ফরিদ আহমেদ

লেখক, অনুবাদক, দেশে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। দীর্ঘ সময় মুক্তমনা ব্লগের মডারেশনের সাথে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের অনুবাদ করেছেন। বর্তমানে ক্যানাডা রেভেন্যু এজেন্সিতে কর্মরত অবস্থায় আছেন। টরন্টোতে বসবাস করেন।

একজন অন্যরকম অঙ্গজা (পর্ব-১)

শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সাইকেল চালাচ্ছে সে। পেডালের উপর পা দুটো পিস্টনের মতো চলছে। কান খাড়া হয়ে রয়েছে তার। ঝিরিঝিরি বাতাস পিছনের কর্মকাণ্ড বয়ে আনছে। ছেলেগুলোর ছুটে আসার শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে। ওদের গালিগালাজ এবং ব্যঙ্গবিদ্রূপও শুনতে পাচ্ছে সে। পালাতে হবে এদের কাছ থেকে। যেভাবেই হোক না কেনো, তাকে পালাতেই হবে।পেশোয়ারের পুরনো অংশের এই জায়গাটাতে আসাটা তার ঠিক হয় নি আজ, এটা বুঝতে পেরেছে সে অনেক আগে। এটা তার জন্য নতুন শহর। নতুন শহর বলেই প্রতিদিন নানা কাজের অছিলায় একেক দিকে যায় সে। শহরটাকে চিনে নেবার অদম্য বাসনা থেকেই এই কাজটা করে সে। আজ যখন এই পুরনো অংশে আটা কিনতে এসেছিলো সে, শুরুটা খারাপ লাগে নি মোটেও তার। পাথরের দেয়াল আলাদা করে রেখেছে সার্ড চাহ, গুনজি এবং ঢাকি নালবান্দিকে। এখানেই ছেলেগুলো অনুসরণ করা শুরু করে তাকে। না দেখার ভান করে নিজের কাজ করে যাচ্ছিলো সে সতর্কতার সাথে। কিন্তু, এদের মধ্যে একজন তাকে ডাকতেই আর দ্বিধা করে নি। সাইকেলের উপর উঠে দ্রুত গতিতে পালানো শুরু করেছে সে। বখাটে এই গ্যাং এর সাথে কথা বলতে যাওয়ার বিপদ তার জানা আছে। তার সাথে গল্প করার জন্য ডাকে নি এরা। এরা রাস্তায় শিকারির মতো ওৎ পেতে থাকে ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে। আজ এরা তাকে সহজ শিকার হিসাবে বেছে নিয়েছে। হাতের ঘড়িতো নেবেই, পায়ের জুতো জোড়াও খুলে নিতে পারে।

সাইকেল নিয়ে পালাতে শুরু করার সাথে সাথে বখাটেগুলোও চিৎকার করে তার পিছু নিয়েছে। কয়েকজনের কাছে সাইকেল আছে। তারা সাইকেলে চড়ে বসেছে। বাকিরা পায়ের উপর ভরসা করেই দৌড়াতে শুরু করেছে।

ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায় সে। সাইকেল চালিয়ে ধাওয়া করে আসলেও বেশি খানিকটা পিছনে পড়ে গেছে তারা। সে যদি এই গতি বজায় রাখতে পারে, ছেলেগুলোর পক্ষে তাকে ধরা সম্ভব নয়।

সামনের দিকে মনোযোগ দিয়ে সাইকেল চালানোর বদলে ছেলেগুলোকে মেপে নেয় সে। বখে যাওয়া শহরের ছেলে এগুলো। সারাদিন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে জটলা করা ছাড়া এদের অন্য কাজ আর নেই। মাথার মধ্যে তীব্র একটা রাগের অনুভূতি টের পায় সে। এদের সবগুলোকেই ঘায়েল করার সামর্থ্য তার আছে বলেই তার ধারণা। পালানোর বদলে রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সে।

বড় রাস্তা ছেড়ে একটা গলির মধ্যে ঢুকে পড়ে সে। সাইকেল থামিয়ে দেয় সে। নেমে আসে সাইকেল থেকে। অপেক্ষা করছে ছেলেগুলোর জন্য।

ধাওয়া করা ছেলেগুলো অল্পক্ষণের মধ্যেই এসে দাঁড়ায় গলির মুখে। ছয়জন তারা। আমাকে দেখে খুশিতে সবার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। প্রায় হাতছাড়া হয়ে যাওয়া শিকার এভাবে সহজেই হাতের মুঠোয় ধরা দেবে, এটা বিশ্বাসই করতে কষ্ট হচ্ছে তাদের। বাজে গলায় একজন তাকে কিছু একটা বললো। ভাষাটা অপরিচিত তার কাছে। কী বলছে সে, সেটা বুঝতে না পারলেও এর অর্থ যে ভালো কিছু হবে না সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না তার। পাল্টা কোনো উত্তর সে দিলো না। নিঃশব্দে সবাইকে মাপছে সে। সবাই না, দলের একজন আসবে তাকে পিটিয়ে সাইজ করতে। সব গ্রুপেই একটা একটা আলফা ডগ থাকে। সেটাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে সে। খুব বেশি কষ্ট অবশ্য করা লাগলো না তার। এক ঝলক দেখেই বুঝে গেলো কোনটা নেতা এই দলের।

ছয় জনের দলের মধ্য থেকে একজন এগিয়ে এলো সামনে। লম্বায় তার থেকে সামান্য খাটো। কিন্তু গাঁট্টাগোট্টা ছেলে। দেখলে সিমেন্টের বস্তা মনে হয়। শক্ত হাত, চওড়া কাঁধ। মারপিটে ওস্তাদ লোক এ, দেখলেই বোঝা যায়।

শুরুটা হলো ধাক্কা-ধাক্কি দিয়ে। ছেলেটা তার ঘড়ি ছিনিয়ে নেবার জন্য হাত বাড়ালো। সে নিতে দিলো না। তার পরিবর্তে সে তাকে বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। পিছনের ছেলেগুলো অর্ধবৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। চিৎকার করে সঙ্গীকে উৎসাহ দিচ্ছে। রক্ত দেখার নেশায় উন্মত্ত হয়ে আছে।

এই দৃশ্য সে বহুবার দেখেছে দারাতে। একদল শিকারি হায়েনা এভাবেই শিকার করে ভীত হরিণকে। আজ অবশ্য শুধু দেখা না, নিজেই পড়ে গেছে হায়েনার ঝাঁকের কবলে।

কয়েক সেকেন্ডের জন্য সময় যেন স্থির হয়ে যায়। অন্ধকার সরু গলির মধ্যে সবকিছু থেমে গিয়েছে। তার পিছনে একটা পাইপ থেকে টিপটিপ পানি পড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে। গলাটা শুকিয়ে গেছে। বুকের মধ্যে প্রচণ্ড তৃষ্ণা অনুভব করে সে। আলফা ডগ এগিয়ে আসছে। হাতের আঙুলগুলোকে বাঁকা করে ফেলে সে, যেনো একটা টেনিস বলকে ধরে আছে। আলগা ডগ খানিকটা এগিয়ে এসে থেমে দাঁড়ায়। তারপর এক দলা থুথু ছিটিয়ে দেয় তার পায়ে। লড়াই শুরু করার এটাই তার সিগন্যাল।

বুনো ষাঁড়ের মতো ছুটে আসে আলফা ডগ। জ্যাক-হ্যামার স্টাইলে সে তার হাত দুটোকে টেনে নেয় পিছনে, তারপর সেটাকে ছুড়ে দেয় আলফা ডগের চোয়ালে। আর্তনাদ বেরিয়ে আসে আলফা ডগের গলা দিয়ে। প্রচণ্ড ধাক্কায় মাথাটা পিছিয়ে গিয়েছে তার। কিন্তু, দ্রুতই নিজেকে সামলে নেয় সে। দ্রুত গতিতে ঘুষি চালায় প্রতিপক্ষের মুখে। একটা দাঁত নড়ে গেছে, এটা টের পায় সে। মুখের মধ্যে উষ্ণ রক্তের স্বাদ পায়। সেকেন্ডের মধ্যে পরস্পরকে জাপটে ধরে তারা। কুস্তিগিরের মতো লড়তে থাকে। তার হাত আলফা ডগের হাতে, কপাল লেগে আছে কপালে। লড়াইরত দুটো ষাঁড়ের মতো ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে থাকে তারা। অল্পক্ষণের মধ্যেই আলফা ডগের প্রতিরোধ শেষ হয়ে আসে। শক্ত হাতের চাপ দিয়ে আলফা ডগের মুঠিটাকে সামান্য একটু আলগা করে নেয় সে। তারপর এক ঝটিকা তাকে চোক হোল্ডে নিয়ে যায় সে। একটা হাঁটু ভাঁজ করে রেখেছে রাস্তায়, অন্য হাঁটুর উপর চেপে ধরেছে সে আলফা ডগকে। ফুলে ওঠা বাহু আলফা ডগের গলা চেপে ধরে আছে শক্ত করে। শ্বাস নেবার জন্য ভেটকি মাঝের মতো খাবি খেতে থাকে আলফা ডগ।আলফা ডগের করুণ পরিণতি দেখে ভিত ছেলেগুলো লড়াই করার বদলে একে একে সরে পড়তে থাকে। সবাই চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে সে। তারপর আলফা ডগের কণ্ঠ থেকে নিজের হাত সরায় সে। তার হাঁটু থেকে গড়িয়ে রাস্তায় পড়ে যায় আলফা ডগ। নিঃশ্বাস নেবার জন্য হাঁসফাঁস করছে সে। দুই হাত দিয়ে নিজের গলা চেপে ধরে আছে। আলফা ডগের সাইকেলে পানির বোতল রয়েছে। লম্বা চুমুক দিয়ে সেটা থেকে পানি খায় সে। তারপর ফিরে আসে আলফা ডগের কাছে। একটা পা ওর বুকের উপর রেখে বোতলের বাকি পানিটা ঢেলে দেয় আলফা ডগের ঘামে ভেজা নোংরা মুখে উপর। আলফা ডগের দুর্দশা দেখে তৃপ্তির আনন্দ বয়ে যেতে থাকে তার বুক জুড়ে। মাটিতে পড়ে থাকা খাবি খাওয়া এই ছেলেটা একক কোনো ব্যক্তি নয় তার কাছে। পুরো পেশোয়ারকেই সে হারিয়ে দিয়েছে প্রথম রাউন্ডের লড়াইয়ে। কেন যেনো মনে হচ্ছে এমন লড়াই তাকে আরো লড়োতে হবে সামনের দিনগুলোতে।

কিছুই ঘটে নি এমন একটা ভাণ করে নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে ঢোকে সে। মুখের এক পাশ দিয়ে এখনো রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। অনেক চেষ্টা করেও এটাকে থামাতে পারে নি সে। আলফা ডগের ঘুষি খেয়ে গোঁড়া থেকেই নড়ে গিয়েছে দাঁতটা। স্যান্ডেল দু’টোকে ক্লোজেটে সাজিয়ে রাখতে গিয়ে জমে যায় সে।

“একি অবস্থা তোমার চেঙ্গিস খান? দখলদার মোগলদের সাথে লড়াই করেছো নাকি রাস্তায়?”

বাবা যে কখন এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে, সেটা টের পায় নি দশ বছরের চেঙ্গিস খান।

“খানিকটা সেরকমই বাবা।” মাথাটাকে কিছুটা নামিয়ে উত্তর দেয় চেঙ্গিস খান। মুখের কোণ বেয়ে নেমে আসা রক্তের ধারাটা সে দেখাতে চায় না তার বাবাকে।

1461 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।