আনিতা ক্ষ্যাপী, ডাক নাম টুনি। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সেই বিয়ে হয় সুধীর হালদারের সাথে। বিয়ের পর অধিকাংশ নারীর মতোই গতানুগতিকভাবে টুনি দেখেছে স্বামীর রক্তচক্ষু আর সহ্য করেছে শারীরিক নির্যাতন। পান থেকে চুন খসলেই বেদম প্রহার ছিলো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সেসব সে মেনে নিয়েছিলো- পিতৃগৃহে বেড়ে ওঠার পাশাপাশি তার জানা হয়ে গেছে নারী মানেই স্বামীদের হাত পাকানোর বালির বস্তা, শত নির্যাতন-লাঞ্ছনা নীরবে সহ্য করে স্বামীর পায়ের কাছেই পড়ে থাকতে হবে। এভাবেই পড়ে ছিলো তার মা, তার মায়ের মা, তারও মা।
কন্ঠে জাদুকরী শক্তি আর যেকোন কথাকে সুরের ছন্দে বাঁধার অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে জন্ম নেয়া টুনি সব কষ্টকে ভুলে থাকতো কষ্টগুলোকে গানে রূপ দিয়ে।
স্বামীর হাতে নিত্য মার খাওয়া টুনি একদিন জানতে পারে সে মা হতে চলেছে। আশায় বুক বাঁধে এবার বুঝি স্বামীর ভালোবাসা পাবে, এই বুঝি সকল কষ্টের অবসান হলো! নিজেকে মনে হতে লাগলো হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো বেলুন। এভাবেই কেটে যায় কয়েকমাস। কিন্তু তার সকল আশা, স্বপ্নের দেয়ালে নীলচে কালি ঢেলে দিলো স্বামী সুধীর। হুল ফুটিয়ে চুপসে দিলো হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো ফাঁপা বেলুন। গান গাওয়ার অপরাধে এক রাতের বেদম প্রহারে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে টুনি। স্ত্রীর নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে সুধীর ভেবে নেয় টুনি মরেই গেছে। ঘাড় থেকে আপদ বিদায় করার জন্য টুনির দেহটাকে বস্তায় ভরে বস্তার মুখ বেঁধে ফেলে দেয় ইছামতী নদীতে। বস্তাবন্দী টুনির দেহ নদীতে ফেলে সুধীর হালদার হয়তো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলো। কিন্তু অলক্ষ্যে নারীর প্রতি সদা রুষ্ট ভগবান খ্যাক খ্যাক করে হাসছিলেন সুধীরের মনোভাব বুঝতে পেরে।
দীর্ঘ একটা জীবন দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা ভোগ না করে অল্প বয়সে মরে গিয়ে বেঁচে গেলেতো তিনি তুষ্ট হবেন না, তাকে তুষ্ট না করে একজন নারী মরবে কেনো? টুনিও মরে নি সেদিন। জেলেদের মাছ ধরার জালে আটকে টুনিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখা বস্তাটি উঠে এসে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো তাকে বিস্ময়করভাবে। জেলেদের আশ্রয়ে কয়েকমাস পর কোলজুড়ে পৃথিবীতে আসে তার সন্তান পুষ্পা, আরেক টুনি হয়ে ওঠার ব্রত নিয়ে। দেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। স্বাধীনতার সাক্ষী হওয়ার সৌভাগ্য নিয়ে বেঁচে যাওয়া টুনি আর স্বামীর ঘরে ফিরে যায় নি। সন্তানকে নিয়ে এবার তার আশ্রয় হয় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে।
ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের গান শোনাতেন টুনি। মুক্তির গান। বিজয়ের গান। গানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ যোগানো টুনিও একজন যোদ্ধা, কন্ঠযোদ্ধা। ক্যাম্পে টুনির সাথে পরিচয় হয় মুক্তিযোদ্ধা মানদার ফকিরের। সেখান থেকেই শুরু তার জীবনের নতুন অধ্যায়ের।
দেশ স্বাধীনের পর ফরিদপুরে মানদার ফকিরের সাথে বিয়ে হয় টুনির। বিয়ের সময় আনিতা ক্ষ্যাপী টুনির নাম হয়ে যায় সুফিয়া খাতুন। সন্তান, স্বামী, সংসার সামলানোর পাশাপাশি সংগীত চর্চাও করে গেছেন নিয়মিত। স্বামী মানদার ফকিরের উৎসাহ তাকে শক্তি যুগিয়েছে সেসময়। কিন্তু টুনি বা সুফিয়াদের জীবন এতটা মসৃন হলে চলবে কেনো? ইছামতী নদীর তলদেশ হতে উঠে আসার ক্ষণে ভগবানের সাথেতো তার এমন চুক্তি হয় নি! বরং ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে আরো ক্ষেপে আছেন তিনি। ফলে দু'বছরের মাথায় স্বামী মানদার ফকির মরে গেলো।
স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানকে নিয়ে শুরু হয় সুফিয়ার একলা পথচলা। সঙ্গীতকেই তিনি বেছে নেন পেশা হিসেবে। নিজের রচিত কথা, নিজে আরোপিত সুরে গান গেয়েই চলে তার সংসার। লোকসংগীত আর বাউল সংগীতের জন্য একসময় সারাদেশে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। ঢাকার এক অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে আসা শিল্পকলা একাডেমীর ডিজি ও প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী মুস্তফা মনোয়ার সুফিয়ার কন্ঠে গান শুনে তাকে কাঙ্গালিনী উপাধি প্রদান করেন। তারপর থেকেই সুফিয়া কাঙ্গালিনী সুফিয়া নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এক সময়ের আনিতা ক্ষ্যাপী টুনি, পরবর্তীতে সুফিয়া খাতুনই আজকের 'কাঙ্গালিনী সুফিয়া।' তিনি নিজের জন্য যেমন গান রচনা করতেন, তেমনি অন্য শিল্পী, সুরকাররাও তার কাছ থেকে গান নিয়ে- সুর নিয়ে নিজেদেরকে শ্রোতাদের কাছে বিখ্যাত করেছেন, ব্যাবসা করেছেন। কাঙ্গালিনী সুফিয়াকে পুঁজি করে তারা অনেকেই সঙ্গীত জগতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ভাল আছেন। কিন্তু ভাল নেই পাঁচ শতাধিক গানের রচয়িতা, মাটির গানের শিল্পী কাঙ্গালিনী সুফিয়া। বয়সের ভারে ন্যুব্জ এই শিল্পী মুখের সবগুলো দাঁত হারানোর সাথে হারিয়েছেন গান গাওয়ার শক্তি। মিইয়ে গেছে কন্ঠের জোর। গান নেই, উপার্জনও নেই। উপার্জন নেই তাই তিনবেলা খাবারও জোটে না তার। ২০১৫ সালে সরকারের দেয়া একখণ্ড জমি ও একটি ঘর ব্যতিত তার নিজের বলতে কিছু নেই। আজ তিনি সত্যি সত্যিই কাঙ্গাল।
স্বামী পরিত্যক্ত একমাত্র সন্তান পুষ্পা ও তার তিন কন্যার একমাত্র ভরসারস্থল অসহায় শিল্পী অর্ধাহারে, অনাহারে, বিনাচিকিৎসায় এগিয়ে যাচ্ছেন মরণের দিকে দ্রুত। নিষ্ঠুরতা আর অবহেলায় ঋজু হতে হতে নাগালে পেয়েছেন আজ প্রশান্ত আকাশ। সময় হয়ে গেছে সীমানার সব খুটি তুলে দিয়ে দেওয়ার উদাসী ভাসান। খুব সম্ভব ভগবানের এখন আর কোনো ক্ষুধা নেই, তার খাদ্যথলি পরিপূর্ণ এখন বিষন্ন রক্তে। আর ভোতা হয়ে যাওয়া মূল্যবোধের অধিকারী আমরা ব্যস্ত আছি ইস্যু খুঁজে খুঁজে জ্বালাময়ী বক্তৃতা প্রদান করে সবকিছুর দায়ভার শেখ হাসিনার উপর চাপিয়ে দিয়ে লাইক, কমেন্ট উপার্জনে।