট 'নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের' অন্তত কয়েকটির ব্যাতিক্রম কোন পুরুষের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় তাহলে সে 'half lady' আর কোন নারীর মধ্যে দৃষ্ট হলে সে 'tom boy' বা 'দস্যি মেয়ে' উপাধিতে ভূষিত হয়। সমাজ এভাবেই মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে আর ঠিক এভাবেই নারীদেরকে নারীদের শত্রু বানায়। বাংলাদেশে সাধারণত বউ-শ্বাশুড়ি, ননদ-ভাবীর পারস্পারিক দ্বন্দ্ব বেশী দৃশ্যমান। অথচ জামাই-শ্বশুর, শালা-দুলাভাইয়ের কোন্দল চোখে পড়ে না (পড়লেও তা কদাচিৎ)। কেন এমনটি হয়?

পুরুষরা নারীদের তুলনায় জীবনে অনেক বেশী সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতা পেয়ে থাকে সমাজ থেকে। একারণে আজীবন বিভিন্ন সময় এবং পরিস্থিতিতে তারা তাদের ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারে অর্থাৎ power exercise করতে পারে। তাই মাঝে মধ্যে তাদের এই ক্ষমতা চর্চা না করলেও চলে। কিন্তু এর বিপরীতে দেখা যায় নারীরা থাকে অবদমিত এবং এক প্রকার ক্ষমতাহীন ব্যক্তি। হুকুম পালন করাই যেন তার কাজ। এমনকি পুরুষতান্ত্রিকতার বেড়াজালে তার পরিচয় অর্জিত হয় অন্যের পরিচয়ে যেখানে নারী তার নিজের নামটিই হারিয়ে ফেলে। অতএব, অবিবাহিত নারীর পরিচয় তার বাবা, বিবাহিত হলে বর আর মা হওয়ার পর সন্তান। সেই নারী যদি একবার ক্ষমতা পায় তাহলে সে তার সর্বোচ্চ চর্চা করতে গিয়ে এর অপব্যবহার করে বসে। তখন তার অধীনস্থ থাকে একজনই যে কিনা তার পুত্রবধূ, ভাতৃবধূ ইত্যাদি যারা যাবতীয় 'বধূ' সম্পর্কিত তারা। পরের মেয়ের উপর তখন ইচ্ছেমত নিয়ন্ত্রণ নেয়া যায়। এই 'নন্দ ঘোষ' এর উপর নারীরা তাদের সারা জীবনের অতৃপ্ত আত্নার সর্বময় ক্ষমতা চর্চা করতে থাকলে এক পর্যায়ে পারস্পারিক যুদ্ধের গোড়াপত্তন ঘটে। এসবের পেছনে পুরুষদের তথা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের হাত রয়েছে যা স্থূলদৃষ্টিতে গোচরীভূত হয় না।

যেহেতু সমাজ একদিনে পরিবর্তিত হয় না তাই এ সমস্যাও একদিনে বা তাড়াতাড়ি বদলে যাবে তা আমি আশা করি না। বিবর্তনের মাধ্যমেই আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে। এজন্য আমাদেরকে মূলে আঘাত করতে হবে। শিশুদেরকে যদি যৌক্তিক, নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি যথার্থ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার প্রয়াস চালানো হয়, অন্যকে লৈঙ্গিক নয় বরং মানবিক দিক থেকে বিবেচনা করে সম্মান করতে শেখানো হয় তবেই এই 'শত্রুতা' ঘুচবে বলে আমার বিশ্বাস।

আর যারা শিশু নন তাদের দরকার দৃষ্টিভঙ্গি ও মন-মানসিকতার অপবর্তন। বাড়িতে মেহমান আসলে বা কোন শিশু পৃথিবীতে আসলে আমরা তাকে নানান ভাবে সমাদর করি। এতে তারা সন্তুষ্ট থাকে, আমাদেরকে মূল্যায়ন করে। তাদেরকে যত্ন করা আমদের দায়িত্ব বলে মেনে নেই। তথাপি বাড়িতে নতুন বউ আসলে আমরা তাকে মেহমান বা শিশুটির মতো ভাবি না। উল্টো সে আমাদের প্রতি যত্নশীল হবে এটা ধরে নিই। অথচ তার সাথে বরং একজন অতিথির ন্যায় আচরণ করা উচিত। সে বেচারি সবাইকে ছেড়ে আমাদের কাছে এসেছে। তাই তাকে আগে আপন করে নিতে হবে। পরবর্তিতে সে আমাদের আপন করে নিবে। আরেকজনের কাছ থেকে আশা না করে নিজেকেই শুরু করতে হবে মিত্রতা।

5779 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।