তখন সবে ১৪তে পা দিয়েছি। কি নারী, কি পুরুষ, কি পুরুষতন্ত্র, কি মৌলবাদ বুঝি না। দেখার পৃথিবী শুধুই রঙিন। প্রেম প্রেম একটা বয়স। এমন উড়ো উড়ো জীবনে একদিন হঠাৎ 'তসলিমা নাসরিন' নামটির সাথে পরিচয় হলো আমার। কে বা কারা তসলিমা নাসরিন নামক কোন ব্যক্তিকে নিয়ে একটা কবিতা বানিয়েছে, সেটার অডিও ক্লিপ শুনেছিলাম বিজ্ঞানের এক শিক্ষকের মারফতে। আজও যার কিছু চরণ আমার মনে আছে।"রবীন্দ্রনাথ বললেন, কে যায় বাছা, দোলাইয়া পাছা.....আমি, আমি তসলিমা নাসরিন।" সারমর্ম এমন--"রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শামসুর রাহমানের মতো বড় বড় কবিরা বিভিন্নভাবে সঙ্গমের ইচ্ছা প্রকাশ করছে, কিন্তু সবাই শঙ্কিত, তসলিমা নাসরিনকে আদৌ তৃপ্ত করতে পারবে কিনা!"
এই অশ্লীল কাব্য আমি একা শুনেছিলাম, এমন নয়। সেখানে সহপাঠীরা অনেকেই ছিলো। ছেলে বন্ধুরা মিটিমিটি হাসছিলো, মেয়েরা সবাই লজ্জ্বায় মাথা নিচু করে ছিলো। মনে মনে খুব রাগ হলো আমার। তসলিমা নাসরিন সে যেই হোক, এমন জঘন্য কবিতা স্যার কেনো আমাদের শুনাবেন! অবশ্য শুনিয়ে চুপ ছিলেন না, জিজ্ঞেস করলেন, কে কে চিনে তসলিমাকে। ২/৩টা ছেলে মাথা নেড়ে সায় দিলো। অর্থাৎ তারা চেনে।
একজন বললো, 'স্যার উনি তো নাস্তিক!(চোখেমুখে ঘেন্না)।' স্যার বললেন, 'শুধু তাই না, চরিত্রহীন।'
বিপরীত শব্দে শিখেছিলাম, আস্তিকের বিপরীত নাস্তিক (যার অর্থ যারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে না)। কিন্তু নাস্তিক হলে এভাবে ঘৃণা করতে হবে কেনো, বুঝলাম না। আর যদি চরিত্রহীনও হয়, খারাপ মেয়ে তো চারপাশে কতোই আছে, ইনি এমন কোন ব্যক্তি, যাকে হেয় করার জন্য রবীন্দ্রনাথের মতো কবির প্রয়োজন পড়লো মানুষের!
প্রশ্ন আছে, উত্তর কেউ দেয় না। না আব্বু, না আম্মু। যেন এমন কিছু আমি জানতে চাই, সেটা মুখে আনলেই তারা দোজখে যাবেন। অবশেষে একদিন এক খালামণি বললো -"তসলিমা নবীকে নারীলোভী বলেছে, আল্লাহকে মানে না, আরো কয়, আল্লায় নাকি মেয়েদের সম্মান দেয় নি, অধিকার দেয় নি, দাঁড়ায়ে প্রস্রাব করতে চায়, পুরুষদের ধর্ষণ করতে চায়। মুসলমানরা নবীজির এই অবমাননা সহ্য করতে না পেরে, ওর ফাঁসি দাবি করে, তখন যে আল্লাকে মানে না, তারই বোরখা পড়ে, ইন্ডিয়া পালাইছে।"
গালাগালি আর ফাঁসি সমর্থন না করলেও, আমারও খারাপ লাগলো। মনে হলো, ইসলাম ধর্ম সে জানে না ভালো, তাই এমন বলেছে। ধারণাটা আরও পরিষ্কার হলো, ডা. জাকির নায়েকের তসলিমাকে নিয়ে করা একটা মন্তব্য শুনে। উনি তসলিমাকে ওপেন চ্যালেঞ্জ দিলেন। দাবি করলেন, আগের পরের আয়াত না পড়ে তসলিমা বিভিন্ন আয়াত নিয়ে আপত্তি তোলেন। আমার খারাপ লাগলো তসলিমার জন্য। না বুঝে কতো পাপ করছে, আল্লাহ মাফ করুক এমন প্রার্থনাও করলাম।
২০১৩ সালের শুরুতে ফেইসবুক ব্যবহার শুরু হলো আমার। সম্ভবত, কিছু সময় পর, 'প্রথম আলোর' একটা নিউজে চোখ আটকে গেলো আমার। তসলিমা নাসরিনের একটা ফেইসবুক পোস্ট তারা ছাপিয়েছে। আমি লেখাটি খুব উৎসাহ নিয়ে পড়লাম, বেশ ভালোও লাগলো। আরো লেখা পড়তে ইচ্ছা করলো, পুরনো কৌতুহল তো আছেই। আমি নামের বানান ধরে ধরে সার্চ করলাম, পেয়েও গেলাম। কিন্তু সমস্যা হলো, একাধিক আইডি আছে একই নামে। ৩/৪টি আইডি একটু ঘাটাঘাটি করলাম, ১টি বাদে, বাকি সবগুলোতে আজেবাজে ছবি আর গালাগালি, যেমনটা সেই প্রথম অভিজ্ঞতায় জেনেছিলাম। দু’একটি ভালো লেখাও আছে। আমি সেই ১টি আইডির উপর ভরসা করলাম। রিকোয়েস্ট পাঠানো যায় না, ফলো করলাম। ওনার ছবি প্রথমবার দেখে কেমন একটু লাগলো, ছেলেদের মতো ছোট চুল। আগে কখনো দেখি নি এমন। তারপর থেকে নিয়মিতই তার পোস্ট ফলো করছি আমি। বেশিরভাগই ভালো লাগে। ধর্মীয় বিষয়গুলো এড়িয়ে যাচ্ছি ওনার লেখার।
একদিন পরিচিত একজনকে জানালাম তসলিমার কিছু লেখা সম্পর্কে। সে সাপোর্ট করলো, বললো তারও ভালো লেগেছে। কিন্তু দু’দিন পর সেই ফোন করে বললো -"তসলিমা লেখালেখির জন্য প্রেম করে, তারপর ছুড়ে ফেলে দেয় পুরুষদের। মনে হলো, ছেলে বলে, তার একটু বেশিই লেগেছে। তাছাড়া, তসলিমা কোরআন সংশোধনের দাবি করেছে। এসব তার দু’দিনের গবেষণার ফল (রাগে ফুসছিলো রীতিমত)। আমাকে আনফলো করে দিতে বললো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনফলো করে ঝড় থামালাম। কিন্তু তার বেশিরভাগ লেখা আমার এতবেশি ভালো লাগছিলো যে, আমি ঠিক করলাম, তসলিমা যা হয় হোক, আস্তিক-নাস্তিক-খারাপ, আমি লেখাগুলো পড়বো। ভালমন্দ যাচাই করার বোধশক্তি তো আছে আমার, যেটুকু ভালো লাগবে, গ্রহণ করবো, বাকিটুকু এড়িয়ে চলবো।
এভাবেই চলে যাচ্ছিলো। এইচএসসি, অ্যাডমিশন, নতুন ক্যাম্পাস নিয়ে কেটে যাচ্ছে। ১ম বর্ষেই 'স্পোর্টস সোসিওলজি' নামে একটা কোর্স ছিলো। যার একটা টপিক 'সেক্স আন্ড জেন্ডার'। এই ছোট্ট একটা টপিক আমার অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর দিলো।
তসলিমা নাসরিন
প্রথমেই জানা হলো, সেক্স শব্দের পাশে ডিফারেন্স আর জেন্ডারের পাশে ডিসক্রিমিনেশন কেনো লেখা হয়। আর কেনোইবা মানুষ সেক্স ইক্যুয়ালিটি না বলে 'জেন্ডার সমতা' দাবি করে। সামান্য শারীরিক পার্থক্যের উপর ভিত্তি করে বুঝে বা না বুঝে আদিম মানুষ যে শ্রম বিভাজন তৈরি করেছিলো, তারই বহুসংস্কার আজকের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিত্রটি।
শত শত বছর কেটে গেছে, মানুষ আধুনিক হয়েছে, কিন্তু মেয়েদের একই অবস্থায় রাখা হয়েছে সুকৌশলে, স্বর্ণলতার শিকল কখনও লোহায় রুপ নিয়েছে কখনও সোনায়। তবে যুগের সাথে বা এখনও বাংলাদেশে সেই আদিম চিন্তাধারা পাল্টিয়ে সমতা আনা সম্ভব হচ্ছে না কেনো! এই প্রশ্নের জবাবও মিললো সেখানেই। যুগে যুগে এসব অসম জেন্ডারের উপর বিভিন্ন ধর্ম আরোপিত হয়েছে, যা সময়ের সাথে যুগোপযোগী করা যায় না। 'নারী' বইটি পড়ার পর আর কোনো সংশয় ছিল না, যে মেয়েদের ধর্ম প্রদত্ত অধিকার "ক্যাটবেরির মোড়কে জড়ানো চার আনার লজেন্স" ছাড়া কিছুই না।
যখন "রিলিজিয়াস ওপ্রেশন" সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা হয়েছে আমার, আমি তখনও জানি না, কে তসলিমা নাসরিন! কি করেন তিনি আসলে? শুধু কি ফেইসবুকেই লিখেন তিনি? তিনি কি কবি নাকি লেখক? কি লেখেন তিনি? ধর্ম নিয়ে কি লিখেন আসলে? হাজারো প্রশ্ন মাথায়।
গুগল করলাম -'তসলিমা নাসরিন কে?'
রেজাল্ট যে পেলাম, তার জন্য খুব বেশি অপ্রস্তুত ছিলাম না। ধরণ এমন :
১। কে কে তসলিমার শয্যাসঙ্গী ছিলো, ভিডিওতে দেখে নিন'
২। এইমাত্র তসলিমার পর্ণ বেরিয়েছে, দেখে নিন', ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিছু ইন্টারভিউও মিললো :
১। রাস্তায় দাঁড়ায়ে প্রস্রাব করতে গিয়ে জামাকাপড় নষ্ট হলো তসলিমার,
২। পুরূষের মতো ধর্ষন করতে গিয়ে নিজেই প্রেগন্যান্ট তসলিমা,
৩। যৌবন শেষের দিকে, কেউ ফিরে তাকায় না, তাই তওবা করে ধর্মের পথে ফিরত চান তসলিমা'
কমেন্টের গালিগালাজও কিছু কম নয়। বাঙালি এক আজব চিজ! বাংলার বাইরে দেখতে হবে। যাহোক, আমি কিওয়ার্ড পাল্টালাম। টাইপ করলাম-"Taslima Nasreen"
প্রথমেই বায়োডাটা পেলাম উইকিপিডিয়ায়। একদমে পুরোটা পড়ে ফেললাম। আমি জানলাম, তসলিমা নাসরিন ডাক্তার, লেখক, কবি, ৪২টি বইয়ের লেখক, তিনি নারীবাদী লেখক, স্যেকুলার হিউম্যানিস্ট, ২বার আনন্দ পুরষ্কার ছাড়াও ইউরোপে ডজনখানি পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি, সুইডেনের নাগরিক হলেও বর্তমানে দিল্লীতে থাকেন এবং একজন সেলিব্রেটি।
হতবাক হয়ে গেলাম। ইনিই সেই তসলিমা, যাকে আমি চিনেছি অশ্লীল কাব্য থেকে। দুটো মাত্র শব্দ। একটা 'তসলিমা নাসরিন' অপরটি 'Taslima Nasreen'. দুটো শব্দ দুটো তসলিমাকে প্রমোট করে। আমি সৌভাগ্যবান। আমি Taslima Nasreen চরিত্রটি জানতে পেরেছি।
ভাবলাম, কিছু ইন্টারভিউ তো থাকবেই ইউটিউবে। অনেক ঘাটাঘাটি করে, ৭১টিভি কে দেওয়া একটা ইন্টারভিউ খুজে বের করলাম। পুরোটা দেখলাম খুব মনযোগ দিয়ে। অনেক প্রশ্নের উত্তর পেলাম। তার কোনো কথাই আমার অযৌক্তিক মনে হয় নি। নতুন প্রজন্মের প্রতি তার আশার কথা শুনে ভেতরটা মোচড় দিলো। ঠিক করলাম, বই পড়বো প্রথমে। বাজারের লাইব্রেরিতে খোজ করলাম, না, কোনো বই নেই। দোকানী কেমন একটা নজরে তাকালেন। বললেন, ওনার বই রাখি না। মন খারাপ হয়ে গেলো। কোথায় পাবো বই? ঢাকার নীলক্ষেতে সব বই পাওয়া যায় শুনেছিলাম, কিন্তু সম্ভব না যাওয়া। পিডিএফ পাওয়া গেলে মন্দ হয় না। গুগল উল্টায়ে পাল্টায়ে ১৩টা কই পেয়ে গেলাম। আমার আনন্দ দেখে কে! কোনটা রেখে কোনটা পড়ি। আত্মজীবনী মেয়েবেলা দিয়ে শুরু করলাম।
সামনে পরীক্ষা ছিলো। জীবনে কোনোদিন পরীক্ষাকে অবহেলা করি নি। এবারের ব্যাপারটি অন্য হলো। তসলিমার বই পড়া আমার কাছে জরুরি মনে হলো। সারাদিন ক্লাস করে টিউশন করিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে বই পড়তাম। জাগতাম সারারাত। একফোঁটাও ঘুমাতাম না। এভাবে নির্ঘুম তিন রাতের মাথায় শরীরের কাছে হেরে গিয়ে পুরো একদিন ঘুমালাম। ঘুম থেকে উঠে আবার পড়তে শুরু করলাম। এক সপ্তাহের মাথায় আত্মজীবনীর ৫ম খন্ড শেষ হলো। ঘুমহীন উন্মাদের মতো হয়ে গেলো চেহারা। আকটিভ মেয়েটি ক্লাসে যেতে দেরি করেছে এই সপ্তাহটি জুড়ে, ক্লাসে ঘুমিয়েছে, স্যারেরা বিরক্ত হয়েছে, বন্ধুরা হাসাহাসি করেছে। আর মেয়েটি তসলিমার একাকীত্ব আর বিষাদে ডুবে অর্ধমৃত জীবন যাপন করেছে, কেঁদেছে সপ্তাহটি জুড়ে, কিন্তু মনে মনে নির্বাসিত থেকে ২৪ বছর। লেখক আর পাঠক তখন অভিন্ন সত্তা।
পরের সপ্তাহে পড়া হয় ৩টি কবিতার বই আর ৩টি উপন্যাস। তারপর 'নারীর কোনো দেশ নেই' বইটি। সর্বশেষ 'নির্বাচিত কলাম'। মেয়েটি ঠিক করে লেখককে কৃতজ্ঞতা জানাবে, ভালোবাসি বলবে। হয়তো কোনোদিন চোখে পড়বে না জেনেও, ফেইসবুকে লিখে পাঠালো নীচের চিঠিটা।
প্রিয় কবি,
কেমন আছেন? আপনাকে যখন প্রথম মেসেজটি করেছি, তখন আপনার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতাম না। তাই যতটা সম্মানপ্রাপ্য আপনার জানানো হয় নি অজ্ঞতায়। আপনার যত লেখা পড়ছি, যত ইন্টারভিউ দেখছি, আপনার সাহস, সততা, মেধা আপোষহীনতার কাছে মাথা নত হতে হতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। যখন 'মেয়েবেলা পড়েছি, নিজের শৈশব থেকে আলাদা করতে পারি নি, অন্য কারোর জীবন মনে হয় নি। আমিও চোখের সামনে বাবার পরকিয়া দেখেছি, ব্যথিত হয়েছি, মাকে প্রচন্ড ধার্মিক হয়ে উঠতে দেখেছি। 'উতল হাওয়া' সম্পর্কে কিছু বলবো না,আপনি রুদ্রকে ভালোবাসেন বলে, শুধু এটুকুই মনে হয়েছে যে, যা দুর্ভোগ পেরিয়েছেন জীবনে, কবি রুদ্র তার কম দেয় নি। 'দ্বিখন্ডিত' পড়ে অনেক কিছু শিখেছি, এত কঠিন সময়ে কিভাবে টিকে ছিলেন, বিশ্বাস হয় না আমার। আর 'সেই সব অন্ধকার' পড়তে পড়তে বাড়ি যাচ্ছিলাম বাসে করে, এক জায়গায় বাস দাঁড়ালো দেখি কিছু হুজুর দাড়িয়ে আছে, বইটাতে এতটা নিমজ্জিত ছিলাম যে, আচমকা ভয়ে জানালা বন্ধ করে দিলেছিলাম। মৌলবাদিরা কত হিংস্র হতে পারে, জেনেছি।
এরপর পড়েছিলাম 'আমি ভালো নেই '।সত্যি বলতে আমিও কোনোমতেই ভালো থাকতে পারি নি বইটা পড়ে। খুব একা লেগেছে। এই পাঁচটি বই পড়েছি একটানা কয়েকটা রাত জেগে। প্রতিদিন ক্লাসে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। কিছু ভালো লাগতো না, আপনার কষ্টে আছন্ন হয়ে থাকতাম সারাদিন। বাকি খন্ডগুলো জোগাড় করতে পারি নি। লজ্জা, শরম, শোধ এই তিনটা উপন্যাস পড়েছি। প্রত্যেকটা বই পড়ার পর মনে হয়েছে, নিজের অধিকার উপলব্ধির জন্য, নিজের সচেতনতার জন্য এই একটি বই'ই যথেষ্ট।
বালিকার গোল্লাছুট, ভালোবাসো, ছাইবাসো! বন্দিনী, খালি খালি লাগে, কিছুক্ষণ থাকো, জলপদ্য কবিতার বইগুলো পড়ে মুগ্ধ হয়েছি, কিন্তু মুগ্ধ করে ছাড়েন নি, বাস্তবতাও দেখিয়ে দিয়েছেন, সেখানেই আপনি ভীষণ স্বার্থক। "নারীর কোনো দেশ নেই" বইটি এপর্যন্ত সেরার তালিকায় ছিলো, কাল পড়া হলো 'নির্বাচিত কলাম'। আমি স্পিচলেস হয়ে গেছি। সেই সময় আপনি এগুলো লিখেছেন! আজও এদেশে এসব বলার সাহস কারোর নেই। এত সুন্দর করে উপলব্ধি করেছেন, শেখার শেষ নেই আপনার কাছে সত্যি।
আমার বিশ্বাস হয় নি মেয়েদের প্রতি এমন অবিচার কোনো ঈশ্বর করতে পারেন। করলে তিনি কিভাবে ঈশ্বর হন সেটাও বোধগম্য নয়। কোনো একজায়গায় আপনি লিখেছিলেন -"রবীন্দ্রনাথকে আপনি ঈশ্বর মানেন, এই ঈশ্বরের কাছে আপনি পরাজিত।"
আমি বলি, "তসলিমা নাসরিন নামক ঈশ্বরের কাছে আমি পরাজিত।" আপনিই আমাকে নতুন করে সৃষ্টি করেছেন। এই প্রজন্মটাকে তসলিমা নাসরিনের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত করেছে যেসব মোল্লা আর নষ্ট বুদ্ধিজীবী, তাদের কখনো ক্ষমা করা যায় না। জাতির জন্য অভিশাপের চেয়ে কম কিছু নয় তারা।
ভালো থাকুন প্রিয় মানুষ। বেঁচে থাকুন, কলমটা আরো একশ বছর চলুক চাই। অনেক ভালোবাসি আপনাকে।
বইগুলো পড়ার পর হঠাৎ করে খুব একা হয়ে গেলাম আমি। হঠাৎ কেউ যেন, লাথি মেরে আকাশ থেকে মাটিতে ফেলে দিয়েছে আমাকে, সমাজের পেছনের গল্পটি আগে কেউ এভাবে বলে নি, শোনার মতো প্রস্তুতিও ছিলো না আমার। একা লাগতো কারণ তখন আমার চিন্তাভাবনা কারো সাথে মিলছে না, আমার চারপাশের মানুষগুলো সমাজকে এভাবে চেনে না, জানে না।
জানতাম, আপনার সান্নিধ্য কখনো পাবো না, আপনাকে ভালোবাসে এমন কিছু মানুষ যেন অন্তত পাই, যাদের সাথে মনখুলে কথা বলা যাবে, তাদের খুজেছি। সেটাও সহজ হয় নি, বড় বড় মানুষের কাছের মানুষগুলোও হয়তো সাধারণ হয় না, আর আমার মতো সাধারণ মানুষ খুব কম আপনাকে জানতে পারে। ইতু'কে হঠাৎ একদিন খুঁজে পেয়েছিলাম। 'তসলিমা পক্ষের জন্য ইতু অনেক করেছে। ইতুর কাছে কৃতজ্ঞ আমি। তসলিমা পক্ষের সাথে যুক্ত সবার কাছেই।
সাধারণ হলেও গল্পটা বলা প্রয়োজন মনে হয়েছে আমার। কারণ আমার মতো এমন অনেক তরুণ-তরুণীর জীবনে তসলিমা এভাবেই আসে হয়তো। তদের হাতে তসলিমা নাসরিনের বই তুলে দেবার মতো উদার মানুষ হয়তো নেই, যেমন আমার ছিলো না। তাই আমার মতো সবাই বাধাগুলো পেরিয়ে 'Taslima Nasreen' পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না, 'তসলিমা নাসরিনেই' আটকে যায়। সবাই জানে না, "তসলিমা নাসরিনকে" পাওয়া যায়, কিন্তু "Taslima Nasreen" কে অর্জন করতে হয়। গল্পটা তাদের জন্যই।