ফরিদ আহমেদ

লেখক, অনুবাদক, দেশে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। দীর্ঘ সময় মুক্তমনা ব্লগের মডারেশনের সাথে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের অনুবাদ করেছেন। বর্তমানে ক্যানাডা রেভেন্যু এজেন্সিতে কর্মরত অবস্থায় আছেন। টরন্টোতে বসবাস করেন।

একজন অন্যরকম অঙ্গজা (পর্ব-২)

বলটাকে হাতে নিয়ে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকে মারিয়া।

তার জীবনে এটাই সে প্রথম বল হাতে নিয়েছে। গভীর আবেগ আর আগ্রহ নিয়ে বলটার উপর হাত বুলায় সে। নরম আর মসৃণ চামড়া দিয়ে বানানো বল। পাহাড়ের উপরে উইলো গাছের নীচে লুকিয়ে থেকে খেলা দেখে সে। নীচে একটা সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ রয়েছে। সেখানে গ্রামের পুরুষরা ভলিবল খেলে। ওদের খেলার নকল সে অনেকবারই করেছে বল ছাড়া, নেট ছাড়া। আজ সেই সত্যিকারের বলটাই সেই হাতে পেয়েছে। খেলোয়াড়দের মধ্যে কেউ একজন উল্টোপাল্টা মেরেছিলো বলটাকে। সেটা উড়ে এসে পড়েছে মারিয়ার সামনে।

খেলোয়াড়দের মধ্যে দু’জন এগিয়ে আসতে থাকে বলের খোঁজে। একটু এগিয়েই মারিয়াকে চোখে পড়ে তাদের। চিৎকার করে বলটাকে ফেরত দিতে বলে মারিয়াকে তারা।

বড় করে নিঃশ্বাস নেয় মারিয়া। নিচের দিকে ছুড়ে দেবার বদলে আকাশে উড়িয়ে দেয় বলটাকে সে। অনেক উঁচুতে উঠে ঘুরতে ঘুরতে নেমে আসতে থাকে বলটা। ঠিক এই সময়ে লাফ দেয় মারিয়া। শূন্যে ভেসে উঠে তার দেহটা। একটা হাত উঁচু হয়ে গিয়েছে। বলটা নেমে আসতেই সার্ভ করার মতো করে হাতের তালু দিয়ে সে আঘাত করে বলটাকে। তীব্র গতিতে বলটা ছুটে যায় মাঠের দিকে।

মাঠের মধ্যে তীব্র কোলাহল পড়ে যায়। শূন্যে ভেসে ওঠা মারিয়াকে চোখে পড়েছে সকলেরই। ছুটে আসতে থাকে সবাই মারিয়ার দিকে।

মুহূর্তের মধ্যেই তারা ঘিরে দাঁড়ায় মারিয়াকে। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকেই সে চেনে। এরা তার বাবার বন্ধু। গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসে গ্রামের মসজিদের ইমামও। পাশ দিয়ে হয়তো যাচ্ছিলো। হইচই শুনে এগিয়ে এসেছে। ইমামই এগিয়ে আসে মারিয়ার দিকে। শক্ত হাতে মারিয়ার চিবুক ধরে সে।

“ঠিক কী করছিলে তুমি?”

“আমি ভলিবল খেলতে চাই।” মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে মারিয়া বলে।

“খেলাধুলা করা মেয়েদের জন্য হারাম। তুমি জানো না?”

“জানি। কিন্তু, আমি ভালো খেলি। আমাকে খেলায় নিলে আমি এদের সবাইকেই হারিয়ে দিতে পারবো। আমার সার্ভ করা দেখেছেন আপনারা।” গর্বের সাথে মারিয়া উত্তর দেয়।

মারিয়ার চিবুকে চাপ বাড়ে ইমামের। অন্য হাতটা নেমে আসে বিদ্যুৎ গতিতে। চটাস করে একটা শব্দ হয়। রক্তে ভেসে যায় মারিয়ার মুখের ভিতরটা। চোখের কোনটা ভিজে গিয়েছে। এক চড় দিয়েই ইমাম ক্ষান্ত হয় না। আরো গোটা কয়েক চড় বসায় সে মারিয়ার গালে। তারপর এক দলা থুথু ছিটিয়ে দেয় সে তার চোখে।

“তোমার মতো মেয়েরা হচ্ছে বাজে মেয়ে।” হিসহিস করে মোল্লা বলে। “বাড়ির ভিতরে যাও নোংরা মেয়ে কোথাকার।”

দলের সবগুলো লোকগুলো লোকই নেমে যেতে থাকে নীচের মাঠে আবার তাদের খেলা শুরু করার জন্য। যাবার আগে প্রত্যেকেই মারিয়ার মুখে থুথু ছিটিয়ে দিয়ে যেতে ভোলে না।

লোকগুলো চলে যেতেই বাড়ির দিকে ছুট লাগায় মারিয়া। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই অন্য পাশের মাঠ থেকে ছেলেদের গলার আওয়াজ শুনতে পায় সে। একদল ছেলে ফুটবল খেলছে। লুকিয়ে লুকিয়ে বুভুক্ষের মতো এদের খেলাও দেখেছে সে। কিন্তু, এদের সাথে খেলতে যাবার অনুমতি তার নেই। চার দেয়ালের মধ্যে লুকিয়ে থেকে একটা মেয়েকে জীবন কাটাতে হবে, এটাই এই তালিবান অধ্যুষিত এলাকার কঠোর নিয়ম।

এক ছুটে ঘরের মধ্যে ঢুকে নিজের পোশাক খুলে বড় ভাই তৈমুরের পোশাক পরে নেয় মারিয়া। নিজের সমস্ত পোশাকগুলোকে এক সাথে জড়ো করে সে। সেগুলোকে নিয়ে বাইরে চলে আসে সে। কয়েকটা ইট দিয়ে ঘিরে সেটাকেই চুলো বানিয়েছে তার মা। সেটার মধ্যে সমস্ত কাপড় রাখে সে। কেরোসিন এনে কেরোসিন ঢালে কাপড়ের উপর। তারপর ম্যাচ জ্বালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয় সে। কাপড়ে নয়, যেনো মারিয়ার চারপাশের পৃথিবীতে আগুন ধরে গিয়েছে। রান্না ঘরে গিয়ে ধারালো একটা ছুরি বেছে নেয় সে। লম্বা চুলের গোঁড়া ধরে কাটতে থাকে সে। গোছাগোছা চুলকে একই আগুনে ছুড়ে দিতে থাকে সে। মুহূর্তের মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে যতে থাকে তার রেশমের মতো কালো চুল।

তার বাবা কখন এসে দাঁড়িয়েছে, তাকে লক্ষ্য করছে, কিছুই খেয়াল করে নি মারিয়া।

অনেকক্ষণ ধরেই মেয়ের উন্মত্ত অবস্থা দেখছিলেন শামস কায়ূম ওয়াজির। আগুনের চারপাশে তার ছুটোছুটি গায়ে, ছেলেদের পোশাক আর চুল কাটার দৃশ্য দেখতে দেখতে তিনি ফিরে গিয়েছিলেন ফেলে আসা এক অতীতে। মারিয়ার মধ্যে দেখতে পাচ্ছিলেন অকালে মৃত তার বোনকে। সম্পূর্ণ অন্য এক ধরনের একটা মেয়ে ছিলো সে। শক্তিশালী এক সিংহী। কিন্তু, এই দৈত্যকুলে সিংহীকে তার মতো করে বাঁচার সুযোগ দেওয়া হয় না।

চুলার দিকে এগিয়ে আসেন শামস কায়ূম। মারিয়ার পোশাক এবং চুল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সেদিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেন তিনি। মারিয়ার কাছে এসে তার ছেলেদের মতো ছোট করে কাটা চুলের মধ্যে স্নেহের আঙুল বুলান তিনি।

“তুমি আমার নতুন ছেলে। রক্তপাতহীন যুদ্ধজয়ী আমার নতুন ছেলের একটা যোদ্ধা নাম দরকার। আমরা তোমাকে চেঙ্গিস খান বলে ডাকবো।"

শামস কায়ূম ঝুঁকে পড়লেন তার নতুন ছেলের দিকে। একবার বাঁ কানের আর একবার ডান কানে মুখ নিয়ে নামটা বললেন। তারপর আজান দিলেন্ তিনি।

মারিয়া তুরপাকাই বিদায় নিলো, জন্ম হলো চেঙ্গিস খানের।”

 

1453 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।