রুমানা রশিদ রুমি

রুমানা রশীদ রুমী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগ হতে স্নাতক আর স্নাতকোত্তর ড্রিগ্রি নেবার পর মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনায় এম বিএ করেন। বর্তমানে আইন বিজ্ঞানে অধ্যায়নরত। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতাকে। ছিটকে পড়ে যোগ দেন ব্যাংকে। লেখালিখি আর কাটখোট্টা ব্যাংকিং এক সাথে তাল মেলাতে না পেরে বর্তমানে আছেন ‘দি বাংলাদেশ মনিটর’ এর ‘ফিচার রাইটার”হিসেবে। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ম্যাগাজিন ‘রংঢং’। নিয়মিত লেখেন ‘দি বাংলাদেশ অবজারভারে”। লিখছেন বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকায়। কাজ করছেন নারী সম্পদ নিয়ে। ‘শূন্য প্রকাশ’ প্রকাশনী থেকে ২০১৫ সালের ‘একুশে বইমেলায়’ বের হয় তাঁর প্রথম ফিউশন ‘জয়িতা’। পাঠকের উৎসাহে চৈতন্য প্রকাশনী থেকে বের হচ্ছে “এ শহরের দিদিমনি “।

একটি ধর্ষণ রম্যকথা, একটি পরকীয়া এবং একজন স্তন্যদায়ী মা

একটি কথা শুরুতে বলে নেই আমি বেশ মা বাদী। মা বাদী মানে মা’কে নিয়ে কথা বলি, মায়ের কথা বলি। ভাবতে পছন্দ করি আজকের মা একটি সুন্দর চেতনাসমৃদ্ধ জাতি তৈরি করতে পারেন, যদি তিনি নিজে হুম নিজে স্বশিক্ষিত আর চেতনা সমৃদ্ধ হন। মা নিজ হাতে সন্তানকে লালন করবেন আদর্শগত জায়গা থেকে। এটা তার মৌলিক জায়গা। মানে charity begins at home আর সেই হোম হচ্ছে মা। আমার কাজের জায়গা এইখানটিতে। এবার বলি আসল কথা।

কদিন আগে বাংলাদেশী নায়িকা পূর্নিমা এক টকশোতে ভিলেন মিশা কে ধর্ষণ বিষয়ক কিছু কথা নিয়ে রসবোধ করেন যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কলরব শুরু হয়। হবারই কথা। কারণ তারা গনমাধ্যমকে ব্যবহার করলেন কিন্ত ভূলতথ্য প্রচার করলেন। মানুষের কাছে ধর্ষণ আনন্দঘন বলে এক বার্তা গেলো। এমনিতেই ভার্চুয়াল নির্ভর বর্তমান যুগের ছেলেমেয়েরা ভালোমন্দের বাছ বিচার করে না যা পায় তা ভাইরাল করে। তারওপর যদি কোনো তারকা এমন কাজ করেন তা হয় নাচুনে বুড়ির ঢোলে বাড়ি দেবার নামান্তর। ফলে ‘উত্তম পুরুষেরা ধর্ষণকে না বলে” ক্যাম্পেইন যতটা না অকর্ষনীয় তা অপেক্ষা রাস্তাঘাটে, হাটে বাজারে কোথায় কোনো নারীর কত প্রশস্ত বক্ষ তা গবেষনা বেশী আকর্ষনীয় মনে হয়।

তাহলে কি সম্পর্ক হবে জোর করে না বরং ফুসলিয়ে? কি উত্তর দেবেন প্রজন্মকে? এবার তাই ২৫ বছর সংসার জীবনে এক নারী তার পরকীয়া প্রেমিকের সাথে যোগসাজকে স্বামীকে হত্যা করেছেন এমনি ঘটনার দর্শক হলেন বাংলাদেশ প্রজন্ম। সুতরাং হলভর্তি জোরে হাতে তালির পালা।

এবং এগুলো শুধু এর ওয়াল থেকে তার ওয়ালে প্রচারই হচ্ছে। কিছু হাসি, রাগ আর লাভ আইকন দিয়ে রসালো হয়ে উঠছে ।

অদ্ভুদভাবে বেড়ে উঠছে আমাদের প্রজন্ম। আমরা কি একবারো ভাবছি কি অপরাধপ্রবণ একটি জাতি তৈরী হচ্ছে সামনে আমাদের? কি হতাশাগ্রস্থ একটি জাতি? যারা ভালোবাসা বুঝবে না, যারা নারী পুরুষকে আর পুরুষ নারীকে সম্মান করা বুঝবে না। ভাববে এরা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। পাশের জন যে সারা জীবনের জন্য ছায়া হয়ে থাকতে পারে ওরা তা শিখবে না। ওরা হয়তো অপেক্ষা শব্দটির সাথে পরিচিতই হবে না।

ওদের বন্ধুদের আড্ডায় হয়তো হবে একজন প্রেমিকা সবার কমন প্রেমিকা। কি ভয়ংকর সে বন্ধুত্ব যেখানে আমি জানি আমার পাশের বন্ধুটির কামুক দৃষ্টি আছে আমারই ভালোলাগার মানুষটির ওপর। তা আবার মেনেও নেবে আর ভাগাভাগিও করবে। এই তো আধুনিকতা, তাই তো?

এখানে বান্ধবী যদি রাজি না হলেন তবে তা ধর্ষন আর যদি মেনে নিলেন তবে তা পরকীয়া। মুদ্রার এপাশ ওপাশে একই কথা।

সম্প্রতি একজন হকি খেলোয়াড় মা তার সন্তানকে প্রকাশ্যে স্তন্যদানের জন্য  সমালোচনার মুখে পড়েন।

সমাজের সব চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে প্রকাশ্যে সন্তানকে স্তন্যদান করে আলোচনায় এসেছেন এ হকি খেলোয়াড়। কানাডার আলবের্তার সেই মহিলা হকি খেলোয়াড়ের নাম শেরা স্মল। এর জন্য কড়া সমালোচনা সইতে হচ্ছে তাঁকে।

প্রায় আট মাস আগে কন্যা সন্তানের মা হয়েছেন শেরা। তিনি স্কুলে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি একজন হকি খেলোয়াড়ও। তিনি সাধারণত প্র্যাকটিসে যাওয়ার আগে পাম্পের মাধ্যমে সন্তানের জন্য বাড়িতে দুধ রেখে আসেন। কিন্তু একদিন তা ভুলে গিয়েছিলেন, তাই খিদের জ্বালায় তাঁর সন্তান কাঁদতে শুরু করে।

শেরার মা তাই নাতনিকে নিয়ে মাঠে চলে যান। অনুশীলনের ফাঁকে মাঠের পাশে একটি রুমে বসে তিনি মেয়েকে স্তন্যপান করান গায়ের জার্সি খুলেই। চমৎকার সেই সুন্দর মুহূর্তকে ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন সেই হকি খেলোয়াড়ের মা। পরে ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টও করেন শেরা। ছবিটি পোস্ট করে শেরা লিখেছেন, ‘একজন মা হিসেবে নিজের সন্তানের কাজে লাগতে পারাটা দারুণ আনন্দের। আমাদের শরীর অমূল্য। তবে নিজের শরীরের গুরুত্ব বেশি করে অনুভব করলাম এদিন।’

অবশ্য শেরার প্রকাশ্যে স্তন্যদানে সমালোচনার ঝড় উঠে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরালও হয়ে পড়ে ছবিটি। কারণ এটাও কোনো তারকার কথা এবং কাজ। কথা তো উঠবেই।

অনেকেই ছবিটিকে অশালীন বলেও মন্তব্য করেন। এ ব্যাপারে শেরা বলেন, ‘হয়তো অনেকেই অশালীন বলবেন আমার সেই ছবিটিকে। কিন্তু এই মুহূর্তটা আমার কাছে অনেক স্পেশাল।’।

আমিও শেরার পক্ষে। কারণ শেরা কোনো ভূল তথ্য দেন নি। বরং মাতৃত্বের মতো গুরুত্বপুর্ণ বার্তা তিনি সকলকে পৌছে দিয়েছেন।

স্তন্যদানের মতো অতি গুরুত্বপূর্ন তথ্যটি যখন চিকিৎসকেরা বলেন অনেক মাকেই বিকল্প খুঁজতে খোঁড়া অযুহাত দিতে দেখেছি। এমনকি অনেক বাবা তার সন্তানের মাতৃদুগ্ধ পান অপেক্ষা স্ত্রীর আকর্ষণীয় বক্ষ রাখতে ঔষধ সেবনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে দেখেছি। আমাদের সেলিব্রেটিরা তো সন্তান জন্মদান বিষয়টাকে লুকিয়ে রাখাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। পাছে তার কাছে নতুন কাজের অফার আসা বন্ধ হয়ে যায়। শেরা বরং আমার কাছে সেরা। কারণ তিনি ক্যারিয়ারের পাশাপাশি মাতৃদুগ্ধ পান নিয়ে যে কম সচেতন নন তা প্রকাশ্যে জানিয়েছেন।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপধ্যায় বাঙ্গালার নব্য লেখকদের প্রতি নিবেদন করে লিখেছিলেন ‘যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন অথবা সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করিতে পারেন তবে অবশ্য লিখিবেন। যাঁহারা অন্য উদ্দেশ্যে লেখেন তাঁহাদিগকে যাত্রাওয়ালা প্রভৃতি নীচ ব্যবসায়ীদিগের সঙ্গে গন্য করা যাইতে পারে ।

যাহা অসত্য, ধর্মবিরুদ্ধ; পরনিন্দা বা পরপীড়ন বা স্বার্থসাধন যাহার উদ্দেশ্য , সে সকল প্রবন্ধ কখনো হিতকর হইতে পারে না, সুতরাং তাহা একেবারে পরিহার্য। সত্য ও ধর্মই সাহিত্যের উদ্দেশ্য। অন্য উদ্দেশ্যে লেখনি –ধারণ মহাপাপ।‘

আমার কাজ লেখা। মায়ের হয়ে লেখা। আর মাতৃত্বের এই সৌন্দর্যকে নিয়ে যে তারকা সমালোচিত হয়েছেন তার পাশে থাকা আমার দায়িত্ব। কেননা যে দেশে মেয়েরা প্রকাশ্যে স্তন দেখায়ে রাস্তায় ঘোরে সেখানে এক মা তার সব চেয়ে বড় ধর্ম, দায়িত্ব পালন করছেন। তার উদ্দেশ্য খারাপ ছিলো না। হয়তো তার দেশ থেকে বিষয়টি নজরে আনতে তিনি এভাবে প্রকাশ করেছেন।

আমার কাজ আমার দেশের ভাষা, সংস্কৃতি এবং ধর্মের আলোকে একই তথ্য অর্থাৎ মায়ের স্তনদানের গুরুত্ব আবারো নজরে আনা। আমি নিশ্চয়ই প্রকাশ্যে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরকম ছবি আপলোড দেব না কিন্তু তাই বলে ওই তারকাকে সমালোচনা ভীড়ে ঠেলে এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশের সাহসিকতাকেও নষ্ট করব না।

আমাদের আসলে সমস্যাই এখানে। আমরা বিশ্বায়নে ঢুকে পড়েছি। জগতের তাবৎ অগ্রগতির সুবিধা নিচ্ছি কিন্ত মূল শিক্ষা বা structural development আমাদের হয়না। তাই ড্রাইভিং শেখার আগেই গতি বাড়াতে আমরা ওস্তাদ। যার ফলস্বরুপ আমরা বারবার এক্সিডেন্ট করি।

সম্প্রতি ইউনিসেফ আয়োজিত একটি নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহার বিষয়ক উৎসব হলো বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। এটা দরকার ছিলো আমাদের। আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের শিষ্টাচার অনেক জানা বাকি। এখনো আমরা ইন্টারনেট বলতে বুঝি কি? নোংরা সাইট গুলোতে ঢুকে পর্ন ছবি দেখা। তারই ফলশ্রুতিতে কত বড় তারকাও সাধারণ কোনো নারীকে মেসেনজারে কুপ্রস্তাব দিতে দ্বিধা করেন না। কেননা তিনি যুক্তি দেখান বিশ্বয়নের যুগে ইহাই স্মার্টনেস। এ ধরনের ঘটনাগুলো এখন অহরহ হয়েই যাচ্ছে। এ স্রোতে আপনি যে সাঁতরে চলেছিলেন খেয়ালই করেন নি কখন আপনারই কোমলমতি শিশুটিও এরই প্রতি আকৃষ্ট হতে চলেছে। আপনি বাসায় ইন্টারনেট কানেকশন কেটে দিলেন; কোনোরকম জ্ঞান দিলেন না ওই অন্ধকার জগত সম্পর্কে। ভাবছেন আমার সন্তান নিরীহ, নির্দোষ? কিভাবে নিশ্চিত হলেন সে একই তথ্য সে বন্ধুর কাছ থেকে আরও খারাপভাবে গ্রহণ করছে না।

ঘর থেকে সৌন্দর্যবোধ তৈরি করুন। তার আগে নিজে জানুন কোনটি সুন্দর। একজন শেরার মতো নগ্ন হয়ে স্তনদানের বিষয়টাতে  স্তনদান ভালো কিন্ত বহি:প্রকাশ শোভনীয় নয় আমার দেশের সংস্কৃতি আর ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে এই বোধ যদি আপনার নিজের তৈরি হয় তবে সে বার্তাটুকুই প্রকাশ ভালো। কিন্ত শেরার ছিদ্রান্বেষণ নয়। আমাদের এ সহিষ্ণুতা আমাদের নিজেদের তথা সন্তানদের সৌন্দর্যবোধ সৃষ্টির জন্য কাজে লাগবে। নচেৎ নারী-পুরুষের পারস্পরিক চিরাচরিত আকর্ষণ সম্মান আর ভালোবাসার জায়গায় ধর্ষণ, পরকীয়া আরও তীব্র আকার ধারন করে জায়গা দখল করে নেবে।

জরুরি হলো জানা, পড়া এবং জ্ঞান বৃদ্ধি করা। কেননা চেতনাবোধের বড় অভাব আমাদের। তা না হলে সামনের প্রজন্মকে কিভাবে বলবো যৌনতা প্রাকৃতিক কিন্ত তারও কিছু শিষ্টাচার থাকে। যা অবাধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসে তার শিক্ষা শুধু যৌনতৃপ্তি নয় এর আরও কিছু বিষয় থাকে। যারা কাজের তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেও কাজে লাগায় আর যারা খোজেঁ যৌন তৃপ্তি তারা তা করে সবখানে। ঢেঁকি যে স্বর্গেও ধান ভাঙ্গে। তাই উপায় সে ঢেঁকি হতে দূরে থাকা নিজের প্রয়োজনে নিজের সচেতনতায়।

2056 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।