তমাল রায়

কবি, লেখক, সম্পাদক।

একটি আত্মহত্যা ও পরবর্তী সকাল

মনের পেন্ডুলাম আদতেই ভুল আর ঠিকের মধ্যে দোলেনা, দোলে সেন্স আর নন-সেন্সের মধ্যে। ধরা যাক অস্পষ্ট আলোয় কেউ হেঁটে যাচ্ছে, কোথায় জানা নেই। তবু পথ চলাই তো। হয়তো অশান্ত চিত্ত। ধর, আঙুলের পাশেই দাঁড়িয়ে আঙুল, তবু মিশে তো নেই। বিভেদ স্পষ্ট। হয়তো এক হলে তা রূপান্তরিত হতো শক্তিতেই। এ হয়তো মানুষের আজন্ম শিক্ষা, যে শিক্ষা তাকে পৃথক হতেই শিখিয়েছে। কিন্তু পৃথগতার কষ্টটুকু শেখাই নি। যেমন, অভিমন্যু।

ভাবছিলাম, তার কথা, যে ছিলো, অথচ 'না' হয়ে গেছে কিছু আগেই। আর যাকে জড়িয়ে, এত পথ চলে আসা, হয়তো তিনজন, এক ছাদ, এক ঘর, তবু কত দূরত্ব বল, ধর দু’জন। ধর মা আর মেয়ে, ধর বাপ আর ছেলে। আবিষ্ট হয়েই তো থাকা। ধর পাশা পাশি পাশবালিশ করে শোয়া কুড়ি কুড়ি বছর। কি মিথ্যে তাই না? আর, আজ যিনি রয়ে গেলেন ভাবছেন, হ্যাঁ আজ ভাবছেন, কোথা দিয়ে শূন্য ঢুকে পড়েছিলো, দু’জনের মাঝে। নইলে এতটা দূরত্ব, এই এক চিলতে আটপৌরে আত্মস্থতাতেও! আপাতত সঞ্জয় লিখে চলেছে, মহাভারত। সেও তো গার্হস্থ্য যুদ্ধের ইতিবৃত্ত! সে তাকে যতই গ্লোরিফাই করাই হোক না কেনো!

যেমন এই মাঝ রাতে সন্তান হারানো মা লিখে চলেছেন, একের পর এক পোস্ট...কোথায়? শূন্যে। শূন্য কোথায় পৌঁছে দেয়, তুমি জানো? হে আর্যভট্ট! তিনিই কি আদতে এই শূন্যবাদ নামক ভার্চুয়ালের প্রকৃত জনক! দুঃখ বুনে দেওয়াতেই যার নাম খ্যাত হলো! কি হলো উত্তর করো, উত্তর? আমার প্রাণের বাংলাদেশ। মেয়েটির বয়স মাত্র কুড়ি। প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী (আমি মুগ্ধ তার আঁকা ছবি দেখে)। তার আঁকা ছবির এগজিবিশন চলছিলো, আর্ট গ্যালারিতে। গতকাল বিকেলে আত্মহননের পথ বেছে নিলো। তার শোকাহত মা, যিনি নিজেও একজন কবি ও গদ্যকার। একের পর এক ফেসবুক পোস্ট করে যাচ্ছিলেন। প্রতিটি পোস্ট প্রায় নিখুঁত। যুক্তি ও শব্দের প্রকরণে যেভাবে লেখার নির্মাণ হয়, সেভাবেই লিখিত হচ্ছিলো প্রতিটি পোস্ট। কোথাও আবেগ সর্বস্বতা নেই, শোকের বাহুল্য নেই। খুব স্বাভাবিক ভাবেই, ফেসবুকের বাকি সুস্থ মানুষরা(!) মা'কে এই ধারাবাহিক পোস্ট করা থেকে নিবৃত্ত করতে চাইছিলেন! এবং সদ্যপ্রয়াতার জননী, তাদের বুঝাচ্ছিলেন, তার কষ্ট লাঘব করার এটিই মাধ্যম। তাঁকে যেন নিবৃত্ত না করা হয়! নীচে শোকাহত মার তিনটি পোস্ট কপি পেস্ট করলাম।

সন্ধ্যা 5.29:

আমার বাচ্চাটা আর নাই, ও বেঁচে গেছে, এইবার সত্যি বেচে গেছে, সোনামণি তুই স্বার্থপর, আমাকে একা কষ্ট পাওয়ানোর জন্য রেখে গেছিস? এইমাত্র সত্যি সত্যি ঘটলো এটা, আমার মেয়েটার ঠাণ্ডা শরীরের কোমর ধরে ছিলাম আমি, বাহাদুর কেঁচি দিয়ে ওর গলার ফাসটা কেটে দিলো। আমি ওকে শোয়ালাম, ইচ্ছামতো গালি দিলাম, উঠ শয়তান, বদমাইশ তুই, এমন করতে পারবি না তুই...আচ্ছা, আমার বানান ভুল হচ্ছে না তো, খুব লজ্জার হবে ব্যাপারটা!

রাত 11.44 :

যারা খুব পেরেশান হচ্ছেন এই অবস্থায় ফেইসবুকে আমার স্ট্যাটাস দেখে, ভাবছেন, "হাউ স্ট্রেঞ্জ! কেমনে পারে কেউ এমন অবস্থায় স্ট্যাটাস দিতে" কেউ বলছেন আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। পরিবারের লোকজনদের কাছে অনুরোধ করেছেন কেউ কেউ যেন ফেইসবুক থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয় আমাকে। থ্যাংকস সবাইকে। আমি ঠিক আছি যতটা ঠিক থাকলে চলনসই লাগে। আমার ভালো লাগছে লিখতে ওর কথা, ওকে ঘিরে থাকা কথা, আমার আর ওর এক অদ্ভুত সম্পর্কের কথা। সবটা বলে বুঝানো যাবে না, না বুঝাতে পারলেও বলা থামানো যাবে না, আমি শান্ত থাকতে পারবো না চুপ হয়ে থেকে। আমি চুপ হলে ওর সাথে কানেক্ট করতে পারবো না। আমি লিখছি আর ওকে ভাবছি, ওর সাথে কথা হচ্ছে আমার ওকে নিয়ে লিখতে লিখতেই। আমার শোকের প্রকাশ ওকে জপতে জপতেই। আমার জীবনে এই প্রথম এবং সম্ভবত এই শেষ এমন ঘটনার মুখে পড়া। নিজেকে শোকগ্রস্তা বলতে চাই না। আমি জানি না কি বললে অনুভূতি সঠিক বুঝাতে পারব। প্রচণ্ড রাগ আমার ভেতর দাউদাউ করে জ্বলছে। আমি মাহিকে সমানে গালি দিচ্ছি। আমি বলছি আই হেইট ইউ মাহি, তুমি পারো না এভাবে আমাকে ফেলে যেতে। আমি ভাবছি ও কি সুন্দর সটকে গেলেঅ। এই বিচ্ছিরি দুনিয়াদারী দেখার আগেই কেটে পড়তে পেরেছে বলে আমি রীতিমতো জেলাস হচ্ছি। আমার সুন্দর বাচ্চাটা খুব বেশি অসুন্দর দেখার আগেই মৃত্যুর স্বাভাবিকতাকে আলিঙ্গন করলো। একটা ছোট্ট নালিশ আছে অবশ্য, কেনো ছিলো তোর এত আবেগ? কেনো বাস করতে চাইতি রূপকথার জগতে? প্যারাডক্স বুঝতি খুব সহজে, কিন্তু মানতে কেনো চাইলি না তবে?

'আনুমানিক রাত তিনটে:

কজ এ্যাণ্ড এফেক্ট। হ্যাঁ, এই সূত্রের সত্যতা প্রমাণ করতেই চলে গেলো আমার বাচ্চাটা। নিয়ম মেনে সুত্রের সুতা ধরায় আমার এই হাত দুইটাও শামিল ছিলো। তাতে অবশ্য অপরাধী হাতগুলার লজ্জা হতো না। সাবানে আর লোশানে ভালোই প্রলেপ পড়ে গেছিলো। তবে আজকে বাচ্চাটার গলা থেকে শাল দিয়ে বানানো ফাঁস খুলতে গিয়ে প্রলেপ সামান্য মুছে গেছে। বাকিটা মুছে ফেলবার সাহস হলে হয়তো ওর সাহসের দিকে চোখ তুলে তাকানোর যোগ্য হতাম।

বাচ্চাটাকে শিখিয়েছি একরকম, মানতে বলেছি আরেকরকম। বলেছি সত্যি স্বীকার করলে ছাড় দেবো, কিন্তু ছাড় দেবো কি করে, সেই ক্ষমতা অন্য কোনো হাতের সুতায় ধরা, তাই বাচ্চাটার সত্যি স্বীকার আমার কানের ফুটাতে ঢুকতেই অস্বীকার করতো। তাছাড়া এইরকম ভুলভাল শিখতে শিখতে বড় যখন আমিও হয়েছি হক নেব সেরের উপরে সোয়াসের। আমার অবদমনের শোধ নেবার সাধ জাগা অন্যায় তো না। কিন্তু মস্তানি আমার উপর যা হয়েছিলো মেয়ের উপর বোধহয় তার চেয়ে বেশি হয়েছিলো। আমি একফোঁটা স্বাধীনতা পাইনি বলে স্বাদও জানতাম না, কিন্তু মেয়েকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েও স্বাদ নেবার বেলায় চামচের মাপ করে দিয়েছি নির্দিষ্ট। তো মেয়ের পরস্পর বিরোধী সত্তা আমার ছায়াতেই বেড়ে উঠেছিলো। দায় এড়াবো না রে মা। কিন্তু চলে গেলি যে এখন শাস্তি দেবে কে? মাফই বা চাইব কার কাছে?'

পোস্টগুলি পড়তে পড়তে আমি স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম। বিহ্বল। অশ্রুসজল নিজেকে দিশাহারাও লাগছিলো। কারণ,আমিও এক কন্যা সন্তানের পিতা। প্রসঙ্গত বলি, কবি মা হয়তোবা ঐহিক বাংলাদেশের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এই পোস্টে তা অপ্রাসঙ্গিক। কারণ গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর মতোই এ সমস্যা গ্লোবাল! আমার, আপনার, আমাদের! শিউরে উঠছিলাম। সারা রাত বসে ভাবতে ভাবতে এত শৈত্যপ্রবাহ আক্রান্ত হলাম। এত অস্থিরতা! কেবল ভাবছিলাম, এমন ঘটনা কি করে ঘটে? যখন শোকেও স্বান্তনার রিয়েল হাত কাঁধ স্পর্শ করে না, আর সেই ব্যক্তিগত সেন্টহেলেনায় থাকা মা কি এভাবেই লিখে রাখেন কনফেসন জনিত এপিটাফ এই ভুবনগ্রামের জন্য? আমরা যারা চল্লিশ পেরনো প্রজন্ম, আমি পুড়ছি, দগ্ধ হচ্ছি, আর ভাবছি, প্রতিটি অসুন্দরের মধ্যেও তো থাকে সুন্দরের বীজ। তবে কেতো এত অস্থিরতা? এত অসহিষ্ণুতা এই এত্ত বড় দুনিয়া জুড়ে! যে মা পাখিটা ঠোঁটে করে খাবার ঢুকিয়ে দিলো, সন্তান পাখির মুখে এই ভোরে, সে কি জানে, আদতে এই মহাশূন্যে, তার কোনো চিহ্নমাত্র থাকবে না কিছু পর, কারণ ওই সর্বগ্রাসী রাক্ষুসে শূন্য, মহাশূন্য থেকে ব্ল্যাকহোলের মধ্যে গিলে নেবে সব, তোমায়, আমায়, আমাদের, আর তারপর? মৃত এক নগরীর বুকে কে হেঁটে যাবে? কে? হে ভুবনগ্রামের বাসিন্দা তোমরা সতর্ক হও, এত নির্জন কুয়াশা ছড়ানো এই নিঃসঙ্গতার বাঁচা থেকে তফাৎ যাও...এখন ভোর, একটুও কি ভাবা যায় না, প্রতিটি ক্যাওসের মধ্যেও আছে কসমিক সৌন্দর্য, তার রূপঝুরে আঁখি কি আজ আর লাগবেই না, এহ সত্য? আপাতত গান ভেসে আসছে, দূর থেকে, পেটা ঘড়িতে ঘন্টা বাজলো, কিসের শেষ? না শুরুর? হ্যাঁ ক্লান্ত সন্তানের মৃতদেহ স্পর্শ করে শুয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়া মায়ের মুখে এখন ভোরের আলো। আজ নিশ্চিত দুনিয়াটা একটু বদলাবে, বদলাবেই, কি বল?

1704 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।